রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় লাখো মানুষ দুর্ভোগে

ফসলি জমিসহ চর ও নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হ তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫০ সেমি ওপরে যাওয়ার শঙ্কা
যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রাজারহাট ও উলিপুরে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ছবিটি বৃহস্পতিবার তোলা -স্টার মেইল

উজানে টানা বর্ষণের ফলে ভারতের উত্তর সিকিমে উপচেপড়া তিস্তার পানি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রচন্ড পানির তোড়ে উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীর চুংথাং ড্যাম ধসে যাওযায় বুধবার সকাল থেকেই ভারত গজলডোবা দিয়ে স্মরণকালের অতিরিক্ত পানি ছাড়া শুরু করে। এতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বুধবার থেকে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে দেয়। এরপরও উত্তরাঞ্চলের, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এতে তিস্তা তীরবর্তী জেলাগুলোর লাখো মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, গত ৩০ বছরে তারা এমন কাদাযুক্ত পানি দেখেননি তিস্তায়।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানিতে ভেসে আসে বন্যায় নিখোঁজ ভারতীয় সেনার মরদেহ। এছাড়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে জেলের জালে ধরা পড়ে চার মণ ওজনের একটি ডলফিন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে তিস্তার পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্ট ও নীলফামারীর ডিমলায় বিপৎসীমার ৩০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সময়ে কুড়িগ্রামের রাজারহাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেমি ওপরে এবং কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার ২০ সেমি ওপরে ছিল তিস্তার পানি।

গত দুই দিনে তিস্তা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, কাপাসিয়া, বেলকাসহ কয়েকটি ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলসহ পানি ঢুকছে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়ন ও ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়াসহ কয়েকটি নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে। পানি ঢুকে পড়ায় এসব এলাকার উঠতি আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমি তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বাড়িঘর ও গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ জায়গায় ছুটছেন।

এদিকে, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে গাইবান্ধা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এনডিসি) জুয়েল মিয়া জানান, নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের সতর্ক করতে মাইকিং করা হয়েছে। মানুষকে গরু-ছাগলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সতর্ক থেকে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্র বা ফ্ল্যাট শেল্টারে অবস্থান নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগে নৌকার ব্যবস্থা রাখাসহ চালু করা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বন্যাকালীন মানুষদের জন্য জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, পানির চাপ সামাল দিতে না পেরে তিস্তার গজলডোবা ব্যারেজ থেকে বুধবার সকালে রেকর্ড পরিমাণ পানি বাংলাদেশের দিকে ছাড়ে ভারত। সকাল ৭টায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ১২০ কিউসেক পানি ছাড়ার পর সকাল ৯টার দিকে পানি ছাড়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫ কিউসেক। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সকাল ১০টায় গজলডোবার সবকটি গেট খুলে দিয়ে ঘণ্টায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৪৮৭ কিউসেক পানি ছাড়তে থাকে ভারত। বৃহস্পতিবারও ভারতের নজিরবিহীন পানি ছাড়া অব্যাহত ছিল। আর এতেই তিস্তা নদীর পানি দ্রম্নত বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আকস্মিক বন্যার পর বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামের স্থানীয়রা বলছেন, ৩০ বছর পর এবার তিস্তায় কাদাযুক্ত পানি দেখা গেছে। ফলে নদীর ওপরের জমিতে পলিমাটি জমবে। বন্যার পানি শুকিয়ে যাবার পরও জমিতে পলিমাটি থেকে যাবে। এ কারণে চরে বিভিন্ন ফসলি জমির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এতে করে এবার আবাদ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।

উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের চাপড়ার পাড়ের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'ভারত থেকে আসা নোংরা পানির কারণে কাদায় ভরে গেছে তিস্তার পানি। গত ৩০ বছরে তিস্তায় এমন কাদাযুক্ত পানি দেখিনি। পানি হাতে নেওয়ার পর মনে হয় হাতে সব কাদা। এই পানি গায়ে লাগলে পানিবাহিত রোগ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।'

বৃহস্পতিবার দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কমে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকালের দিকে একই পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তিস্তার পানি।

এদিকে আকস্মিক বন্যায় লালমনিরহাটের ৫ উপজেলার তিস্তা চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি, চরের রাস্তাঘাট ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এদিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির ফলে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘেরচর, ফকিরপাড়া ইউপির রমনীগঞ্জ, সিঙ্গীমারী ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, কালমাটি, পলাশী ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, বড়বাড়ি, রাজপুর ও গোকুন্ডা এলাকার মানুষজন আতঙ্কে রয়েছেন।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উলস্নাহ বলেন, 'আমরা নদী এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করতে বলেছি। সার্বিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের লোকজনদের প্রস্তুতি নিয়ে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।'

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামের রাজারহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তার দুই পাড়ের মানুষ। কয়েকদিন ধরে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। বৃহস্পতিবারও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তার পানি দুপুর পর্যন্ত আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে কমার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বুধবার তিস্তার দুই পাড়ের মানুষকে সরিয়ে মাইকিং করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষজন তাদের ঘরবাড়ি এখনো অবস্থান করছেন। শুধু চরাঞ্চলের কিছু পরিবার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন।

তিস্তা নদীর অববাহিকার বুড়িরহাট এলাকার আবুল কালাম বলেন, 'বুধবার থেকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় নাকি বন্যা হবে, এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি নাই আমরা। স্থানীয় প্রশাসন বুধবার এসে সাবধানে থাকতে মাইকিং করে গেছে।'

তিস্তা নদীর অববাহিকার ঘড়িয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মেম্বার মামুনুর রশীদ বলেন, 'তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আমার এলাকার কিছু বাড়িঘরে পানি উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।'

রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, 'গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বৃষ্টিপাত থেমে থেমে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এবং শুক্রবার বৃষ্টিপাত কমে স্বাভাবিক হতে পারে।'

রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাবেরী রায় বলেন, 'তিস্তায় আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায় নদী অববাহিকায় মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদে থাকার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা সজাগ রয়েছেন। ১৪টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।'

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, 'ভারতের উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীর চুংথাং হ্রদে পানির পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার বাঁধটি খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভারতীয় অংশে তিস্তা নদীর পানি দ্রম্নত বাড়ছে এবং তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা ক্যালকুলেশন করে দেখেছি তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যেতে পারে।'

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে তিস্তার পানি কিছুটা কমতে থাকায় ফের জাগতে শুরু করে তিস্তার চর। সকাল ৮টার দিকে উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের কিসামত ছাতনাই চরে এলাকাবাসী একটি মরদেহ দেখতে পেয়ে বিজিবিকে জানায়। খবর পেয়ে বিজিবি, পুলিশ ও বিএসএফের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এ সময় বিএসএফ মরদেহটি নিখোঁজ সেনা সদস্যের বলে শনাক্ত করে। পরে পতাকা বৈঠকে মাধ্যমে সেনা সদস্যের মরদেহ বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বৃহস্পতিবার সকালে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের ভোটমারী ইউনিয়নের শৌইলমারী চরে শাহজাহান মিয়া নামে এক জেলের জালে চার মণ ওজনের একটি ডলফিন ধরা পড়ে। ডলফিনটি দেখতে আশপাশের উৎসুক মানুষ ভিড় করে শাহজাহান মিয়ার বাড়িতে।

শাহাজান মিয়া জানান, তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় বড় বড় মাছের সমারোহ ঘটায় তিনি এবং তার দল রাত থেকে তিস্তার শোলমারির চরে মাছ শিকার করছিলেন। হঠাৎ ডলফিনটি তাদের জালে আটকা পড়ে।

< প্রতিবেদনটি তৈরিতে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, কালীগঞ্জ (লালমনিরহাট), রাজারহাট (কুড়িগ্রাম), ডিমলা (নীলফামারী) ও কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধির তথ্য নেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে