শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের পাঁচ জেলায় পানিবন্দি হাজারো পরিবার দুর্ভোগে

যমুনার ৭ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ভরা বর্ষায়ও ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন, টাঙ্গাইলে নদীরক্ষা বাঁধে ধস ভাঙন আতঙ্ক গাইবান্ধায়
যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ছবিটি শনিবার গজারিয়া ইউনিয়নের জিয়াডাঙ্গা গ্রাম থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ ও ভারী বর্ষণের কারণে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে যমুনা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যে পস্নাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে চরাঞ্চল ও ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। সেই সঙ্গে বেড়েছে নদীভাঙন। ধস দেখা দিয়েছে তীররক্ষা বাঁধে। এদিকে, গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মা নদীর সমতলেও বাড়ছে পানি। এতে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। পানিবন্দিদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

বাপাউবোর বন্যা

পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, শনিবার যমুনার পানি গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও সাঘাটা পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেমি উপরে, জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৩০ সেমি, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে ২২ সেমি, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ১১ সেমি, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৯ সেমি এবং টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৪টি নদীর পানি সমতলে অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় সমতলে হ্রাস পেতে পারে বলেও বাপাউবো সূত্রে জানা গেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

টাঙ্গাইল থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, টাঙ্গাইলে হু হু করে পানি বেড়ে তিনটি নদীর বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আরও দুটি নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানি বাড়লেও অনবরত ড্রেজার চালানোর কারণে নদীতীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তার ব্যবধানে শতাধিক ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে মাটি দেওয়ার শর্তে নিউ ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার চালানোর অনুমতি দিয়ে আবার ভাঙন কবলিত অংশে জিওব্যাগ ফেলে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

পানি বৃদ্ধির সময়ও নিরবচ্ছিন্নভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে কালিহাতীর নিউ ধলেশ্বরীর দুই তীরের কুর্শাবেনু, গোবিন্দপুর, কদিমহামজানী, চরহামজানী, দশকিয়া, সলস্না, হাতিয়া, আনালিয়াবাড়ী, টুনিমগড়া, ধলাটেঙ্গর, কুড়িঘরিয়া, চরভাবলা, হিজুলী, এলেঙ্গা, বাশী এবং যমুনার তীব্র স্রোতে বাম তীরে ভূঞাপুরে কষ্টাপাড়া, পাটিতাপাড়া, গোবিন্দাসী, খানুরবাড়ী, জিগাতলা, কুঠিবয়ড়া প্রভৃতি গ্রামের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বীজতলা ও ফসলি জমি ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে।

পাউবো সূত্র মতে, এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের গোলচত্বর পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার অংশ চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে মাটি ভরাটের প্রয়োজন হয়। ওই সড়কে মাটি দেওয়ার শর্তে জেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশে নিউ ধলেশ্বরী নদীর ৯টি স্থান থেকে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ড্রেজার দিয়ে মাটি-বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে নিউ ধলেশ্বরী নদীর চরভাবলায় দুটি পয়েন্টে রিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স বিপুল এন্টারপ্রাইজকে এক দশমিক ০৮ কিলোমিটার, আনালিয়াবাড়ীর ৩টি পয়েন্টে রিফাত এন্টারপ্রাইজ ও অ্যামনেস্টার লিমিটেডকে ২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, সলস্নার দুইটি পয়েন্টে রিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স তুষার এন্টারপ্রাইজকে এক দশমিক ২০ কিলোমিটার এবং রিফাত এন্টারপ্রাইজকে জেকারচর ও গুদারা ঘাট দুইটি পয়েন্টে এক দশমিক ৪৫ কিলোমিটার নদী খননের অনুমতি দেওয়া হয়। উলেস্নখিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে পুরো বর্ষায়ও ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। তারা শর্ত ভঙ্গ করে উত্তোলিত বালু ট্রাক দিয়ে চার লেন প্রকল্পে সরবরাহ না করে কালিয়াকৈর ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে।

অপরিকল্পিত নদী খনন অব্যাহত রাখায় বেলটিয়া গুদারাঘাট পাউবোর অধিগ্রহণ করা জায়গার ১৫০ মিটার ও কদিমহামজানী এলাকার ৬০ মিটার জায়গায় ফেলা জিওব্যাগ ধসে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই দুই স্থানে পুনরায় জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

নিউ ধলেশ্বরী নদীর বাম তীরে আনালিয়াবাড়ী ও ধলাটেঙ্গর গ্রামের হবিবর রহমান (হবি), আ. হালিম, গৃহবধূ ছবিরন বেগম, সাবিনা আক্তার, মোছা. রিনা বেগম, মো. লিয়াকত আলী, সুনীল হাওলাদারসহ অনেকেই জানান, বর্ষার ভরা মৌসুমে নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে দুই তীরেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাউবো একদিকে খননের অনুমতি দিয়েছে অন্যদিকে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে।

তাদের অভিযোগ, নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে চার লেন প্রকল্পে না দিয়ে দিনরাত ট্রাক ভরে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করার বিষয়টি পাউবোর কর্মকর্তাদের জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মজনু মিয়া জানান, নদীর ৯টি অংশে প্রায় ৫ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার এলাকায় চার লেন প্রকল্পের আবদুল মোনেম লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ করছে। তবে ভরা বর্ষায় নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে তীরে ভাঙন দেখা দেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

এদিকে, নিউ ধলেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাউবো নির্মিত সলস্না-হাতিয়া নদীরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাঁধটি যাতে কেউ কেটে দিতে না পারে সেজন্য সলস্না ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশরা পালা করে পাহাড়া দিচ্ছেন। দশকিয়া ইউনিয়নের বালিয়াচরা-পটল বাজার গ্রাম্য রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। দুর্গাপুর ইউনিয়নের চর দুর্গাপুর, বেরীপটল, ভৈরববাড়ী, বেলটিয়া ও আলিপুর গ্রামে পানি ঢুকে বাড়িঘর ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

সলস্না ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জানান, সলস্না-হাতিয়া বাঁধ প্রায় প্রতি বছরই কে বা কারা রাতের অন্ধকারে কেটে দেয়। এবারও যাতে বাঁধ কাটতে না পারে সেজন্য গ্রাম পুলিশ দিয়ে পালা করে দিনরাত পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছেন। তবে যে হারে পানি বাড়ছে এতে যে কোনো সময় বাঁধটির উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে।

দশকিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক ভূঁইয়া জানান, নিউ ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম্য রাস্তা, ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। আমন বীজতলাও তলিয়ে গেছে।

চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. রবিউল আউয়াল জানান, প্রকল্পে প্রচুর বালু-মাটির প্রয়োজন হওয়ায় জেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে তারা নিউ ধলেশ্বরী নদীর ৯টি স্থানে খনন করে বালু-মাটির সংস্থান করেছেন। সেখানে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বালু উত্তোলন করে প্রকল্পে সরবরাহ করছে। অন্য কারও কাছে উত্তোলিত বালু বিক্রি করার অধিকার তাদের নেই।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বর্ষণে গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী তীরবর্তী নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ এলাকায় পানি উঠেছে। ওইসব এলাকার ফসলি জমি, আমন বীজতলা এবং নিচু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।

সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, পানি বৃদ্ধির ফলে কড়াইবাড়ি, খারজানি, পারদিয়ারা ও কুন্দেরপাড়া গ্রামে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে ওইসব গ্রামের মানুষরা ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

এদিকে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুন্দরগঞ্জ, সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ৭৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই চার উপজেলায় ৫০ হাজার টাকা করে মোট ২ লাখ নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ফুলছড়ি উপজেলার জন্য বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ৫০টি শুকনা খাবার প্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ দপ্তর জানিয়েছে।

কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কাজীপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যমুনায় পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের সব নদীর পানিও বেড়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে টাঙ্গাইলের লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে যমুনা নদীর পানি। ইতোমধ্যে জেলার ভূঞাপুর, নাগরপুর ও কালিহাতীতে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের কষ্টাপাড়া, ভালকুটিয়া ও নিকরাইল ইউনিয়নের পাটিতাপাড়া, কোনাবাড়ী ও চিতুলিয়াপাড়া এলাকায়। পস্নাবিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে সিরাজগঞ্জের ৪২ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের হাজারো পরিবার।

যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার বেশকিছু ইউনিয়নের চরাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে এসব অঞ্চলের আবাদি জমি। প্রতিদিনই পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন অনেকেই।

সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, 'চরাঞ্চলের বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়লেও শঙ্কার কিছু নেই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে