শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়া: রাজনৈতিক যত সফলতা এবং ভুল

যাযাদি ডেস্ক
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:১৫
খালেদা জিয়া

১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোন অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেত না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নিবাির্চত হন। এক পযাের্য় সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতা এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান- এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপযর্স্ত এবং দিশেহারা। দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামশর্ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নিয়ে গবেষণাধমীর্ বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ- তার মতে, সেই সময় থেকেই খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে দল তৈরি করেছেন। কিন্তু পরবতীের্ত খালেদা জিয়া সে দলকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। এখন আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দলটাকে এ পযাের্য় এনেছেন খালেদা জিয়া।’ সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় রাস্তায় বেশ সক্রিয় ছিলেন খালেদা জিয়া। ওই আন্দোলন দেশব্যাপী তার ব্যাপক পরিচিতিও গড়ে তুলেছিল। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। ওই সময় খালেদা জিয়াকে বেশ কাছ থেকে দেখেছেন বিএনপির বতর্মান ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, ‘তিনি সবসময় যেটা বলতেন সেটা করতেন... কখনো ওনাকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি।’ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সফলতা এবং ভুলগুলো ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি বিএনপির অধীনে একটি বিতকির্ত নিবার্চনে জয়ী হয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে খালেদা জিয়া পূণর্ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করেছেন দুইবার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন দেশ পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। এমনকি সংসদেও তিনি ছিলেন নতুন। কিন্তু জীবনের প্রথম নিবার্চনেই খালেদা জিয়া পঁাচটি আসন থেকে লড়ে পঁাচটিতেই জয়লাভ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নিবার্চনে অংশ নিয়েছেন, তার কোনোটিতেই পরাজিত হননি তিনি। খালেদা জিয়ার শাসন আমল, ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬- এই দুইভাগে ভাগ করেন অনেক রাজনৈতিক পযের্বক্ষক। আমেরিকার পাবলিক ইউনিভাসিির্ট সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে দুনীির্ত তেমন একটা বিস্তার লাভ করেনি। এছাড়া, ওই সময় তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূণর্ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীদেরকে ঘিরে যে কিছু প্রচলিত সংস্কার ছিল, সে সংস্কারের ব্যারিয়ারগুলো উনি ভেঙ্গে ফেলেছেন। বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় ওনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমার সবসময় মনে হয়।’ কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হবার পর প্রগতিশীল ধারা থেকে দলটি সরে আসে বলে তিনি মনে করেন। ড. সাঈদ বলেন, ‘ওনাকে যেন ক্রমশই আপস করতে দেখা গেছে ধমর্-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং আপসের ফলে আন্তজাির্তক যে মহল- প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য- এ দুই জায়গা থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন,’। ২০০১ সালের সংসদ নিবার্চনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিবার্চনে জয়লাভ করেছিল এবং নিবার্চনের পর জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই সরকার গঠন করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত বিএনপির শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অনেকের ধারণা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও দলের ভেতরে নানা টানাপড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠে। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার জীবন কাহিনী নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অবিচল আস্থা ছিল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তার ক্যারিশমা রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ভুলগুলো কী? -এমন প্রশ্নে মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ নিদর্লীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল তখন খালেদা জিয়ার উচিত ছিল সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে আগাম নিবার্চন দেয়া। এতে করে বিএনপি আরও বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসত বলে তিনি মনে করেন। মাহফুজ উল্লাহর দৃষ্টিতে ২০০১-২০০৬ সাল পযর্ন্ত খালেদা জিয়ার সরকারের কিছু দুবর্লতা ছিল। তিনি বলেন, ‘এই সময়টিতে কিছু কিছু দুষ্টু লোক শাসন পদ্ধতিতে ঢুকে কিছু কিছু কাজকমর্ করেছে যেটার দায় গিয়ে তার ওপর পড়েছে। বিষয়টা তাই হয়। সে সময় যদি তিনি সরকারকে সুশাসনের পথে আরও আনতে পারতেন দৃঢ়তার সঙ্গে, তাহলে পরবতীর্ পযাের্য় যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো ঐভাবে ঘটতো না।’ অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো খালেদা জিয়ার সফলতা বা অবদান যেমন রয়েছে, তেমনি তিনি বিতকর্ বা ভুলের ঊধ্বের্ নন বলে মনে করেন অনেক পযের্বক্ষক। তবে এমন কিছু ভুল তিনি করেছিলেন যেগুলোর মাশুল তার দল বিএনপি এখনও দিচ্ছে অনেকের ধারণা। তবে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় ভুলগুলো, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যেও মতভেদ আছে। রাজনৈতিক পযের্বক্ষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমানকে অতি দ্রæততার সাথে দলের শীষর্ পযাের্য় নিয়ে আসা এবং ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার বিষয়টি বিএনপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় দলের সিনিয়র অনেক নেতার সাথে খালেদা জিয়ার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তারই একটি ফলাফল হিসেবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে দল ছেড়ে গিয়েছিলেন অলি আহমদ, যিনি এক সময় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া ২০০৭ সালে সেনা-সমথির্ত তত্ত¡াবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হবার আগে মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। খালেদা জিয়া যখন রাজনৈতিকভাবে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছিলেন, ওই একই সময়ে তার পারিবারিক ট্র্যাজেডিও ঘটে ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নিবার্চন বজের্নর পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তার বিরুদ্ধে করা দুনীির্তর মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুনীির্তর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত এক বছর ধরে তিনি কারাগারে। তার কারাবাস এতটা দীঘর্ হবে সেটি অনেকেই ভাবেননি। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার শরীরও ভালো যাচ্ছে না। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই সবের্শষ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে অনেকে নানা রকম সমীকরণ করছেন। তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি নিয়ে এখনই কোনো উপসংহারে পেঁৗছতে চান না সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ আজকের বিএনপির তুলনায় কম বিপযর্স্ত ছিল না। বিএনপির দু’জন নেতা (খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান) আজ প্রকাশ্যে অনুপস্থিত। এছাড়া গত আট-দশ বছরে বিএনপির মধ্যে কি কোন ভাঙন হয়েছে? বিএনপি থেকে কি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অন্য দলে চলে গেছেন? কাজেই আমি বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে খুব শঙ্কিত নই।’ তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে- সেটি এখন বেশ অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে মনে করেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এই শিক্ষক এই মুহ‚তের্ খালেদা জিয়ার খুব ভালো কোনে রাজনৈতিক ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ তাকে মুক্ত করার জন্য বিএনপির তরফ থেকে কোনো কাযর্কর রাজনৈতিক চাপ বা আন্দোলন দেখেননি। সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তার অনেকটাই নিভর্র করছে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হয়ে সরকারের উপর কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে তার উপর। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যদি বিএনপি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে না, সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই বলে উল্লেখ করেন আহমেদ। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে