শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে জীবন আকাশের

সালাম সালেহ উদদীন
  ১২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

শত পরিচিত কণ্ঠের মধ্যে এই কণ্ঠটি অনেকদিন শোনেননি খান সাহেব। অথচ মোবাইল সেট হাতে নিলেই মনে হতো, এই বুঝি কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি বেজে উঠবে, শুনতে পাবেন তিনি সেই চিরচেনা মধুর কণ্ঠস্বর। আজ সেই প্রত্যাশিত কণ্ঠে আবেগ ও কান্না ঝরছে, গস্নানিও ফুটে উঠেছে মাঝেমধ্যে। অথচ কিছুদিন আগেও দেমাগে পা মাটিতে পড়ত না মিনারা বেগমের। খান সাহেবকে স্বামী তো দূরের কথা, মানুষই মনে করত না। সব সময়ে বলত, 'আপনি হচ্ছেন একজন ঝানু অভিনেতা, সব সময় অভিনয় করেন। বারোঘাটের পানি টোকানো সস্তা মানুষের সংসার করা উচিত না।' এসব কথা নিয়ে বহুদিন ঝগড়া হয়েছে দুজনের মধ্যে। খান সাহেব তার গায়ে হাতও তুলেছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। যদিও খান সাহেবের দাবি, তার মতো আর কেউ স্ত্রীকে এত ভালোবাসেন না, বকাবাজি কিংবা গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা। এই গভীর ভালোবাসার স্মৃতি স্মরণে এনে তিনি বহুদিন কেঁদেছেন নির্জনে একা অথবা বন্ধু-আত্মীয়দের সামনে। যেন তিনি অনাথ-অসহায় বালক। জীবনের পথ হারিয়ে ফেলেছেন। এক সময়ে কান্না ও চোখের জলই ছিল তার প্রধান অবলম্বন ও সঙ্গী। পরিচিত ঘনিষ্ঠজন যার সঙ্গেই দেখা হতো, বলতেন 'আমার বউ আমারে দুইবার তালাক দিছে। ওরে ছাড়া আমার জীবন কেমনে চলবো'- বলেই হাউমাউ করে কাঁদতেন। তার এই কথায় কেউ সহমর্মিতা প্রকাশ করতেন, কেউ আবার চুপ থাকতেন। কারও কারও মন্তব্য এমন- 'আজকাল বউ চলে গেলে কেউ কান্দে নাকি, বরং খুশিই হয়, স্বপ্ন দেখে দ্বিতীয় বিয়ের। খান সাহেব হয় বোকা না হয় ঝানু অভিনেতা।'

মিনারা বেগম প্রথমে তার ছেলেকে খোঁজে খান সাহেবের কাছে। খান সাহেব বললেন, 'আপনার ছেলে কোথায় আছে, আমি কী করে বলব। আপনি তাকে খুঁজে বের করুন।' অন্যদিক হলে মিনারা বেগম চড়া গলায় বলত, 'ক্যান সজীব কেবল আমার ছেলে, আপনার ছেলে নয়।' পাশাপাশি বলতো কিছু উগ্র-অশালীন কথা। যা শুনে তার মাথা কান গরম হয়ে যেত। কিন্তু আজ তার স্বর একবারেই নিচু গ্রামে, অত্যন্ত দুর্বল। যেন মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, দীর্ঘদিন রোগ-কাতর মানুষ যেমন হয়। তার কণ্ঠে আজ রুক্ষতার পরিবর্তে মায়াবী আবেগ ঝরে পড়ছে, দুঃখভারাতুর এক অসহায় নারীকণ্ঠ। যেন সম্পূর্ণ অচেনা বিপদগ্রস্ত কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে। কথার পরিপ্রেক্ষিতে খান সাহেব জানতে পারেন, সামাদ সাহেবের বাড়ি থেকে সে চলে এসেছে। প্রথমে কথাটা খান সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু কথার মধ্যে প্রথমে সে আবেগ ঝরালো তারপর কেঁদে ফেলল। এই কান্না যেন সে সস্তায় কিনে এনেছে অথবা এনেছে আমন্ত্রণ করে। তার মতো অনেক নারীই পরিস্থিতির শিকার হয়ে এমনটি করে।

এই ঘটনায় খান সাহেবের কোমল মন বিগলিত হয়ে গেল। তিনি আগের মতোই তার সংসারে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন। তার আহ্বান ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ঘেরা, তরঙ্গায়িত নৌকার মতো। পুরনো অভিযোগ তুলল মিনারা বেগম। বলল, 'আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমাকে ঘরে বন্দি করে কথা বলেছেন অন্য মেয়ে মানুষের সঙ্গে। গভীর রাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতেন। সুন্দর বাসা নিয়ে সংসার পাততে বলেছিলাম, পাতেননি টাকা খরচের ভয়ে। আপনি সংসার-বিমুখ অমানুষ। আমার ব্যাপারে ছিলেন একেবারে উদাসীন। সংসারের চেয়ে টাকার মায়া আপনার কাছে অনেক বেশি। আপনার সংসারে কোনো দিন ফিরে যাবো না।'

খান সাহেব বললেন, সামাদ সাহেব একাধিক অনিরাময়যোগ্য রোগে ভুগছেন, তিনি গোসল করেন না। তার শরীর দুর্গন্ধযুক্ত। মহলস্নার মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, দেখে ঘৃণার চোখে। আর তার ঘর করতে গিয়েছিলেন আপনি লোভে পড়ে। মাসে চলিস্নশ হাজার টাকা হাত-খরচও পাননি। পাননি সেবার জন্য দুজন চাকরানিও। আর আপনার নামে বাড়ি লিখে দিতে চেয়েছিল, সেটা তো কেবল স্বপ্নের কথা। এমন লোভী মহিলা আমি জীবনে কমই দেখেছি। আমার কবি-বন্ধু বলেছিলেন, এটা একেবারেই অবাস্তব। যারা ধনী তারা এসব দেন না, তা নয়। অল্প বয়সী শহর-সেরা অনিন্দ্য সুন্দরী কোনো মেয়েকে দিতে পারেন, কিন্তু ভাবীর মতো মধ্যবয়সী কাউকে নয়। কবি-বন্ধুর কথাটিই সত্যি হলো। খান সাহেবের কথা শুনে মিনারা বেগম কোনো মন্তব্য করল না। ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। খান সাহেব বিব্রত বোধ করলেন। কী বলবেন তিনি মিনারা বেগমকে। তার চেহারা অস্পষ্ট মনে পড়ছে। মিনারা বেগম তাকে দুবার তালাক দেয়ার পর খান সাহেবের আচরণ দেখে সবাই বলে- 'তার ছেঁড়া'। এই কথাটি এখন নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত। কিছুদিন আগে তিনি এক আত্মীয়ের বাসায় উপহার নিয়ে গেলেন এক কেজি করে ডাল-লবণ, দুই কেজি করে আলু-পেঁয়াজ। উপহার দেখে তারা প্রথমে কানাঘুষা শুরু করলেন, এরপর একজন বলল, 'বউ চইলা গ্যাছে তো তার ছিঁড়া।' কথাটা তিনি না শোনার ভান করলেন। তবে তার মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। তবে এর রেশ বাইরে প্রকাশ পেল না। তিনি চুপ থাকলেন। উপহার দেয়া তার অভ্যাস, বিশেষ করে নারীদের, হোক তারা অল্প পরিচিত অথবা অধিক পরিচিত, ঘনিষ্ঠ। তবে পুরুষ বন্ধুদেরও তিনি উপহার দেন। তার চরিত্রের একটি বিস্ময়কর দিক হলো, তিনি সারাদিন যে খাতে যত টাকা খরচ করেন, রাতে বাসায় এসে তা লিখে রাখেন। কোনো খাতে একটু বেশি খরচ হলে তার জন্য নীরব আক্ষেপও করেন। পরেরদিন খরচ কমিয়ে তা সমন্বয় করেন। তবে কোনো নারীকে তার ভালো লাগলে, ওই নারীর পেছনে অতিরিক্ত খরচ করতে দ্বিধা করেন না, অনেকটা আবেগের বশবর্তী হয়ে।

সম্প্রতি শাহবাগে আবৃতি শিল্পী মহুয়া কাজীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। এখন তার জগৎ মহুয়াময়। মহুয়ার তামাটে গায়ের রং তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে, মোহিত করেছে তার আবৃত্তি। মহুয়ার গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে একটি ফ্লাক্স উপহার দিতে চাচ্ছেন খান সাহেব। ইতোমধ্যে চার পাঁচটি মার্কেটও ঘুরেছেন। কিন্তু প্রত্যাশিত জিনিসটি পাওয়া যাচ্ছে না। মহুয়া কাজীর প্রতি তার মুগ্ধতার শেষ নেই। সুযোগ পেলেই তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চান তিনি, দেখা করার আকুতিও প্রকাশ করেন। তার একটি বাজে প্রবণতা হচ্ছে, তিনি এই মুগ্ধতা একজনের মধ্যে ধরে রাখতে পারেন না। যার কারণে নারীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক টেকে না। আবেগ উবে গেলে সম্পর্কও উবে যায়। তখন তিনি অন্য নারী খোঁজেন রাস্তায়, বাসে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে। এ এক অদ্ভুত অস্থির চরিত্র তার।

মিনারা বেগম দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে খান সাহেব আক্ষেপ আবেগ মিশ্রিত কান্না ঝরাতেন। ক্ষণে ক্ষণে বেশামাল হয়ে পড়তেন। এসবের প্রধান কারণ মিনারা বেগম যাতে সংসারে ফিরে আসে। খান সাহেবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যারা জানেন, তাদের ধারণা তিনি স্ত্রীকে নানা কৌশলে সংসারে ফিরিয়ে এনে আবার নির্যাতন করবেন। এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। কারণ মহলস্নার কিছু মানুষ মনে করেন, তার রয়েছে প্রতিশোধপরায়ণ হিংস্র মানসিকতা, যা সবার সামনে তিনি প্রকাশ করেন না। বলা যেতে পারে তিনি বাতাস বুঝে হাল ধরেন।

মিনারা বেগম জীবনের তৃতীয় সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে, এমন একটি খবর এখন পুরনো ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। খবরটি খান সাহেবের কানেও এসেছে। খবরটি শোনার পর থেকেই খান সাহেবের মেজাজ খিঁচড়ে আছে। একজন মানুষ কতবার জন্মগ্রহণ করেন, কতবার ধ্বংস হন- এই প্রশ্ন তার সামনে বড় হয়ে দেখা দিলে, একটি গান মনে পড়ে। 'কী আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে, নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে নিশিদিন খেলা করে।' গানটি গেয়ে তিনি কাঁদলেন। কারণ এই গানটি তার খুব প্রিয়, এটা যেন তারই জীবন। তিনি নিজেকে একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ ভাবেন। পুরনো ঢাকার আকাশে আজও ভুবন চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। তার ভুবন চিল হতে ইচ্ছে করে। এ জীবন চিলের, এ জীবন আকাশের, এ জীবন শূন্যতার। এমন কথা তিনি প্রায়ই উচ্চারণ করেন। উচ্চারণ করে তিনি হাসেন-কাঁদেন, আবার নিশ্চুপ হয়ে যান। তিনি স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন, জনকোলাহলপূর্ণ একটি রাস্তায়। আজ রাস্তার সুন্দরী নারীদের প্রতি তার কোনো আগ্রহ-আকর্ষণ নেই। এই রাস্তা দিয়ে আগে মিনারা বেগম যাতায়াত করত। সামাদ সাহেবের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে এখন আর এই রাস্তায় যাতায়াত করে না, করলেও একেবারেই অনিয়মিত। সামাদ সাহেবের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়ার পর মিনারা বেগম এক নতুন জগতের সন্ধ্যান পেয়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে লোকটির সঙ্গে। লোকটির বয়স খান সাহেব সামাদ সাহেব দুজনের চেয়ে কম, দেখতে বেশ সুদর্শন, নাম সুমন চৌধুরী। এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা রয়েছে তার। তিনি প্রায়ই বিদেশে যান। মতিঝিলে তার অফিস আছে। একবার এক প্যাকেট বিদেশি চকোলেট আনার জন্য মিনারা বেগম পুত্র সজীবকে পাঠিয়েছিল ওই অফিসে। সজীবের মতো কলেজ পড়ুয়া সুদর্শন তরুণকে মাত্র এক প্যাকেট বিদেশি চকোলেটের জন্য মতিঝিল পাঠানো ঠিক হয়নি এটা মিনারা বেগমকে কে বোঝাবে। যে কোনো সময় সজীবের বিপদ হতে পারত। এখন এই লোকটিকে নিয়ে মাতামাতি করছে মিনারা বেগম। ওই ভদ্রলোক নাকি সজীবকে লেখাপড়ার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। এসব তুল্য-মূল্যহীন কথা খান সাহেব শোনার পর মিনারা বেগমের ওপর যারপরনাই ক্ষিপ্ত হলেন, ক্ষিপ্ত হলেন সজীবের ওপরও।

এবার মিনারা বেগমের প্রতি তার ঘৃণা চলে এলো। নারী একবার হোঁচট খেলে নাকি বারবার খায়। আর পুরুষ একবার খেলে ঘোর কাটতে লাগে কয়েক বছর। কথাটা কতখানি সত্য তা খান সাহেব জানেন না। তার জানার ইচ্ছেও নেই। ইচ্ছেরা মরে গেছে অনেক আগেই। এখন যা অবশিষ্ট রয়েছে তা হলো, ছেলে সজীবের ভবিষ্যতৎ দেখে যাওয়া। সজীবকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সজীব চলে তার মতো করে। বাবাকে পাত্তা দেয় না সে, ২০ বার ফোন দিলেও ধরে না। সে কখনো স্বেচ্ছায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে চায় না। আসলে মায়ের কারণে বাবাকে সে কেবল এড়িয়েই চলে না, ঘৃণাও করে। এই ঘৃণার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সজীব মনে করে, তার ও তার মায়ের এই জীবনের জন্য সম্পূর্ণভাবে বাবাই দায়ী। তার বিরুদ্ধে সজীবের অনেক অভিযোগ, এই কঠিন সত্য জানার পরেও খান সাহেব অকারণে ছেলের প্রতি আবেগ ঝরান। অথচ ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে পারেন না। এক সময়ে মিনারা বেগমের ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে তার কোনো মনোযোগ ছিল না, একইভাবে এখন ছেলের ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারেও তার কোনো মনোযোগ নেই। আশ্বাসে অবিশ্বাস অনেক আগে থেকেই। তার জীবনে একটিই ভয়, অর্থ খরচের ভয়। কেবল একদিকেই তার সবচেয়ে বেশি মায়া, অর্থের মায়া। এই মায়ার কারণে স্ত্রী সন্তান সংসার তার কাছে একেবারই গৌণ। তার এই খবর ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতজনরা ভালোভাবেই জানেন। উপার্জনক্ষম যে পুরুষ সংসার চালায়, তার নব্বই ভাগ টাকাই সংসারের পেছনে খরচ হয়। যদি সে অন্যপথে অর্থ খরচ না করে। যারা সংসারমুখী পুরুষ তাদের তাই করার কথা, এটা তাদের কর্তব্য। তবে সংসার ঠিক রেখেও অনেক পুরুষ বান্ধবীদের পেছনে অর্থ খরচ করে। খান সাহেব কোনো দলভুক্তই নন। এ ব্যাপারে কেউ উপদেশ দিতে চাইলে তাও তিনি গ্রহণ করবেন না।

তালাকের আগে মিনারা বেগমের কাছে তিনি ওয়াদা করেছিলেন, আর কখনো মদ্যপান করবেন না। সেই প্রতিশ্রম্নতি তিনি রাখতে পারেননি। একদিন গভীর রাতে পাশের বাসার দারোয়ান মাতাল বেসামাল অবস্থায় তাকে বাসায় দিয়ে যায়। দরোজা খুলতেই তিনি মিনারা বেগমের পায়ের নিচে পড়ে যান। ওই দিন স্ত্রীর পা জড়িয়ে ধরেছিলেন বলে মহলস্নাবাসীর কারও কারও ধারণা। এমন নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েকবার। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপান করতে পছন্দ করতেন কিন্তু নিজের টাকা খরচ করে বন্ধুদের পান করাতেন না। তৃপ্তি না মিটলে তিনি একা একা পান করতেন, অন্যকে সঙ্গে নিতেন না। রাতে আড্ডা মারার ক্ষেত্রে তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। কথা ছিল রাত ১২টার আগে বাসায় ফিরবেন তিনি। অথচ একদিনও রাত ৩টার আগে বাসায় ফিরতে পারেননি। কখনো কখনো ফেরেন ভোরে। এসব কারণে খান সাহেবের ওপর থেকে মন উঠে যায় তার। সে তার সঙ্গে ঘর করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো পুরুষ যদি জীবনযাপনে স্বাভাবিক না হয়, চরম অসহায় নারী ছাড়া কেউ-ই তার সঙ্গে ঘর করবে না। এ ক্ষেত্রে মিনারা বেগম তো স্বাবলম্বী উচ্চশিক্ষিত মহিলা, স্কুল শিক্ষক। সে কোন দুঃখে এমন বাউন্ডেলে পুরুষের ঘর করবে? সঙ্গত ও যৌক্তিক কারণেই তারপক্ষে ঘর করা সম্ভব হয়নি। তবে সামাদ সাহেবের ঘর করতে যাওয়া তার জীবনে বড় ধরনের একটি শিক্ষা। এই শিক্ষা থেকেও সে বলতে গেলে কিছুই আহরণ করেনি। না হলে কেন সে তৃতীয় পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে যাচ্ছে। এর পরিণতি যে ভালো হবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তারপরেও মন মানে না। নিঃসঙ্গ মন আশ্রয় চায়, স্বস্তি-শান্তি চায়। প্রশান্তির ঠিকানা খুঁজে বেড়ায়। মনের মতো কারও কাছে সমর্পিত হতে চায়। কথায় বলে, একবার হোঁচট খেলে বারবার খেতে হয়। হয়তো বা মিনারা বেগমের ক্ষেত্রে কথাটা শতভাগ সত্য। জীবন অন্ধকারে তলিয়ে গেলেও সে আর খান সাহেবের সংসারে ফিরবে না। এটা কেবল তার ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে অনড় পরিবার ও সে। কারণ জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছে সে খান সাহেবের কাছ থেকে। এমন স্বামী সে চারপাশে কোথাও দেখেনি, এমনকি কারও কাছে গল্পও শোনেনি। তা ছাড়া সে যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকায়, তখন বীভৎস ও দুঃখজনক কিছু চিত্র তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাই ওই জীবনে সে আর ফিরে যেতে চায় না। সে চায় নতুন জীবন, নতুন সংসার, নতুন ভালোবাসা।

আজকের বিকালটা বেশ বিরহকাতর নিঃসঙ্গ। বাড়ির ছাদে আজ একা একা পায়চারী করছে সে। সজীব সকালে বের হয়েছে, ফেরেনি এখনো। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। নিচের দিকে তাকায় সে। খান সাহেবের মতো কাউকে মনে হচ্ছে। কারণে অকারণে সময়ে অসময়ে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। যেন পুরোপুরি পাগল চরিত্র। মিনারা বেগমের বড় ভাই সবুর সাহেব তাকে হুমকিও দিয়েছেন, তারপরেও একই কাজ করেন তিনি। সে নিচের দিকে তাকাতে পারছে না। আকাশের দিকে তাকালো সে। আজকের আকাশ তারচেয়েও দুঃখভারাতুর। কী জীবন চেয়েছিল সে, আর কেমন জীবন পেল। এই প্রশ্ন আজ ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। ক্রমেই শব্দের জগৎ ভারী হয়ে উঠছে। পেছন থেকে কেউ কি তাকে ডাকছেন খান সাহেব অথবা সামাদ সাহেব, নাকি তৃতীয় কেউ। শব্দ-তরঙ্গ কানে এসে ঝড়ের ঝাপটার মতো লাগে, বেসামাল হয়ে পড়ে সে। হয়তো এখনই দিকশূন্য হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। পুত্র সজীবের চেহারা অস্পষ্ট ভেসে উঠছে। বড় করুণ বড় অসহায় সে চেহারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45049 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1