প্রাইমারি এডুকেশন ডিপ্লোপমেন্ট প্রজেক্ট (পিইডিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে বগুড়ায় প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যায়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ওয়াশ বøকের কাজ চলমান রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল। চলমান এই কাজে ইতিমধ্যে নানা অনিয়মের অভিযোগে উঠেছে।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বগুড়ায় ৭০০টি ওয়াশ ব্লকের অনুমোদন হয়, এরমধ্যে ৫০০ টির কাজ চলমান রয়েছে। চলতি বছরের ২৫শে জুনে কাজের মেয়াদকাল শেষ হবে কিন্তু কোথাও কোথাও সবেমাত্র কাজ শুরু হয়েছে। যেগুলো নির্মানে আরো অন্তত বছর খানেক সময় লাগবে। আবার বিভিন্ন জায়গায় কাজ শেষ না হতেই ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে।
চলমান এই নির্মানাধীন কাজে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে নামে যায়যায়দিন। কয়েক মাসের অনুসন্ধানে প্রায় শতাধিক বিদ্যালয় ভিজিট করে, উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসময় দেখা মেলে চোখ কপালে ওঠার মতো অনিয়ম। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চামুরপারা, কাশিহাটা, তেলিহাটা পাচানি পারা, বৈঠাভাংগা উত্তরপাড়াসহ অসংখ্যা বিদ্যালয়ের নির্মান কাজে প্রথম তলার মেঝে ঢালাই দেয়া হয়েছে রড ছাড়া।
এছাড়া চকরাধিকা, জাগুলি, একবারিয়া, পাচকাতলীসহ অসংখ্য বিদ্যালয়ের ২য় তলায়, নামে মাত্র রড দিয়ে ঢালাই দেয়া হয়েছে। অনিয়ম এখানেই শেষ নয়, চলমান এই কাজের ইষ্টিমেটের সাথে কোনোই মিল নেই। মেঝেতে আর,সি,সি ঢালাইয়ের পরিবর্তে দেয়া হয়েছে সি.সি ঢালাই তাও আবার রড ছাড়া বিট বালু দিয়ে। লো-ডাউন সিরামিকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের প্লাষ্টিক, ছাদে দেয়া হয়নি জল ছাদ, যথাযথভাবে হয়নি বিল্ডিংয়ের এপ্রোন।
এছাড়া দরজা, জানালাসহ সকল সামগ্রীই দেয়া হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের। এতে করে নির্মান শেষ হবার আগেই ভবনে ফাটল ধরেছে, কমপ্লিট মেঝেগুলোতে পানি জমেছে, টয়লেটের কুপ, স্লাবসহ সেফটি ট্যাংকিগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিদ্যুতের ওয়েরিং এর ভেতর দিয়ে পানি আসতে শুরু করেছে, এতে করে যে কোনো সময় সম্পূর্ণ ওয়াস ব্লকে বিদ্যুতায়িত হয়ে শিশুদের প্রাণহানি ঘটতে পাড়ে।
অর্থাৎ চরম অনিয়মে নির্মান হচ্ছে এসব ওয়াশ ব্লক। বগুড়া সদরের চকহবিবের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘটেছে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এখানে ওয়াশ ব্লক নির্মানের জন্য ২০২৪ সালে গর্ত খুরে রাখে, এর পর রমজান মাসে ওই গর্তে পানি জমলে সেখানে খেলতে নেমে দের বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিষয়টি বেশ আলোচিত হলেও অর্থের কাছে হেড়ে যায় অসহায় ওই পরিবার। এক পর্যায়ে ধামাচাপা দেয়ার জন্য মিমাংশা করতে বাধ্য করা হয়।
প্রকল্পটির ইষ্টিমেটে উল্লেখ আছে, সুনামধন্য কোম্পানীর অধিক মজবুদ মানের ২৭ কেজি ওজনের ৭,৫০০ টাকা মূল্যের সলিড পিভিসি দরজা লাগানোর কথা থাকলেও, (শত-শত) অর্থাৎ সবগুলো দরজাই দেয়া হয়েছে নিম্নমানের মাত্র কয়েকহাজার টাকা মূল্যের ফাঁপা দরজা। টয়লেটে ফ্লাস করার জন্য সিরামিকের লোডাউন উল্লেখ থাকলেও সবগুলোই দেয়া হয়েছে প্লাষ্টিকের, যা লাগানো শেষ না হতেই খুলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেপটিক ট্যাংকি আকারে ছোট করা হয়েছে। ইট, রড, সিমেন্টসহ সবধরনের সামগ্রী দেয়া হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের। মোটা বলুর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে বিট বালু।
বিদ্যালয়গুলোতে পৌছে প্রধাণ শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, নৈশপ্রহরী কাম দপ্তরিসহ স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বললে তারা জানায়। এই কাজ শুরু হয়েছে আওয়ামী শাসনামল থেকেই, ওই সময় লীগ নেতাদের তান্ডব ও টেন্ডাবাজির কারনে, কাজের শুরুই হয় অনিয়ম দিয়ে। তখন কেউ মুখ খুলতে পাড়েনি। এখনো একই অবস্থা বর্তমানে বিএনপির বিভিন্ন নেতারাও একই ধরনের ব্যবহার করছে, তাদেরকে কিছুই বলা যায়না। বলতে গেলে নানা ধরনের ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়। যার কারনে বাধ্য হয়ে নিরবেই মেনে নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিবাদের পরিবর্তে শিক্ষকদেরকে শাসিয়ে যায়। তারা বলেন কাজ যেরকম হোক ওই দায়িত্ব আমাদের নয়, বরং জুন মাসের মধ্যেই কাজ বুঝে নিতে হবে।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ রেজোয়ান হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন। আমরা বরাবরই বিভিন্ন উপজেলারয় নির্মানাধীন ওয়াশ ব্লকগুলো ভিজিটের কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন কোথাও কোথাও কাজ ভালো হচ্ছে আবার কোথাও কোথাও একেবারেই নিম্নমানের হচ্ছে। আমরা অভিযোগও দিচ্ছি বিভিন্নস্থানে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা চাই শিশুদের ব্যবহারের কাজ যথাযথভাবে করা হোক।
বগুড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়ার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এসব ভিজিট করা আসলে আমার কাজ নয়। ওগুলো উপজেলা প্রকৌশলী যারা রয়েছে তাদের কাজ, আমার কাজ এই অফিসে ওসব তদারকি করার মতো সময়ও আমার নেই। তাই এ বিষয়ে নিউজ হলেও আমার কোনো বিপদ নেই, বিপদে পরলে উপজেলারগুলো পরবে। কথা বলার সময় তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের বিএনপির নেতা কর্মীদের পরিচয় দেন এবং তাদের সহযোগিতা আছে বলেও জানায় এই কর্মকর্তা। বিভিন্ন মহলকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম কিবরিয়া বলেন, টাকা দেয়ার বিষয়টি আমি জানি কিন্তু আমি দেইনি ওই টাকা, দিয়েছে ঠিকেদার।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আজই জনস্বাস্থ্য প্রোকৌশল বিভাগের সাথে কথা বলে দ্রæত সময়ের মধ্যেই বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, অভিযোগ উঠেছে প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া যোগদানের পর থেকেই এই দপ্তরকে নিজের মতো তৈরি করে নিয়েছে। তার বাহীরে কোনোও কাজ করা সম্ভব নয়, সকল ঠিকেদারদেরকে তিনি জিম্মি করে ফেলেছেন। তার নির্দেশের বাহিরে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। এসব নানা কারনে বেশ কয়েকজন ঠিকেদার তার বিরুদ্ধে, দপ্তর বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন, যার তদন্ত বর্তমানে চলমান রয়েছে।