বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আলেহো কার্পেন্তিয়ের সাহিত্যকর্ম

জ্যোতির্ময় ধর
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আলেহো কার্পেন্তিয়ের সাহিত্যকর্ম
.

লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে 'রিয়ালিসমো মাহিকো' বা জাদু-বাস্তবতার অন্যতম প্রবক্তা 'আলেহো কার্পেন্তিয়ের'। ১৯৩১ সালে স্প্যানিশ ভাষায় রচিত 'একুয়ে-ইয়াম্বা-ও' (হোক প্রভুর প্রশংসা) উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্যে তার আবির্ভাব। ১৯০২ সালে কার্পেন্তিয়েরের ফরাসি বাবা ও রুশ বংশদ্ভূত মা চলে আসেন কিউবাতে আলেহোর জন্মের ঠিক দু'বছর আগে। স্পেনীয় উপনিবেশের হাত ছাড়িয়ে কিউবা তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। কিউবার কালো মানুষের জাদু-আবহে ডুব দিয়ে আফ্র-কিউবান সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের লেখনীর মাধ্যমে। তিনি শুধু একজন ঔপন্যাসিকই নন, একজন সঙ্গীততত্ত্ববিদও বটে। লিখেছেন কিউবার সঙ্গীতের ইতিহাস। তার লেখা 'লা মুজিকা এন কুবা' (কিউবার সঙ্গীত-১৯৫৬) সমগ্র লাতিন আমেরিকার একটি মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা পায়। কিউবাকে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক করে তোলার স্বপ্নে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। কিউবার ১৯২৩-এর বিদ্রোহী প্রজন্মের সক্রিয় কর্মী ছিলেন কার্পেন্তিয়ের। ১৯২৩-এর প্রজন্ম চেয়েছিল কিউবার জাতীয় সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে বিপস্নব ঘটাবে। তাদের লক্ষ্য ছিল একনায়ক হেরারদো মাচাদোর অপসারণ। এ সময় তিনি একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে 'লা দিসকুসিয়ন' পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখার কারণে ১৯২৮ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। ১৯৩৩ সালে গণঅভু্যত্থানে একনায়ক মাচদো বাহামাসে পালিয়ে গেলে কিউবার ক্ষমতা চলে যায় মার্কিন মদতপুষ্ট আরেক স্বৈরশাসক 'বাতিস্তার' হাতে। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রো, চে'দের নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কিউবায় মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরতন্ত্রই বহমান ছিল। ১৯২৮ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যান এবং প্যারিসে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে গুয়েতমালার ঔপন্যাসিক আস্থরিয়াসের সঙ্গে, পরে যিনি ১৯৬৭ সালে প্রথম লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান। প্যারিস থেকে কার্পেন্তিয়ের প্রায়ই আসতেন মাদ্রিদে, সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত কবি গার্সিয়া লোরকার। ১৯৩৯-এ কিউবার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয় দেশে ফিরে কার্পেন্তিয়ের আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিতে শুরু করেন। কিন্তু বাতিস্তা সরকারের স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তার ওপর আক্রমণ নামে এবং তিনি এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশান্তরী হতে বাধ্য হন ভেনেজুয়েলাতে। ১৯৪৫ থেকে কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবা বিপস্নবের সময় (১৯৫৯) পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এই দেশান্তরেই লেখা হয় তার প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস 'এল রেইনো দেল এস্তে মুনদো' (এই পৃথিবীর রাজত্ব ১৯৪৯)। ফরাসি উপনিবেশ হাইতির আফ্রিকান ক্রীতদাস বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে কার্পেন্তিয়ের ধারণা দিলেন লাতিন সাহিত্যের এক নতুন ধারার 'লো রিয়াল মারাবিয়োসো' অর্থাৎ 'আশ্চর্য সুন্দর বাস্তব'। ঐতিহাসিক পটভূমিতে বাস্তব এবং কল্পনার মিলনে যুদ্ধ, বিদ্রোহ এবং প্রেমের কাহিনী। অনেকের মতে আলেহো কার্পেন্তিয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম 'লোস পাশোশ পেরদিদোস' (হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ-১৯৫৩)। হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ পড়ার পর মনে হতে পারে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন লাতিন আমেরিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্টির মেলবন্ধন। 'মিথ' ও ইতিহাস একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন। এই গ্রন্থে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সভ্যতা এবং খ্রিষ্টধর্মের প্রসঙ্গ এসেছে। 'গেররা দেল তেইমপো' (সময়ের যুদ্ধ-১৯৫৮) তিনটি গল্পের সংকলন। এই গল্পগুলোতে জাদু-বাস্তবতার এক জটিল জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একই সালে প্রকাশিত আরেকটি উপন্যাসের নাম 'এল আকোসো' (পিছু ধাওয়া)। এই উপন্যাসে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন একনায়ক 'মাচাদো'-এর রাজত্বে তৎকালীন কিউবা থেকে একজন নিরীহ ও সচ্ছল মানুষের শরণার্থী হওয়ার করুণ কাহিনী। ১৯৬২ সালে লেখা উপন্যাস 'এল সিগলো দে লাস লুসেস' (আলোর শতাব্দী) আন্তিঈয়াস অঞ্চল (মানে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহৎ দ্বীপগুলোর একটি দলকে বোঝায়, যার মধ্যে কিউবা, পুয়ের্তো রিকো, জামাইকা, হাইতি, ডোমেনিকান রিপাবলিক) এ ফরাসি বিপস্নবের প্রভাব নিয়ে লেখা কাহিনী। পরবর্তী উপন্যাসের শিরোনাম 'এল দেরেচো দে আসিলো' (আশ্রয়ের অধিকার ১৯৭২)। সত্তরের দশকে স্প্যানিশ আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস, উলিস্নখিত বিষয় হলো, সেই সময়ের বিশিষ্ট লেখকরা এই বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন- যার মধ্যে গাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেস অন্যতম। 'কনসারতো বারোকো' (ব্যারোক কন্সার্ট-১৯৭৪) লিরিক আর সঙ্গীতময়তায় প্রাণবন্ত এক সংক্ষিপ্ত উপন্যাস। 'লা কনসাগ্রাসিওন দে লা প্রিমাভেরা' (বসন্তের আরাধনা-১৯৭৮) কিউবার বিপস্নব নিয়ে লেখা কাহিনী। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ সংকলন যেমন 'লাতিন আমেরিকার সাহিত্য এবং রাজনৈতিক বিবেক' (১৯৬৯), 'শহর ও স্তম্ভ' (১৯৭০), বিবিধ প্রবন্ধ (১৯৮৩)- যা কিউবা ও লাতিন আমেরিকার সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করে। বাংলার পাঠকদের কাছে আলেহো কার্পেন্তিয়ের জনপ্রিয়, বিখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত তার 'এল সিএরবো এরিদো' (মৃগয়া) উপন্যাসটির জন্য। এই উপন্যাসটি পঞ্চাশের দশকে কিউবার স্বেচ্ছাচারী একনায়কদের রাজত্বের চালচিত্র। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ সালের দুই দশকব্যাপী লাতিন আমেরিকার গদ্য-সাহিত্যে অনন্য সম্রাট ছিলেন আলেহো কার্পেন্তিয়ের। কার্পেন্তিয়ের ১৯৮০ সালে প্যারিসে মৃতু্যবরণ করেন এবং কিউবার রাজধানী হাভানার কোলন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে