শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থালোচনা

নতুনধারা
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

নিবাির্চত কবিতা

তিন দশক ধরে লেখালেখি করছেন সালাম সালেহ উদদীন। প্রথম দিকে কবিতা লেখা শুরু করলেও পরে ঝুঁকে পড়েন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কলামের দিকে। একজন সুপ্রতিষ্ঠিত গদ্যকার হিসেবেই সাহিত্যাঙ্গনে তার দৃপ্ত পদচারণা। কিন্তু দীঘর্ বিরতি দিয়ে আবার তিনি সগৌরবে ফিরে এসেছেন কবিতায়। ২০১৯ সালের একুশে বইমেলায় ছায়াবীথি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতার বই :‘নিবাির্চত কবিতা’। প্রায় দুইশ’ কবিতা অন্তভুর্ক্ত হয়েছে এই সংকলনে। গদ্যমগ্ন হলেও কবিতাকে তিনি ভেতরে ভেতরে লালন করেছেন দীঘির্দন ধরে। যাপিতজীবনের বিচিত্র অনুভব, প্রেম-বিরহ, মানব মনস্তত্ত¡, নারী-পুরুষের সম্পকের্র নিবিড়তা, অন্তগর্ত টানাপড়েন, আনন্দ-বেদনার অনুভবময় জগৎ উন্মোচিত করেছেন কবিতায়। ‘তার কবিতায় উঠে এসেছে মানুষের ভেতরের মানুষ, বাস্তবতার ভেতরে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা।’ [বইয়ের ফ্ল্যাপ] শুধু তাই নয় সমাজ ও রাষ্ট্রে অসঙ্গতি বা অনিয়মের ফলে ব্যক্তির অন্তদর্হনের তীব্র অনুভব ব্যঞ্জনাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। কবিতার ভাবময় জগতে ডুব দিয়ে সুলুক সন্ধান করেছেন নান্দনিক ঐশ্বযের্র। উপমা প্রয়োগ, চিত্রকল্প নিমাের্ণ দেখিয়েছেন পারঙ্গমতা। তার পরাবাস্তব সিরিজের দশটি কবিতায় শিল্পসফল উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার পাঠককে বেশ মুগ্ধ করবে। দুটি ভিন্নজাতীয় বস্তুর প্রতি তুলনা বা তাদের মধ্যে সাদৃশ্য নিমার্ণই উপমা। আর চিত্রের সঙ্গে কল্পনার সংযোগ ঘটাতে পারলেই তা হয়ে ওঠে চিত্রকল্প। কবিতায় উপমা ও চিত্রকল্প নিমার্ণকৌশলের মধ্যেই একজন কবির কবিত্বশক্তি সম্পকের্ পাঠক অনুধাবন করতে পারেন।

ক. ‘লোভাতুর প্রবীণ চেটে খায় রাতের নেশা/চঁাদের আলো যেন অশরীর যৌন-তাড়না/ তুমি আসবে বলে তুলোর জমিনে অগ্নি-ঝড়/শুরু হয় পানি ফড়িং গিলে ফেলে ডুবন্ত সূযর্/মৌ-মাছির চাক ভেঙে মধু খায় উবর্শী-চঁাদ/রাতের নদী বরফ মানব দৃশ্যমান অজগর/আমরা দুজন পরবাসী-আকাশে হেলে পড়ি/দূর অজানায় যেখানে রয়েছে বাতাস- দেয়াল [পরাবাস্তবতা, এক, পৃষ্ঠা ৯]

খ. শূন্যতার শহরে ধেঁায়ার বসতি গড়ে/ পাবিহীন হেঁটে চলো তুমি এক অদম্য দৌড়বিদ/জনকোলাহল থামিয়ে দেয় রংধনু সাইরেন/গন্তব্য ও সময় চলে গেছে শুভঙ্করের হাতে/পাললিক জীবন ছেনে খায় রাক্ষুসী মাছ/গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন অন্ধকারে নাচে অদৃশ্য নিয়তি/বৃত্তের আকার বাড়ায় বৃত্তবন্দি ঘোরের মানুষ/আদিমতা থেকে অধীনতা স্বাধীনতা সবই ফানুস [পরাবাস্তবতা, পঁাচ, পৃষ্ঠা ১০]

উদ্ধৃত দুটি কবিতায় চমৎকার চিত্রকল্পে তুলে ধরেছেন পরাবাস্তব বোধের অন্তগর্ত যাতনা। পরাবাস্তবতা তা-ই, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো যুক্তিশৃঙ্খলা নেই। এই এক স্বপ্নময় জগৎ। বাস্তবতা ছাড়িয়ে অবচেতন মনের স্বপ্নজাত বিশৃঙ্খলাই পরাবাস্তবতা। অথার্ৎ বাস্তবতাকে অতিক্রম করে, যুক্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অবচেতন মন যখন স্বপ্নময় জগতে বিচরণ করে, বা ঘুরে বেড়ায়, তখনই তা পরাবাস্তব হয়ে ওঠে। বাস্তবে যদিও তা অসংগতিপূণর্, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সংগতিপূণর্। কবি সালাম সালেহ উদদীন পরাবাস্তব চিত্রকল্প নিমাের্ণ সফল। প্রথম কবিতায় লোভাতুর প্রবীণের দখলে চলে গেছে রাতের নারী ও যৌন-উন্মাদনা। ‘রাতের নদী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন ‘বরফ মানব দৃশ্যমান অজগর’-এর। শেষ পঙ্ক্তিতে এসে প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ও হাহাকার পাঠকের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

২য় কবিতায় মধ্যবিত্ত নগরজীবনের ক্লেদাক্ততা, প্রতিনিয়ত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া মানুষের হাহাকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি বেজে উঠেছে। আধুনিক সভ্য জগতেও স্বাধীনতার বুলি মিথ্যে, ফানুসের মতো। আদিমকালের মতো বিত্তবান ও ক্ষমতাশালীদের হাতে স্বাধীনতার নামে শোষিত হচ্ছে পরাধীন, অসহায় মানুষ। পরাবাস্তব সিরিজের বাকি আটটি কবিতাও কবিতাবোদ্ধাদের মুগ্ধ করবে। পরাবাস্তব সিরিজ ছাড়াও এ বইয়ের অধিকাংশ কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্পনৈপুণ্যে উজ্জ্বল। ‘তোমার জয়ধ্বনি’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর উল্লেখ নেই। কিন্তু কবিতাটি পাঠমাত্রই সচেতন পাঠক বুঝতে পারবেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। জীবনের গভীর অনুভবমালা ও সময়কে ধারণ করেছে তার কবিতা। ১১২ পৃষ্ঠার এ কবিতার বইটি আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। বইটির মূল্য ২৫০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন আহমেদ নিলয়।

পালপাড়ার প্রদীপ

কথাসাহিত্যিক শাকির সবুরের প্রাতিষ্ঠানিক সনদী নাম আবদুস সবুর খান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি জাতীয় পত্রপত্রিকায় ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস লেখা শুরু করেন। শাকির সবুরের কথাসাহিত্যে মুগ্ধ হয়ে জনপ্রিয়তায় অদ্বিতীয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, তার একটি উপন্যাসের ভ‚মিকা লিখে দেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটি আত্তীকবন্ধনও গড়ে ওঠে। ছাত্রজীবন থেকেই শাকির সবুর সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক ও লেখক। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত হয়ে তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েন ফারসি কথাসাহিত্যের দিকে। ফারসি কথাসাহিত্যে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ও অনুবাদকমের্ অনন্য নৈপুণ্য দেখিয়ে তিনি ইত্যাবসরে বোদ্ধামহলে সমাদৃত হয়েছেন। ফারসি কথাসাহিত্যে তার মূল্যবান বিশ্লেষণধমীর্ গবেষণা ও অনুবাদকমর্ না থাকলে আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম না, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক ফারসি কথাসাহিত্য তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করে বিশ্বাঙ্গনে কতদূর এগিয়ে গেছে। অধ্যাপনা ও গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ দেয়ার কারণে শাকির সবুর মাঝখানে কিছুদিন ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় নীরব থেকেছেন। তবে আবারও তিনি আপন সৃষ্টিমগ্নতায় ব্রতী হয়েছেন। পালপাড়ার প্রদীপ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নব্বইয়ের দশক থেকে সাম্প্রতিক সময় পযর্ন্ত রচিত মোট বারটি গল্প অন্তভুর্ক্ত হয়েছে এ গল্পগ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের জনমনের গভীরে প্রোথিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-চেতনার বীজ, প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ ও বৈচিত্র্যময় মানবমনস্তত্তে¡র সূক্ষ¥াতিসূ² জটিল অনুভবময় জগৎ তিনি উন্মোচন করার দৃঢ় প্রয়াস চালিয়েছেন পালপাড়ার প্রদীপে। উপাখ্যানের ঘনবদ্ধ বণর্নকৌশল, প্রবহমান সাবলীল বয়ানশৈলী, সমাপ্তিতে সূ² ও তী² ইঙ্গিত তার তিন দশকের সাহিত্যসিদ্ধি ও অভিজ্ঞতারই নান্দনিক প্রতিফলন। বইটি প্রকাশ করেছে শোভাপ্রকাশ। নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন তারিক ফেরদৌস খান। বইটি মেলায় শোভা প্রকাশের ২৪ নম্বর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে।

সমীর আহমেদ

বিবিক্তা

সত্তরোধ্বর্ ‘যুবক’ হাসান মোত্তালিব মিতু ওরফে মতু তার সেলফোনে কল পায় এক অচেনা তরুণীর। আকাক্সক্ষা আর উচ্চাশা তাড়িত ইঁদুর দৌড় জীবনটা হঠাৎই হেঁাচট খায় তার। জীবনের খেরোখাতার পাতাগুলো স্মৃতির মুকুরে চকচকিয়ে ওঠে। তথাকথিত সফল জীবনের অধিকারী মিতু এক অদ্ভুত অথর্হীনতাবোধে আচ্ছন্ন হয়ে পিছনে ফেলে আসা জীবনের দিকে চেয়ে দেখে বিষণœ ধূসর চোখে। মতু এসে দঁাড়ায় মিতুর সম্মুখে। বিব্রত মিতু মতুর থেকে নিষ্কৃতি চায়, চায় তাকে উপেক্ষা করতে। কিন্তু নাছোড়বান্দা মতু যেন ‘মালাকুলমউত’ হয়ে তার মগজে সেঁটে থাকে। মিতুর পরিণতি কী হয়? মিতুদের গন্তব্য আসলে কোথায়?

সাফল্যের সোনার হরিণ শিকারের নেশায় মত্ত উদভ্রান্ত যে জীবন, তাকে আপাত চোখে সৌম্য মনে হলেও আসলে তা যে উল্কা জীবন এবং সে জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে নানা নিষ্ঠুরতা-অমানবিক তার জানা-অজানা আখ্যান। সে সব আখ্যানের কিছু কিছু ২০৫০-এর মিতু কেমনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করে মতুÑমিতুরই অন্তগর্ত নিদ্রাতুর মানবিকতা বোধ। এরই পাশাপাশি অঙ্কিত হয় ২০৫০ এর কল্পিত বাংলাদেশ তার পূবর্বতীর্ সত্তর বছরের বিবতের্নর সাক্ষ্যসমেত। পাঠক, চলুন আমরা এগিয়ে চলি। কল্পনাকে প্রসারিত করি ২০৫০ অভিমুখে। একুশ শতকের মধ্যবিন্দুতে দৃষ্টি রেখে আমরা সাক্ষী হতে থাকি সময় পরিক্রমায় বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যাপিতজীবনের জীবনমান ও জীবনাবেগ বদলের। এই বদলের পরিণতি কী নিছকই ধ্বংস, নাকি নবনিমার্ণ? নাকি এক অনিঃশেষ পরিবতর্ন ধারায় আটকে থাকা গোলক ধঁাধায় আসলে বদলায় না শেষ পযর্ন্ত কিছুই? মানুষের মানবিকতাবোধ যেমন অপরিসীম তেমনি অপ্রতিরোধ্য তার ভেতরকার ষড়রিপুজাত দানবিকতাবোধ। আর এই দ্বৈতবোধের দ্ব›দ্বতাড়িত জীবনে কোনো বোধ শেষ পযর্ন্ত হয় জয়ী? আসুন, আমরা হোসনে আরা মণির বিবিক্তা উপন্যাসে তা পযের্বক্ষণ করি।

নিজের শব বহন

কবিতা নানারকম-এরকম বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কথাটির সত্যতা স্পষ্ট। কারণ, কবিতা কি, এর যেমন সঠিক উত্তর নেই, তেমনিভাবে ভালো কবিতা, মন্দ কবিতাও ঠিকঠাক শনাক্ত করা যাবে না। আমার দৃষ্টিতে যেটি ভালো কবিতা, অন্যের কাছে তা ভালো নাও লাগতে পারে। অন্যদিকে আমার দৃষ্টিতে যেটি মন্দ কবিতা, অন্যের দৃষ্টিতে তা ভালো কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। শিল্পের ধরনই এমন। শিল্পের কাছে ভালোলাগার বাইরে অন্য কোনো দাবি নেই। এম মামুন হোসেন শিল্পের সেই ভালোলাগা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন পাঠকের কাছে নিজের উপলব্ধিকে পেঁৗছে দিতে। এ ক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছেন কবিতা। এবারের মেলায় গ্রন্থভুক্ত হয়েছে তার প্রথম কবিতার বই ‘নিজের শব বহন’।

বইয়ের ভেতরে প্রবেশের আগেই বইয়ের শিরোনামে চোখ আটকে যাবে যে কোনো পাঠকের। কারণ, একজন মানুষ কি নিজের শব নিজে বহন করতে পারে? কবির কল্পনায় পারে। আর এ ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যেকটি মানুষ যেভাবে প্রতিদিন মৃত্যুর আগেই মরে যাই, আমাদের মরে যেতে হয়। সেই টুকরো টুকরো মৃত্যুর ইতিহাসকেই লিপিবদ্ধ করেছেন মামুন তার কাব্যগ্রন্থের। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বণির্ত সেই আজকের জীবনের টুকরো টুকরো মৃত্যুকেই এম মামুন হোসেন ধরে রাখতে চেয়েছেন তার কবিতায়। ফলে তার কবিতা জীবনের কথা বলেছে। তিনি নিজের কথা বলেছেন। সেই বলার মধ্যে রয়েছে সরলতা। তিনি কবিতাকে ভাষা দিয়ে আড়াল করতে চাননি। আর চাননি বলেই তার কবিতা সরল। তার প্রকাশের নৈপুণ্যে পাঠক মুহূতের্ই ঢুকে যেতে পারে তার কবিতার ভুবনে। এতে করে মামুন হোসেনের কবিতা উঠে উঠেছে জীবনের গান। তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে আশার কথা বলেছেন, হতাশার কথা বলেছেন, বিদ্রোহের কথা বলেছেন, সমাজের নানা পযাের্য়র অনাচারের কথা বলেছেন। আর এই বলতে চাওয়ার ভেতর দিয়েই তিনি প্রকাশিত হয়েছেন। নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নিজেকে প্রকাশের যে আনন্দ তিনি নিজের শব বহনের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, তাই তাকে পুনঃপুনঃ প্রকশিত হবার পথে চালিত করবে।

মামুন রশীদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36693 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1