শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীলকণ্ঠ পাখি

শারমিন সুলতানা রীনা
  ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বদ তো বদই, তাই বলে এত বড় বদ। কে জানতো জানলে কে আর ওরে মনের সব কথা খুইলা কয়, একখান কথাও যে হজম করতে পারে না কে জানতো। ধুর আমারই ভুল হইছে তারে কথা খান কওয়া। এক নাম্বার বদ আর কেউ না আমারই চাচাতো ভাই আর ভালো বাসার মানুষ। যাউকগা তার একখান নাম আছে, আমারও মাথা খান ঠিক নাই কি তহন থেইকা বদ আর বদ কইয়া যাইতাছি। প্রেমিকরে যে এইডা কওন যায় না মনেই নাই। মাথাখান বুঝি গেল এইবার, কেমন ঝিম মাইরা আছে। মোবাইলের লাহান হ্যাং হইয়া গেল নাকি দেহিতো মাথায় একখান টোকা মাইরা ঠিক হয় নাকি? না এই বার ঠিক আছে। বুঝলাম আমার পেটেও কথা থাকে না, নইলে সব রাইখা ওরেইবা কইতে যামু ক্যান? ওর নামডা কইতেই ভুইলা গেছি, ওর নাম দোলন, ছোটকালে নাকি ওর মা খালি ওরে দোলনায় দুলাইতো, জব্বর পাজি আছিল বইলা দোলনায় পেঁচাইয়া থুইয়া ওর মা কাজ করত, সেই কারণে সবাই ওরে দোলন কইতো। দোলন হোক আর যাই হোক আমি যে কেন ওরে কথাডা কইতে গেলাম? লোহা খাইয়াও যে মানুষ হজম করার ক্ষমতা রাখে সে একটা কথা হজম করতে পারব না সেইডা জানতো কে? আর আমি কিনা আমার নিজের মায়ের প্রেমের কথা ওর লগে শেয়ার করলাম। নিজের উপরই ভীষণ রাগ হইতাছে হায় হায় আমি কি করলাম? কথাডা মার কানে গেলে মারে আমি মুখ দেখামু কেমনে?

বিরাট এক ভাবনায় আমারে পাইয়া বসল।

কথাটা সত্য সত্যই মার কানে গেল। মা দেহি রাইতে আমার দিকে কেমন কইরা যেন চাইয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। আমার মধ্যে তহন অপরাধ বোধ কাজ করছিল। মার গলা ধইরা মারে কইলাম মারে তুমি কি আমার উপর খুব রাগ কইরা আছো? মার টলটলে চোখ দেইখা আমি মায়ের দিকে আর তাকাইতে পারলাম না। কত জল আমার মার বুকে কুনদিন কি জানতে চেষ্টা করছি? করি নাই মায়েগোও যে দুঃখ থাকবার পারে কোনোদিন সন্তান হইয়া কেউ তা বুঝবার চেষ্টা করে না।

মা আমার দিকে একভাবে চাইয়া আছে মনে হইতাছে দুই চোখে দুই নক্ষত্র জ্বল জ্বল কইরা জ্বলতাছে, সেই আলো সন্তানরে আগামীর পথ দেখায়। আমার মা এত সুন্দর আইজ নতুন কইরা আবিষ্কার করলাম। মার চোখ-মুখ-নাক নতুন কইরা আবিষ্কার করলাম, মার বুকখানও যেন আবিষ্কার কইরা ফেললাম, একটা ধূসর মরুভূমি, তবু যেন মা সেই মরুভূমিতে একটা সবুজ উদ্যানের স্বপ্নে বিভোর থাইকা আমারে বড় করছে। আমি কি সেই সবুজ উদ্যান? মাটির মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আমার মায়ের কোনোদিন তারে ভাঙতে দেখি নাই শত বিপদেও পাহাড়ের মতো অবিচল থাকতে দেখছি। আমার মায়ের বুকের ভিতরে একটা হ্রদ আছে যেখানে স্বপ্নের বালিহাঁস ভাইসা বেড়ায়। সেই বালিহাঁসও কি আমি? মারে আবিষ্কার করতে যাইয়া আইজ মারে কেন অন্যরকম লাগতাছে। বাবার কথা আমার তেমন কিছু মনে নাই। আমার বয়স যখন চার-পাঁচ বছর বাবা তহন মইরা গেছে। মা আমারে কুনদিন কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয় নাই। আদরে আহ্লাদে আমি মানুষ হইছি বইলাইকি আমার মাথা বিগরাই গেছে। তাই এমন কইরা মার কথাটা দোলনরে কইতে পারলাম। ভাত খাবি আয়, মায়ের অভিমানী কণ্ঠ, মার গলা ধইরা আহ্লাদ যেন তহন আমার উপচাইয়া পড়ে, তুমি খাইছো মা, দাদি ভাত খাইছে?

: তোর দাদিরে খাওয়াইছি তোরে খায়াইয়া আমি খামু।

: তুমি খায়াইয়া দেওনা মা কতদিন তোমার মাখানো ভাত খাইনা।

: আচ্ছা তুই বয় আমি ভাত নিয়া আসি।

মা ভাত আনতে গেলে অন্য ঘর থেকে বড় চাচির কণ্ঠ আসে চাচি আমারে ডাকে। আমি দৌড়াইয়া চাচির কাছে গেলাম, চাচি কটমট চোখে আমার দিকে চাইয়া আছে। আমি ভয়ে মাথা নিচু কইরা থাকি।

: রূপা মাথা ওঠা তুই দোলনরে কি কইছস তোর মার কথা? তুই জানোস না দোলনের পেটে কথা থাহেনা ও আমারে কইছে তোর দাদিরে যদি কয় তোর মার কি হইবো একবারও ভাবছোস? তোর দাদি বুড়া মানুষ কি শুইনা কি করে, তুই মাইয়া হইয়া কোনোদিন তোর মারে বুঝলি না, আলস্নাদ দিয়া তোর মাথাডা খাইছে। বারবার কইছি মাইয়ারে অত লাই দিওনা, কে শোনে কার কথা বুজুক অহন।

দোলন আমার চাচাত ভাই বড় চাচার ছেলে। একসঙ্গে দুজনে বড় হইছি স্কুল-কলেজে এক লগে পড়ছি বয়সে আমার দুই বছরের বড় হইলেও দোলন আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। দোলন আর আমার সম্পর্ক পুরা গ্রামবাসী জানে। আমরা দুজন দুজনরে অনেক ভালোবাসি।

: এই কথার উত্তর দে তোর মারে কার লগে কথা কইতে দেখছোস? মারে না জিগাইয়া দোলনরে কইতে গেলি কেন? তোর বুদ্ধি হইবো কবে রে রূপা? আমি কোনো উত্তর দিবার পারি না। বড় চাচির মুখের উপর কথা কওনের সাহস এই বাড়ির কারো নাই, সবাইরে বড় চাচি পরিচালনা করে। বড় চাচির বুদ্ধিমত্তা অনেকের চেয়ে আলাদা, কেউরে কিছু কইলে সে তা মানা করতে পারে না আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম হই ক্যামনে?

আমি কি কই শোন- বড় চাচি বলতে থাকে আমি সম্মোহিতের মতো শুনি সেই কথা। তোর মা রাবেয়ারে এই বাড়ির বউ কইরা আমি আনছিলাম, রাবুর মতো সুন্দরী এ গাঁয়ে তেমন কেউ আছিলো না তোর বাপও অনেক পছন্দ কইরা তোর মারে বিয়া করে। পাখির মতো আগলাইয়া রাখছে সবসময় হঠাৎ তোর বাবা এক্সিডেন্টে মারা যায়। তোর নানা নানু তোর মারে অনেকবার নিতে আইছে আবার বিয়ে দিবো বইলা। তোর মা তোর কারণে যায় নাই। দ্বিতীয় কোনো চিন্তাও করে নাই তোর মুখের দিকে চাইয়া। আইজ আমি যা কমু তুই মন দিয়া শোন।

রাবু তখন এসএসসি পড়ে, আমার ছোট ভাই ফরিদের সাথে ওর তখন সম্পর্কের ব্যাপারটা আমরা সবাই জানতাম। রাবুর রূপ-গুণের কারণে আমাগো বাড়িতেও সবাই রাজি ছিল। আমরা জানতাম সবাই, আমার মা ও রাবুরে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না ফরিদ ভিতরে ভিতরে রাজনীতির লগে যুক্ত, ধনী-গরিবের বৈষম্য তারে কষ্ট দিত, এই দেশ থেইকা পুঁজিবাদ তাড়াইয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। কিন্তু ও বুঝতে চাইতো না পুরো বিশ্ব যখন পুঁজিবাদের দখলে ও এই সমাজ পরিবর্তন করব কেমনে? মাও সে তুং, কার্ল মার্কস, লেনিনের যুগ নাই। পরিণামে কি হইল ফরিদরে একদিন রাতের অন্ধকারে পুলিশে ধইরা নিয়া যায়। ওগো দলের কয়েকজনরে গুলি কইরা মাইরা লাশ নদীতে ফেলাইয়া দেয়। পরদিন সবার লাশ পাইলেও ফরিদের লাশ আমরা পাই নাই। আমার বাপজান পাগলের মতো এদিক-সেদিক খুঁইজা বেড়াইছে, পরে শুনলাম ওর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হইছে। ততদিন সব শেষ। রাবুরে এই বাড়ির বউ কইরা আমি আনছি ফরিদের আশা ছাইড়া দিয়া। রাবু ফরিদের লেইগা অপেক্ষা করতে চাইছিল। কিন্তু আবেগ জীবন বাস্তবতা এক জিনিস না। ফরিদের শাস্তি শেষ হইয়া গেছে ও গ্রামে আইছে। তোর মার সাথে দেখা করতে সে এই বাড়িতে আইছে কয়েকদিন। ফরিদেরও চিন্তা-চেতনা আগের মতো নাই সে তোর মারে নিয়া আবার ঘর বানবার চায়, আমিও চাই, চোখের সামনে ওরে তিল তিল কইরা শেষ হইয়া যাইতে দেখি। রাবু অহন আর পিছনে ফিরতে চায় না বাকি জীবন তোরে নিয়াই থাকতে চায়।

এতক্ষণ চাচির কথা গুলান শুনতে শুনতে আমি অপলক চাইয়া থাকি চাচির দিক। মায়ের প্রতি চাচির এত সহানুভূতি এত ভালোবাসা অথচ পেটের মেয়ে হইয়াও নিজের মারে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করি নাই, বুঝবার পারি নাই। আমার মারও তো একা লাগে। মায়ের জন্য এই মুহূর্তে একটা চাপা কষ্ট বেদনা বোধ আমারে তাড়িত করে। এতদিন মায়ের উপরের চাকচিক্য দেখছি, ভেতরের বেদনা তারে ঢেউ হইয়া ভাইংগা-চুইরা দিছে কোনোদিন বুঝলামনা? আমার মধ্যে এক ব্যথাতুর পাখির নিশিকান্না, স্বজন হারানোর অব্যক্ত বেদনা জাইগা ওঠে। আমার মায়ের একটা মন আছে সেখানে পাওয়া না পাওয়ার অসীম শূন্যতা আছে বুঝি নাই। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে মারে কোনো দিনও মনে হয় নাই মায়ের একখান স্বর্ণালী অতীত আছিল। যে মানুষটার মধ্যে হাজারও কথার মণিকাঞ্চন ভিড় কইরা থাকে অথচ কইতে চাইলেও শোনানোর কেউ থাকে না তার চাইতে নিঃস্ব আর কে হইতে পারে? মার দুই পাশে দুই বেণি দুলানো বেলি ফুলের মালা হাতে কারও জন্য গভীর অপেক্ষারত সদ্য যৌবনা অবয়বটা ভাইসা ওঠে আমার চোখের সামনে।

: আচ্ছা চাচি শোনো- মারে আবার তুমি ফরিদ মামার সাথে বিয়া দাও। আমি কিছু কমুনা। আমার মোটেও কষ্ট হইব না বরং মারে সুখী দেখলে আমি অনেক অনেক খুশি হমু।

: না তোর মা রাজি হইব না আমি কইছিলাম। আর কারও লগে কিছু কওয়া কইয়ি করিস না বুঝবার পারছস আমি কি কইলাম?

আমার বুকে অদম্য জোয়ার যেন সব কিছু ভাসাইয়া নিয়া যাইতে চায়। নিজেরে কন্ট্রোল করলাম। মায়েরা কি নীলকণ্ঠ পাখি? সব বিষ একা হজম করে নীরবে নিভৃতে? ভিতরের ভাঙন কেউরে বুঝতে দেয় না।

যত বড় ঝড়ঝাপটা আসুক নিজের বুক পাইতা প্রতিরোধ করে।

চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়া আমি ঘরে গেলাম, মা ভাতের পেস্নট সামনে নিয়া বইসা

আছে।

: কিরে রূপা এতক্ষণ কি করলি? আমি কখন থেইকা ভাত লইয়া বইসা রইছি, তোর দেহা নাই চাচির লগে কি কইলি। মা মানুষটা খুব খারাপ? আমি মায়ের মুখের দিকে চাইবার পারলাম না। মায়ের বুকের মইধ্যে মুখ লুকাইয়া হু হু কইরা কানতে লাগলাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84624 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1