শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুই টাকার তালের শাঁস টাঙ্গাইলের বাজারে ৩০ টাকায় বিক্রি!

স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল
  ২৮ মে ২০২৫, ১৬:৪৪
দুই টাকার তালের শাঁস টাঙ্গাইলের বাজারে ৩০ টাকায় বিক্রি!
ছবি : যায়যায়দিন

গাছে থাকা দুই টাকার তালের শাঁস টাঙ্গাইল শহরের খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকায়। শহরের নারী-পুরুষ কিংবা শিশু-বৃদ্ধ ক্রেতারা শাঁস কিনতে ভির করছেন। পাড়া-মহল্লা ও সড়কের মোড়ে মোড়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। তীব্র গরমে প্রাণ জুড়ানো পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল হিসেবে তালের শাঁস বা কোষ কিনছেন ক্রেতারা।

সরেজমিনে জানা যায়, গ্রীষ্মকালই ‘তালের শাঁস বা কোষের মৌসুম’। টাঙ্গাইল শহরের কলেজ গেট, হাইস্কুল গেট, আদালত চত্বর, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, বাসটার্মিনাল, বেবীস্ট্যান্ড সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন কাঁচা তাল ও তালের শাঁস বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন শ’ শ’ তাল নিয়ে বিক্রি করতে বসছেন শামসুল হক, আব্দুল রহিম, এখলাস মিয়া, মনু মিয়া, শাজাহানসহ অনেক মৌসুমি খুচরা ব্যবসায়ী। প্রতিটি কাঁচা তাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায় এবং ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি শাঁস বা কোষ। তবে সুস্বাদু তালের শাঁসের স্বাদ নিতে ক্রেতাদের কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

1

শহরের খুচরা ব্যবসায়ী শামসুল হক, আব্দুল রহিম, শাজাহানসহ অনেকই জানান, টাঙ্গাইলে খুব বেশি তাল পাওয়া যায় না। কাঁচা তাল বেশির ভাগই সাতক্ষীরা, ফরিদপুর ও নাটোর থেকে আসে। ট্রাকভর্তি তাল নিয়ে পাইকারী ব্যবসায়ীরা সপ্তায় দুইদিন ময়মনসিংহ রোডের সিঅ্যান্ডবি অফিসের ওখানে আনলোড করে। তারা তুলনামূলকভাবে যার কাছে কম দামে পান তার কাছ থেকে কিনে নেন। আকার ভেদে(দুই বা তিন কোষ) প্রতিটি তাল ৮-১০ টাকা দরে কিনে খুচরা বাজারে ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি করেন। গরম বেশি থাকলে সারাদিনে ৩০০-৪০০ পিস তাল বিক্রি করা যায়। এতে খরচ বাদে ভালোই লাভ থাকে।

পাইকারী তাল ব্যবসায়ী সাতক্ষীরার মো. মিজানুর রহমান জানান, বছরে কিছুদিন তালের ব্যবসা করা যায়। সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঁচাতাল প্রতিগাছ ২০০-৩০০ টাকায় কিনে স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে আকার ভেদে প্রতিপিস ৪-৫ টাকায় বিক্রি করে। স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রতিপিস তাল গড়ে দুই টাকায় কিনে থাকেন। উঁচু গাছ থেকে তাল পাড়া, নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত নিয়ে আসতে গাড়িভাড়া ও লেবার খরচও তাদের গুণতে হয়। ফলে সাতক্ষীরা থেকে ট্রাকভাড়া করে টাঙ্গাইল পর্যন্ত আনতে প্রতিপিস কাঁচা তাল ৬-৭ টাকা খরচ পড়ে। তারা টাঙ্গাইলের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিপিস তাল আকার ভেদে(দুই বা তিন কোষ) ৮-১০ টাকা বিক্রি করে থাকেন।

কাঁচা তালের(শাঁস বা কোষ) ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় টাঙ্গাইশ শহরের মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও যোগ দিয়েছেন। এমনই একজন টাঙ্গাইল শহরের আদালত পাড়ার বাসিন্দা মো. নাসির মিয়া জানান, কাঁচা তালের ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এ ব্যবসায় নেমেছেন। তিনি ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সরাসরি তালবাগান বা তালগাছের মালিক বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাল কিনে থাকেন। গাছের নিচ থেকে আনুমানিক হিসাব করে প্রতিটি গাছ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনেন। কাঁচা তাল গাছ থেকে কেটে নামাতে শ্রমিকদের দিতে হয় গাছপ্রতি দেড়শ’ টাকা।

এরপর ফরিদপুর থেকে টাঙ্গাইল শহর পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া। সব মিলিয়ে প্রতিপিস কাঁচা তাল ৪-৫ টাকা খরচ পড়ে। প্রতিপিস ৮-৯ টাকায় বিক্রি করেন। টাঙ্গাইলে তালের আমদানী বেশি হলে খুচরা ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাকি নিয়ে মূল চালান(পুঁজি) খেয়ে ফেলে। সম্প্রতি প্রচুর তাল আমদানী হওয়ায় প্রতিপিস ৭-৮ টাকায় কেনা তাল ৬ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

তাল কিনতে আসা শহরের বাসিন্দা রজব আলী জানান, আগে অনেক তাদের বাড়িতে তাল গাছ ছিল। পাকা তালের রস দিয়ে পিঠা-পায়েস বানানো হতো। এখন গাছই নেই। শুধু কাঁচা শাঁস বা তালের কোষ খেয়ে স্বাদ মিটাই। কিছুদিন পর হয়তো এটাও পাওয়া যাবে না। অপর ক্রেতা রহিমা রহমান জানান, তাল বা এর শাঁস খুবই উপকারী মৌসুমি ফল। তাল গাছ কমে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। তিনি তালের স্বাদ ও গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে অন্তত একটি করে তালগাছ লাগানোর অনুরোধ করেন।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক মো. আশেক পারভেজ জানান, তালের শাঁস বা কোষ খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এতে ভিটামিন এ, বি, সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ নানা উপাদান রয়েছে। তালের রস দিয়ে পিঠা-পায়েস, মিছরি, গুড় ইত্যাদি তৈরি হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের অবহেলায় তাল গাছ কমে যাচ্ছে। প্রতি বছরই তারা তালগাছের চারা রোপন করেন। একটি তালগাছ পরিপক্ব হতে ১০-১২ বছর সময় লাগে।

গ্রামীণ রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নতুন রাস্তা নির্মাণের কারণে অনেক সময় রোপনকৃত তালগাছের চারা নষ্ট হয়ে যায়। আরও পরিকল্পিতভাবে তালগাছের চারা রোপণ করতে হবে।

তিনি আরও জানান, তালগাছ বছরে একবার ফল দেওয়ায় লাভ তুলনামূলক কম। সে কারণে মানুষ তালগাছ কেটে কাঠ পাওয়া যায় এমন গাছ রোপণে আগ্রহী হচ্ছে। তালগাছের চারা তৈরি করতেও প্রায় এক বছর সময় লাগে। তাই নার্সারিগুলো তালগাছের চারা তৈরি করতে চায় না। অথচ এই গাছ বজ্রপাত নিরোধে, ভূমিক্ষয় রোধে এবং ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে