শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি স্বপ্নের দোরগোড়ায় সম্পকের্র সেতুবন্ধন

রুমানা নাওয়ার
  ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আমরা আমাদের সন্তানদের বলে থাকি এটা কর, ওটা করো না। এটা খারাপ, ওইটা ভালো। এ রকম বিবিধ কথা। নিষেধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ রাখি। কিন্তু আমরা হরহামেশা বাচ্চাদের সামনে অন্যকে নিয়ে সমালোচনা করি। পরচচার্, পরনিন্দা করি। যা খুবই খারাপ একটা কাজ। আমরা হয়তো খেয়ালের বশে অভ্যাসের বশে এ খারাপ কাজটা করে যাচ্ছি। কিন্তু এটা আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে পরবতীর্ সময়ে। হতে পারে সে আমার অতি আপনজন। বোন-ভাই মা অথবা পড়শি। হতে পারে শাশুড়ি ননদ জা অথবা দেবর। সম্পকর্ একটু খারাপের দিকে গেলেই আমরা যা তা বলতে শুরু করি। স্বভাব নিয়ে বংশ শিক্ষা রুচি এমন কী চরিত্র নিয়েও কটু কথা বলতে দ্বিধাবোধ করি না। একটু নয়-ছয় হলেই সম্পকের্র তুলোধোনা করি। রক্তের বঁাধনটা আলগা হয়ে যায় কটু কথায়। যা আমার সন্তানেও প্রবাহিত হয় ধীরে ধীরে। একই ঘরে একই ছাদের নীচে বসবাস যেহেতু। তার কানেও পৌঁছোয় এসব হিংসা হানাহানির কানাকানি। মনের অজান্তেই তার মনে রিরংসার বীজ বুনে দিই। কচি মনের সে অনুভব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অতি আপন মানুষটাকে দূরের ভাবতে শুরু করে। তার কথা তার আচার আচরিত দিক সবই অসহ্য লাগে। মধুর সম্পকর্টা তার সঙ্গে বিষময় হয়ে ওঠে। চাচা, চাচি, খালা, দিদি, দাদু, মামা, মামি হতে পারত সে বুকের ছোট্ট কোটরের হ্যামিলনের বঁাশিওয়ালা। জাদুর বঁাশিতে সুর তুলে অজানা এক ভিনদেশে নিয়ে যেত তাকে। লাল নীল হলুদ পরীদের সঙ্গে সখ্য হতো। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টোটা হয়। ক্রোধ হিংসা রিরংসার বীজ রোপণ হয় তার ছোট্ট বুকের অনাবাদী জমিনে। যা একসময় বাড়তে বাড়তে মহীরুহ আকারে জন্ম নেয়। স্বাভাবিক সম্পকর্টাকে অস্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। তার চেনা-জানা বলয়ের গÐী ছেড়ে ছিটকে পড়ে অন্য মোহনায়। বাবা-মার হাজার অনুরোধেও আর কাজ হয় না।পারিবারিক সামাজিক ঘরোয়া উৎসবেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বাচ্চাটি। ছোটবেলায় হয়তো বোঝা যায় না তার ওই বিশেষ ব্যক্তিটার প্রতি আক্রোশটা। কিন্তু বয়স যতই বাড়তে থাকে সে আচার আচরণে বুঝিয়ে দেয় যে, সে তার অপছন্দের ঘৃণার। এর পুরো দায়ভার কিন্তু বাবা-মার। তাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এটা রয়ে যায় প্রিয় সন্তানে। এমন অনেক উদাহরণ আছে প্রতিটি ঘরে আমাদের সমাজে। বাবা-মার অপছন্দের মানুষটি শেষপযর্ন্ত তার সন্তানেরও অপছন্দের তালিকায় স্থান নেয়। কোনো এককালে তার মার সঙ্গে তার ফুফুর সামান্য কথাকাটাকাটি হয়েছিল হয়তো। কোনো পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে। সেটাই জিইয়ে রাখে তার মা। দুই যুগ আগের ঘটনাটি সন্তানদের বলে বেড়ায় সমানে। যার ফলস্বরূপ সন্তানেরা আর কাছে টানে না ফুফুকে। আপন রক্তের সম্পকের্ক আর আপন ভাবে না তারা। ফুফুর প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে আগেকার ভুলগুলো চুকে ফেলতে। ভাবির সঙ্গে বাচ্চাদের সঙ্গে হৃদ্যতায় ফিরতে। কিন্তু পারে না। শত চেষ্টায় বিফল মনোরথ হন উনি। ভুলতে না পারার, ক্ষমার মানসিকতা না থাকার কারণে ওদের রিলেশন আর ভালোর দিকে যায় না। সারাজীবন আফসোসে কাটায় বোনটি। ভাইয়ের থেকে দূরে সরে যাওয়ার বেদনায়। আবার এমনো হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ভাইয়ের বিয়েতে বোন রাজি না। পাত্রী সুন্দর না হওয়ায় ঘোর আপত্তি কান্নাকাটি। ভাই যে তার সবদিকে সেরা। একটু বেশি চাইতেই পারে। ক্ষতি কি?

ক্ষতি তো করেই ফেলেছে আপত্তি জানিয়ে। বিয়ে হলো সংসারও হলো। পুত্রকন্যায় ঘর আলোকিত হলো। কিন্তু বোনের আপত্তি জানানোটা মন থেকে গেল না। নিজে করত করত বিষোদ্ঘার বাচ্চাদের মনেও ঢুকিয়ে দিল হিংসার বীজ। তাদের বলা হলো, তোমার এ ফুফুই তোমার বাবার আমাকে বিয়ে করার ঘোরবিরোধিতা করেছে। ব্যস এতটুকুতেই সব শেষ। ওই ফুফুর কোলঘেঁষে বসেনি ওরা। হাত ধরে দুকদম হঁাটেনি কখনো। হঁাটবে কী করে, তার আগেই যে তাদের গতি পাল্টে দিয়েছে মা। অথচ ওই বোনই ভাইয়ের বিদ্বান হওয়ার পথে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। মা হারা ভাইটার মায়ের আদরে আগলে রেখেছে। স্নেহ, মায়া, ছায়া বাদে আর যেটি ছাড়া জীবন অচল সে আথির্ক সঙ্গতিরও যোগান দিয়েছে বোনটি। সেসব মনে না রেখে কবে কখন একটু আপত্তি জানিয়েছ ওটায় মনে রাখল ওরা। নিজেদের হিংসার বীজটা সন্তানে রোয়ে দিয়ে ইতি টানে সম্পকের্র। ফুফুর মন টানলেও ভাইয়ের সন্তান-সন্ততির মন টানে না ফুফুতে। একটা অবহেলার ভাব নিয়ে ফুফুর প্রতি বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে হিংসার ডালপালা। খেঁাজ নেয় না কেউ কারো। কোানো উৎসবে হয়তো দেখা এক নজর। ওটাও লৌকিকতাপূণর্। কুশল বিনিময়ে সীমাবদ্ধ। কার চেয়ে কে বড় তার ফিরিস্তি চলে। জাহির করতে চায় নিজেই সবচেয়ে সুখী। অথচ একসঙ্গে একপাটিতে মায়ের বুকে ঘুমাত। একই পাতে খেতো মার হাতে। পড়তে বসত এক টেবিলে। সে ভাই-বোন দূরের হয়ে যায় একটু ভুলে।

মনে হিংসার বীজ রোপণ হয়ে যাওয়া এবং এর থেকে বেরুতে না চাওয়ার মানসিকতাই সম্পকর্ নষ্টের প্রধান কারণ। এত টুকুতে থেমে গেলে হতো। বাড়ত না আর পরবতীর্ প্রজন্মে রিরংসা। মা-বাবারা তা না করে নিজেদের মনোভাবটা ছড়িয়ে দেয় নিজ রক্তে। যা বংশ পরম্পরায় চলমান থাকে যুগ যুগ।

একসঙ্গে চলতে গেলে জীবনে অনেক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। এর কোনটা ভালো কোনটা খারাপ। সবটাই যে ভালো হবে এরকম বলা যায় না। মন্দটাও হবে মাঝেমধ্যে। এটা মানুষে মানুষে মনে মনে। দুজন মানুষ দুধরনের। চেহারায় যেমন আচার-ব্যবহার রুচি-অভ্যাসেও তেমন। মিল হয় না শতভাগ কখনো। তাই একটু-আধটু মনকষাকষি ঝগড়া হতেই পারে। সেটা মেনে নিয়ে মানিয়ে চলার যোগ্যতা থাকতে হবে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে বাধে বিপত্তি।

অনেককে বলতে শুনি বিয়ের প্রথম ক’বছর বেশ ঝড়-ঝঁাপটা গেছে আমার ওপর দিয়ে। শাশুড়ি ননদ বর কেউ বুঝত না আমায়। তাদের মতামতটা চাপিয়ে দিত সবসময়। আমার কথার কোনো মূল্যই দিত না ওরা। আমি ধীরে ধীরে ওদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। এবং একদিন ঠিকই সবার মন জয় করে নিই। এখন সবাই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি বউমা বলতে অজ্ঞান। বরও আমার পরামশর্ নিয়ে কাজে এগোয়।

আমার বাচ্চারাও সবার সঙ্গে মিলেমিশে বড় হচ্ছে। দাদা-দাদির আদর ফুফুর স্নেহ-মায়ায় দিনে দিনে ঋদ্ধ হচ্ছে বুদ্ধিতে মেধায় এবং দুষ্টমিতে। আমি যদি প্রথম দিকে অধৈযর্ হতাম সংসার ছেড়ে আলাদা হয়ে যেতাম। তাহলে কখনো এ সুফল পেতাম না। একরাশ দুঃখ আর হিংসা বুকে পুষে দিনাতিপাত হতো। আমার সন্তানদেরও তার ভাগ দিতাম হয়তো। যা কখনোই সুফল বয়ে আনত না। আমার জন্য আর আমার সন্তানের জন্য। একটু ধৈযর্ একটু সহনশীল হলেই এ ব্যাপারগুলো থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়। ছেলেমেয়েরাও একটা সুন্দর পারিবারিক আবহে হেসেখেলে নিজেকে মেলে ধরতে পারে।

আবার অনেকে এসবের তোয়াক্কা না করে সম্পকের্র ইতি টানে। মানতে না পারার দোহাই দেয় সবক্ষেত্রে। সারাজীবনের জন্য ওই বিশৃঙ্খল সময়ের কাছে হার মানে। পাড় পাওয়ার কোনো উপায় না বের করে রণে ভঙ্গ দেয় জীবনের। যার ফল পরবতীর্ প্রজন্মেও বয়ে বেড়াতে হয়।

আমরা মা-বাবারা একটু সচেতন হলে আমাদের সন্তানরা এসব সম্পকের্র টানাপড়েন থেকে বেঁচে যায়। সুন্দর আগামী সোনালি স্বপ্নের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দিতে আসুন আমরা সবাই তাদের সুন্দর সম্পকের্র সেতুবন্ধন রচনা করি। সেটা হোক ভাইয়ের সঙ্গে বোনের কিংবা বোনের সঙ্গে ভাবির। আপন রক্তের টানটা বহমান থাকুক বংশ পরম্পরায়। সেটা যেন অবিবেচক বাবা-মার কারণে নষ্ট হয়ে না যায়। নষ্ট হয়ে না যায় আপন শেকড়ের অস্তিত্ব। কারণ শেকড়কে বাদ দিলে নিজেরই কোনো আইডেন্টিটি খুঁজে পাওয়া যায় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19824 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1