শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রশাসনে অনৈতিক সিন্ডিকেট

রাজনীতির দোহাই দিয়ে দুনীির্ত

বিদ্যুৎ, ওয়াসা, তিতাস, ব্যাংক-বীমা, বিআরটিএ, রাজউক, গণপূতর্, মাদক ভূমি ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই দুনীির্তবাজ কমর্কতার্রা রাজনীতিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করছেন
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

গুলশান-বনানী-ধানমÐিসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় অন্তত ৫০ হাজার ভবন মালিক বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুনীির্তবাজ সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে আবাসিক মূল্যহারে বিল পরিশোধ করছেন। এতে প্রতি মাসে সরকারের বিশাল অংকের রাজস্ব গচ্চা যাচ্ছে। তবে এ অথের্র একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুনীির্তবাজ কমর্কতার্-কমর্চারীর পকেটে ঢুকছে। বিষয়টি দীঘির্দন ধরে ওপেন সিক্রেট হলেও সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ এর দায় পুরোপুরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুনীির্তবাজ কমর্কতাের্দর অজুহাত, রাজনৈতিক নেতাদের দাপটের কারণে তারা এ ধরনের দুনীির্তর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যথর্ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে সহযোগিতা না করায় তাদের অনেকে পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছেন বলেও সাফাই গান তারা। যদিও মাঠপযাের্য় অনুসন্ধানে এর পুরো উল্টো চিত্র পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকরা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে এ অপতৎপরতা চালালেও এর সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ, তিতাস গ্যাস ও ওয়াসার দুনীির্তবাজ কমর্কতাের্দরও অঁাতাত রয়েছে। শুধু বিদ্যুৎ, ওয়াসা কিংবা তিতাসই নয়; ব্যাংক-বীমা, বিআরটিএ, রাজউক, গণপূতর্, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিধপ্তর, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই দুনীির্তবাজ কমর্কতার্রা রাজনীতিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করছেন। এ পাল্লায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু কমর্কতার্ও সমানতালে এগিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুনীির্তর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও তাতে সফলতা পাওয়া সত্যিকার অথের্ই কঠিন হবে বলে মনে করেন পযের্বক্ষকরা। তাদের অভিমত, একজন ব্যক্তি যত ভালো নেতাই হোক না কেন, তিনি একজন ব্যক্তি। আর গোটা দেশের শাসনব্যবস্থা কখনো ব্যক্তিনিভর্র হতে পারে না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্ত না হলে, একজন ব্যক্তির পক্ষে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য সবকিছু একটি ‘সিস্টেমের’ মধ্যে আনতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। যা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দঁাড়াবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের যোগসাজশেই দেশে সবচেয়ে বেশি দুনীির্ত হচ্ছে। তবে রাজনীতিবিদরা চাইলেই দুনীির্ত দমন ও প্রতিরোধ সম্ভব। এ জন্য পদ্ধতিগত সংস্কার করতে হবে। তাদের ভাষ্য, দুনীির্ত কমাতে গেলে প্রশাসনিক জবাবদিহি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আদশর্গত অবস্থান থেকে বিচ্যুতি ঠেকাতে হবে। কেননা উচ্চপযাের্য়র নীতিনিধার্রক, প্রশাসনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাতেই বড় মাপের দুনীির্তর ক্ষেত্র থাকে। অন্যদিকে রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা অনেকে নিবার্চনী দুনীির্ত প্রতিরোধের ওপর সবোর্চ্চ গুরুত্ব দেন। তাদের ভাষ্য, অনেকেই নিবার্চনে জিতে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। তাদের সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। যা প্রাথীের্দর কয়েক টামের্র নিবার্চনী হলফনামার তথ্য তুলনা করে খতিয়ে দেখলে সহজেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। বড় দুনীির্তর বিরুদ্ধে দুদক কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারলে দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ ব্যথর্ হবে বলেও মনে করেন তারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শরীফুল আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বতর্মান বাস্তবতায় দুনীির্ত এবং মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কঠোর ভাষায় দুনীির্ত এবং মাদকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করছেন তা আমাদের অনেকটা আশাবাদী করছে। কারণ রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ পযার্য় থেকে কঠোর থাকলে অন্যরা সতকর্ থাকে। তবে এখানে একটি বিষয় বিবেচ্য- যে প্রশাসন এবং রাজনীতিবিদদের দিয়ে দেশকে দুনীির্তমুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে, তারা কতটা নিভের্জাল তার ওপরে। বতর্মান সরকার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারের বিভিন্ন স্তরে এক ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরা অনেক ধরনের অনিয়মে বিভিন্ন সময়ে জড়িয়েছে বা জড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের সময় প্রশাসনের ভ‚মিকাকে আমরা কোনোভাবেই প্রশ্নের ঊধ্বের্ রাখতে পারি না। যারা একটি ক্ষেত্রে অন্যায় করতে পারে, তারা অন্য ক্ষেত্রে অন্যায় করবে না এটা আশা করা কষ্টকর।’ তবে প্রধানমন্ত্রী মুখে যতটা কঠোর হচ্ছেন বাস্তবেও যদি ততটা সোচ্চার হন তাহলে দেশের জনগণের জন্য অনেক বড় সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন অধ্যাপক শরীফুল আহমেদ। এ প্রসঙ্গে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ইউনিভাসিির্ট অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচাযর্ জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অনৈতিক যোগসাজশ ভাঙতে না পারলে দুনীির্ত প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, দুদকের উচিত চিহ্নিত বড় দুনীির্তবাজদের ডেকে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ না করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাশাপাশি প্রশাসনের নিয়োগ-বাণিজ্য,পদায়ন ও বদলি-বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়তে হলে সরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি, পদায়ন, শৃঙ্খলা ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন নীতিমালা প্রয়োজন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক জবাবদিহির ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে দুনীির্তমুক্ত সমাজ গঠন অসম্ভব। এদিকে ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নিধার্রকরা দেশকে দুনীির্তমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ¯েøাগান কিনা তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন, দুনীির্ত দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, তা বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বিশ্বের কোথাও দুনীির্ত দমন করা সম্ভব হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দুনীির্তবাজরা যদি বেঁচে যান, তাহলেও দুনীির্তর লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে বলে তারা মত দেন। এদিকে রাজনীতিকদের সঙ্গে প্রশাসনের অঁাতাতে রাষ্ট্রীয় পযাের্য় বড় দুনীির্ত হয়ে থাকেÑ এ ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন আমলারা অনেকেই। তাদের দাবি, প্রভাবশালী রাজনীতিকদের কারণেই সবর্স্তরে দুনীির্ত ছড়িয়েছে। কেননা, মাঠপযাের্য়র কমর্কতার্রা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকমীের্দর অনিয়মের বিরোধিতা করলেই তাদের ‘চেয়ার’ নড়ে যাচ্ছে। তাই চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বাথের্ তারা বাধ্য হয়ে রাজনীতিকদের দুনীির্তর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন। তবে রাজনীতিবিদদের দোহাই দিয়ে প্রশাসনের কেউই নিজে দুনীির্ত করছে না এমনটা বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তারা। তাদের এ বক্তব্য যে একেবারে অমূলক নয় তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন খোদ দুনীির্ত দমন কমিশনের শীষর্ কমর্কতার্রা। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমলারা যদি চেয়ারের মায়া ত্যাগ করে আইনানুগভাবে তাদের সব দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে কারও পক্ষেই দুনীির্ত করা সম্ভব নয়। কেননা অনৈতিক যোগসাজশ ছাড়া কোনো দুনীির্ত সংঘটিত হতে পারে না। আমলাতন্ত্রের দুনীির্ত নিমূের্ল পদ্ধতিগত সংস্কার জরুরি বলে মত দেন তিনি। তবে চলতি টামের্ সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুনীির্ত দমনে মন্ত্রী-আমলাদের পাশাপাশি দলীয় নেতাকমীের্দর সোচ্চার ভূমিকা পালনের কঠোর নিদের্শনা দিলেও বাস্তবে তা কতটা কাযর্কর হয়েছে তা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুনীির্তবাজ সিন্ডিকেটের গতিবিধি পযাের্লাচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায়। এরই মধ্যে যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও ভূমিসহ বেশ কয়েকটি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে দুনীির্ত দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যে চিত্র পেয়েছে, তা রীতিমতো হতাশাজনক। প্রায় প্রতিটি সেক্টরে দুনীির্তবাজ কমর্কতার্রা আগের মতোই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কোথাও রাজনীতিকরা তাদের ওপর ভর করে আগের মতোই নানা অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে। যদিও কোথাও কোথাও দুনীির্তবাজ সিন্ডিকেটের ভিত কিছুটা নড়ে যাওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, দুনীির্ত দমনে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুশিয়ারির পর প্রশাসনের দুনীির্তবাজ সিন্ডিকেট আপাতত ঘাপটি মেরে পরিস্থিতি পযের্বক্ষণ করছে। তাদের আশ্রয়দাতা রাজনীতিকরাও সময়-সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে