রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

খুলছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন আজ দৃষ্টিনন্দন নকশায় মুগ্ধ হবেন যাত্রীরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে স্মার্ট এই এয়ারপোর্ট হবে দেশের আয়না টার্মিনালে বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী সেবা পাবেন
আলতাব হোসেন
  ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার সংযোগ' স্স্নোগান নিয়ে আজ শনিবার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের থার্ড টার্মিনাল আংশিক উদ্বোধন করবেন -যাযাদি

অপেক্ষার প্রহর শেষ। এবার স্মার্ট এয়ারপোর্ট হচ্ছে বাংলাদেশে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের থার্ড টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন আজ শনিবার। জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে সকাল ১০টায় আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সম্ভাবনা আর উন্নয়নের দুয়ার খুলবে আকাশ পথে। উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে বিমানবন্দরে সাজ সাজ রব। নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মঞ্চ তৈরিসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। টার্মিনালের উদ্বোধন শেষে দুপুর ১২টায় বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা মাঠে সুধী সমাবেশ করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে সমাবেশে দুই লাখের বেশি নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের টার্মিনালে প্রতিদিন আকাশে ডানা মেলবে দেশি-বিদেশি শত শত উড়োজাহাজ। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি, কাতারের হামাদ, জাপানের হানেদা, তুরস্কের ইস্তাম্বুল, জার্মানির মিউনিখের মতো বিশ্বমানের আকর্ষণীয় বিমানবন্দর হয়ে উঠবে ঢাকা। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে পাল্টে যাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চিত্র। দেশের এভিয়েশন খাতে নবদিগন্তের সূচনা হবে। উদ্বোধনের দিন বিমানের একটি ফ্লাইট থার্ড টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. শফিউল আজিম জানান, থার্ড টার্মিনালের সফট ওপেনিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত পুরো টার্মিনাল ভবনটি এখন দৃশ্যমান। টার্মিনালের চারপাশে অনিন্দ্যসুন্দর কর্মযজ্ঞ যে কোনো বয়সের মানুষের চোখ ও মন ভরে দিবে। নতুন টার্মিনালটি বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রী পরিষেবা দিয়ে দেশের চিত্র পাল্টে দেবে। উদ্বোধন উপলক্ষে টার্মিনাল ভবনের দ্বিতীয় তলা ঘষামাজা হচ্ছে। চলছে বাহারি রঙের কাজ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ করবেন। এরপর উদ্বোধন করে বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে উড়োজাহাজে প্রবেশ করবেন। 'সফট ওপেনিং'-এর জন্য ভবনের দুই অংশেই স্ট্রেইট এস্কেলেটর লাগানো হয়েছে। লাগেজ বেল্ট সংযোজনও প্রায় শেষ। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বছরে ২ কোটির কাছাকাছি যাত্রী আসা-যাওয়া করবেন। বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের থার্ড টার্মিনালের নকশা ও দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে মুগ্ধ সবাই। টার্মিনাল ভবনের প্রবেশ পথেই সিলিংয়ে সোনালি-ক্রিম রঙের চোখ ধাঁধানো কারুকাজ চোখে পড়ে। মেঝেতে বাহারি টাইলস। চারপাশের নীল কাচে শেষ বিকালের আলো উপচে পড়ে তৈরি করছে মনোমুগ্ধ দৃশ্য। এমন দৃশ্য যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তি এনে দিবে। থার্ড টার্মিনালের ভেতরকার অনিন্দ্যসুন্দর এমন দৃশ্য সবার নজর কাড়ছে। এই বিমানবন্দর বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমবে। পাশাপাশি এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধনের পর বাংলাদেশে অনেক পর্যটক আসবে। এতে বিদেশিরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে। দেশের এভিয়েশন খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে তৃতীয় এই টার্মিনাল। এবার স্মার্ট এয়ারপোট হচ্ছে বাংলাদেশে। টার্মিনালের ভেতরের ভবনটির নকশা তৈরি করেছেন বিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। তিনি সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩, চীনের গুয়াঞ্জুর এটিসি টাওয়ার ভবন, ভারতের আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নকশা তৈরি করেন। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে অ্যাপ্রোনে ৮ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ রাখা যাবে। বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী এই টার্মিনালের সেবা পাবেন। নতুন টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেইট থাকবে। যেখানে যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করতে পারবেন। নবনির্মিত এ টার্মিনাল ভবনে থাকছে ৬৪টি ডিপার্চার ও ৬৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ডেস্ক, ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি স্ক্যানিং মেশিন, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১৬টি ক্যারোসেল ও ১১টি বডি স্ক্যানার। কার্গো হ্যান্ডেলিং সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এতে রপ্তানি ও জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। এশিয়ার হাব ওয়ে উঠবে এই বিমানবন্দর। নতুন এই টার্মিনালের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে বোর্ডিং কাউন্টার, ইমিগ্রেশন কাউন্টার, লাগেজে বেল্টসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়ে গেছে। এখানে এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, মুভি লাউঞ্জ, শিশুদের জন্য পেস্ন জোন এবং ফুড কোর্ট যাত্রীদের চাহিদা ও স্বাচ্ছন্দ্য পূরণ করবে। থার্ড টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে সুপরিসর ডিউটিফ্রি শপ এবং বহির্গমন লাউঞ্জ। টার্মিনাল ভবন হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটারের। ভবনের ভিতরে থাকবে বিশ্বের উলেস্নখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া। টার্মিনালটিতে কয়েকটি স্ট্রেইট এস্কেলেটর লাগানো হচ্ছে। যারা বিমানবন্দরের ভিতরে দীর্ঘপথ হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোয় বেশি যাত্রী প্রবাহের জায়গায় এ এস্কেলেটরগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি যাত্রীদের মসৃণ যাত্রার অভিজ্ঞতা দেবে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল তৈরি হবে মেট্রারেলের পৃথক একটি স্টেশনও। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের না হয়েই মেট্রোরেলে রাজধানীর বিভিন্ন অংশে ঘুরতে পারবেন। এছাড়া ঢাকার যে কোনো স্টেশন থেকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে সরাসরি বিমানবন্দরে বহির্গমন এলাকায় প্রবেশ করতে পারবেন। বিমানবন্দরকে বলা হয় দেশের আয়না। বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, বিশিষ্টজন, পর্যটক, বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে ভ্রমণে বা ব্যবসায়িক কাজে গেলে বিমানবন্দরে নেমেই তারা দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝে ফেলেন। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনীতির চিত্র বিমানবন্দরেই ফুটে ওঠে। ফলে বেশির ভাগ দেশ নিজেদের রুচিবোধ তুলে ধরার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। টার্মিনালের চারপাশের দৃশ্যপট দেখে মুগ্ধ হবেন যাত্রীরা। বিদেশিরা এয়ারপোর্টে নামলেই গোটা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা পাবেন। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, এই মেগা প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এই বিমানবন্দরের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। বাকি ১০ শতাংশ কাজ শেষ হলে যাত্রীসেবার মান আমূল বদলে যাবে। নতুন টার্মিনালের সঙ্গে বিমান ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং যাত্রীদের সুবিধা বাড়বে। করোনার সময়ও টার্মিনালের নির্মাণকাজ থামেনি। থার্ড টার্মিনাল হচ্ছে অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়)। এতে যাত্রী ও কার্গোর ধারণ ক্ষমতা অনেক বাড়ছে। টার্মিনালের উত্তর পাশে আলাদা আমদানি-রপ্তানি কার্গো ভিলেজ ভবন করা হয়েছে। পৃথক কার্গো ভিলেজগুলো বিশ্বের উন্নত দেশের বিমানবন্দরের মতো সর্বাধুনিক সুবিধাসংবলিত। এটি প্রায় ৬৩ হাজার স্কয়ার মিটারের। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের বর্তমান ধারণক্ষমতা ২ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন। তৃতীয় টার্মিনালে এর ধারণক্ষমতা গিয়ে ঠেকতে পারে ৪ মিলিয়ন টনে। নতুন এই কার্গো ভিলেজ দেশের রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করবে। ২০২৪ সালের শেষে সব কাজ শেষে যাত্রীরা এই টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবেন। তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর শুরু হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এবং বাকি ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। নির্মাণ কাজ করছে জাপানের মিৎসুবিশি, ফুজিটা ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং। প্রকল্পের ব্যয় ২০০ কোটি বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ব্যয় বাড়েনি। তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজ পেতে যাচ্ছে জাপান। টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে একসঙ্গে মোট ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। ১৫টি নতুন বিদেশি এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যাত্রীদের জন্য কাস্টমসের জন্য একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল থাকছে। টার্মিনালটিতে ৩৬৫০ বর্গ-মিটার এলাকা থাকছে ভিআইপি যাত্রীদের জন্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে