শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি আঁকাশের সোনালি সম্ভাবনা

অবিভক্ত বাংলায় পাটের বণর্ময়, উজ্জ্বল ও সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে এবং এ অঞ্চলে শিল্পযুগের সূচনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও পূবর্বঙ্গে পাটকল স্থাপনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের পূবর্ ও পশ্চিম অংশের ভেতর যে বৈষম্য ছিল পাট খাতে তার প্রকাশ ছিল স্পষ্ট। ৬৮টি পাটকলের মধ্যে ৩৪টির মূল মালিক ছিল অবাঙালি আর এ কলগুলোতে ছিল মোট পাটশিল্পের ৬৮ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা। ফলে ৬৬ শতাংশ বিনিয়োজিত পঁুজি ছিল অবাঙালির হাতে। পূবর্ বাংলার পাটের টাকায় সমৃদ্ধ হতে থাকে করাচি, পিন্ডি ও ইসলামাবাদের রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও বড় বড় ইমারত। ফলে ১৯৬৬ সালের ৬ দফার পঞ্চম দফাটি ছিল ‘অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অজির্ত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে এবং এর নিধাির্রত অংশ তাদের দিতে হবে’ অথার্ৎ পূবর্ পাকিস্তানের পাট থেকে অজির্ত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য দাবি উত্থাপিত হয়েছে যা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। লিখেছেন কৃষিবিদ মো. আল-মামুন
নতুনধারা
  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৪৪

পাট কেবল আমাদের সোনালি অঁাশ নয়, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের এক সোনালি অধ্যায়। ২০১৭-১৮ অথর্বছরে কঁাচাপাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ১০২ কোটি ৫৫ লাখ মাকির্ন ডলার। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ২২টি এবং বেসরকারি খাতে প্রায় ২০০টি পাটকল চালু রয়েছে। বতর্মানে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও পাটপণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল পাটজাত ব্যাগের চাহিদা ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া দেশে অন্যান্য পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭১৬.৫২ কোটি টাকার। পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছেÑ যা থেকে তৈরি হচ্ছে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট। প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠির অধের্কও যদি সঠিকভাবে চারকোল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তবে তা থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অজর্ন করা সম্ভব। এ ছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নিদির্ষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভ‚মিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবঁাধ নিমার্ণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। ভেষজ হিসেবে পাটপাতা বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চা’য়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) পাটের পাতা দিয়ে অগাির্নক চা উৎপাদন শুরু করে এবং বতর্মানে ঢাকার উত্তরায় গুয়াছির্ অ্যাকুয়া অ্যাগ্রো টেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান পাটের পাতা দিয়ে তৈরি অগর্্যানিক চা জামাির্নতে রপ্তানি করছে। সম্প্রতি পাটের পাতা থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন সবুজ চা উৎপাদন বড় পরিসরে শুরু করতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। অঁাশ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্য তেল এবং মেস্তার মাংসল বৃতি (শঁাস) থেকে জ্যাম, জেলী, জুস, আচার, চা ইত্যাদি প্রস্তুতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাটে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সেলুলোজ রয়েছে। পাট থেকে পাল্প তৈরি করে পুনরায় সেলুলোজ রি-জেনারেট করে ভিসকস তৈরি করা সম্ভব। আর এই ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা বাংলাদেশের অথর্নীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূণর্, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাটখড়ি হতে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাটের তৈরি বিশেষ সোনালি ব্যাগ ও পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশি- বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকষর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকঁাথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিঁকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পদার্র কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নিমার্ণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোটর্স শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সবর্ত্র জনমত তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া জাতিসংঘ কতৃর্ক ২০০৯ সালকে ‘আন্তজাির্তক প্রাকৃতিক তন্তু বষর্’ হিসেবে পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর কদর আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুবাদে পাট ও পাটজাত পণ্যের হারানো চাহিদা পুনরুদ্ধার হতে থাকে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কাবর্ন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কাবর্ন ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। সাম্প্রতিক ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝঁুকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এ ক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতিমাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক অঁাশের তৈরি ব্যাগের প্রয়োজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বজের্্যর সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বিশ্বে বতর্মানে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে। পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্ধুদ্ধকরণে পাট আইন, ২০১৭ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। পাটচাষীদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ১৬টি বাণিজ্যিক বাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমদানি নিভর্রতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভতুির্ক প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পাটকল মালিকদের অনুরোধে সরকার তিন ধরনের কঁাচা পাট রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেÑ যা পাটশিল্পের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে ঢাকার বুকে তেজগাঁওয়ে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) প্রায় ২৫০ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদশর্নী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাট চাষিদের পাটের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর পরিচালনাকারী সংস্থা বিজেএমসি গত মৌসুমে ১ হাজার কোটি টাকার পাটঅঁাশ ক্রয় করেছে। রপ্তানিমুখী পাটপণ্য বহুমুখীকরণে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্যিকভিত্তিতে পাট থেকে পলিথিন (জুটপলি) উৎপাদন কাযর্ক্রম শুরু করতে যুক্তরাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফুটামুরা কেমিক্যালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী বলে পাট চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অজর্ন করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নিভর্রশীল। জাতীয় ও আন্তজাির্তক বাস্তবতায়, পরিবতির্ত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট অঁাশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেহেতু বিশ্বসেরা পাট বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, সেহেতু পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সরকারি পাটকলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজারমূল্য নিধার্রণ করা যেতে পারে। মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আন্তজাির্তক বাজারে স্বদেশী পাটপণ্যের কাযর্কর ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের সোনালি অঁাশের সোনালি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। লেখক: পিএইচডি স্কলার, ইউনিভাসিির্ট পুত্রা মালয়েশিয়া, সেলানগর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে