সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ বীজ কৃষকের জীবনমান বদলাচ্ছে 

সাইদা আক্তার ইমা, ফরিদপুর
  ১৬ মার্চ ২০২৪, ১২:৪০
পেঁয়াজ বীজ কৃষকের জীবনমান বদলাচ্ছে 

পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে বের হয়ে কালো দানা বা বীজ, যার বাজার দর আকাশ ছোঁয়া। তাই একে বলা হয় কালো সোনা। একটা সময় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর থাকলেও দিনে দিনে দেশে এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে সারাদেশে পেঁয়াজ বীজের যে চাহিদা তার ৫০ শতাংশ যোগান দেয় ফরিদপুরের চাষীরা।

চলতি মৌসুমে এ জেলার চাষীদের সবমিলিয়ে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন প্রায় তিনশো কোটি টাকার বাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও প্রাকৃতিক পরাগায়নের অভাবে এবার আবাদের তুলনায় পেঁয়াজ বীজের উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। সরেজমিনে কৃষকদের সাথে কথা বলে ও কৃষি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে এ তথ্য।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলায় পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে ১৮শ' ৯০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে প্রায় সাড়ে ৭ মেট্রিকটনেরও বেশি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এবার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে জেলা সদরে প্রায় ২০৮ হেক্টর জমিতে।

গত বছর ফরিদপুর জেলায় ১ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছিলো। গতবারের তুলনায় এবছর আবাদের পরিমাণ বেড়েছে। ভাল লাভ পাওয়ায় এই ফসলের দিকে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। এছাড়া সরকারের বিশেষ তদারকি থাকায় স্থানীয় কৃষি দপ্তরও এই পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে।

ফরিদপুরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকার লাভলি আক্তার ও ইমতাজ মোল্লা দম্পত্তি গত একযুগ ধরে পেঁয়াজ বীজ চাষাবাদ করছেন। দুই বিঘা দিয়ে শুরু করে এখন তারা জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ৪০ বিঘা জমিতে এবছর পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছেন। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো এক সময় তাদের। কিন্তু এখন এই পরিবার কোটিপতি। নিজস্ব জমিতে তাদের পাকা ইমারতে বহুতল ভবনে যেমন জৌলুস বেড়েছে, তেমনি জীবনযাপনে এসেছে ঊর্ধ্বমুখি পরিবর্তন। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়ে নিয়ে এখন তাদের ব্যয়বহুল সংসার। যা এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের বদৌলতে তাদের কাছে ধরা দিয়েছে। প্রতিবছর তারা উপার্জনের টাকায় নিজেদের স্থাবর সম্পত্তিও বাড়াতে পারছে। নতুন করে কিনছে জায়গাজমি।

জীবন বদলে যাওয়ার মতো এই অনুপ্রেরণার গল্প জানা যায় লাভলি আক্তারের মুখে। তিনি বলেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখি শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পেঁয়াজ বীজের চাষ করছেন। তিনিও স্বামীকে সহায়তায় নামেন। এতে প্রথম বছরেই ভালো আয় হয় তাদের। এরপর আর থেমে থাকেননি।

লাভলী আক্তার বলেন, "আমি এই বীজের টাকা দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে বিল্ডিং দিয়েছি। প্রতিবছরই নতুন জমি কিনছি। এক সময় যা ছিলো অকল্পনীয়, এখন তাই বাস্তব আমাদের কাছে।"

লাভলী জানান, আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার তারা বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই মণ পেঁয়াজ বীজ পাবেন বলে আশা করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে এই বীজের আবাদ করতে এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। সেই হিসাবে সবমিলিয়ে তাদের এবার প্রায় কোটি টাকার মতো লাভ থাকবে বলে তারা আশা করছেন।

ফরিদপুর সদর কৃষি অফিসার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বরাবরই ফরিদপুরের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ বীজের আবাদের উপযোগী হওয়ায় আগা গোরাই এখানে বীজের ব্যাপক আবাদ হয়। মূলত ফরিদপুরে ৩ ধরনের পেঁয়াজ আবাদ হয়। সারা দেশের মধ্যে বীজের আবাদে ফরিদপুর সব সময় এগিয়ে। দেশের চাহিদার ৫০ শতাংশ বীজ যায় এই জেলা থেকেই।

বীজ চাষীরা জানালেন, এবছর মৌমাছির অভাবে এই পেঁয়াজ বীজের গাছে পরাগায়নের মাত্রা কমে এসেছে। নিরুপায় কৃষক হাতের তালু বুলিয়ে এক ফুলের রেণুর সাথে আরেক ফুলের রেণুর পরাগায়নের পন্থাও বেছে নেন অনেক ক্ষেতে। কিন্তু এতে প্রাকৃতিক পরাগায়নের মতো ভালো ফলন হয়নি। আর তাই গত বছরের চেয়ে কিছু বেশি জমিতে চাষ হলেও এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদন কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সুযোগে ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানিরও আশঙ্কা রয়েছে। তবে কৃষকেরা জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানি করা হলে তা সার্বিকভাবেই ক্ষতি ডেকে আনবে। কারণ, ভারত থেকে আনা পেঁয়াজ বীজ নিম্নমানের। তাতে ভালো ফলন হয়না।

পেঁয়াজ বীজ আবাদে ছোট্ট শিশু প্রতিপালনের মতোই যত্নশীল থাকতে হয়। কোন রকম অযত্ন হলে ফলন নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষেতে বীজের আবাদ শুরু হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে আর ফলন পাওয়া যায় এপ্রিল-মে মাসের দিকে। ক্ষেত থেকে তোলার পর একবছর এই বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ পরবর্তী বছরে গিয়ে কৃষকরা এই বীজটি সংগ্রহ করে ক্ষেতে বপন করে। কালো সোনা খ্যাত এই পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ করে জীবনের গল্প বদলে নিয়েছেন ফরিদপুরের দরিদ্র কৃষকেরা। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পেরেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কৃষকদের স্বার্থে কৃষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে এমনটিই প্রত্যাশা পেঁয়াজ বীজ চাষীদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দাম ভাল পাওয়ায় এবছর আমাদের লক্ষমাত্রার চেয়েও বেশী পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে জেলার কৃষকরা এবার সাড়ে ৭ মেট্রিকটন বীজ উৎপাদন করবে। যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলার পেঁয়াজ বীজ চাষীদের সমস্যা নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাদের সকল ধরনের পরামর্শ সহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা করে আসছে। এতে তারা দিনে দিনে উন্নতি করতে পারছে এ সেক্টরে।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে