বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
নকশাবহির্ভূত ভবন

উৎকোচ আদায়েই অনিয়মের খোঁজ

ভবন নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ শাখার। এ শাখার পরিচালকের অধীনে পরিদর্শকরা কাজ করেন
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
উৎকোচ আদায়েই অনিয়মের খোঁজ

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ভঙ্গ করে ঢাকার অধিকাংশ স্থানে রাজউকের নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়লেও তা ঠেকাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ এ কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা রাজউকের ইমারত পরিদর্শকরা প্রতিটি নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত ঢু মারছেন। নির্মাণ কাজের ছোট-বড় ত্রম্নটি ও নকশার ব্যত্যয়সহ নানা অনিয়ম তুলে ধরে ভবন মালিকদের বিভিন্ন সময় নোটিশ পাঠাচ্ছেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে তৈরি স্ট্রাকচার স্বেচ্ছায় ভেঙে ফেলা না হলে তা রাজউকের বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ভবন মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও লিখিতভাবে হুশিয়ার করছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক'দিন যেতে না যেতেই এসব হুমকি-ধামকি থেমে যাচ্ছে। বরং অদৃশ্য ইঙ্গিতে রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের অথরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শকদের সঙ্গে ভবন মালিকদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠছে।

ভবনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু উৎকোচ আদায়েই রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নির্মাণ কাজের ভুল-ত্রম্নটি ও অনিয়ম খুঁজে বের করেন। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী উৎকোচ পেলে তারা এসব বিষয় পুরোপুরি চেপে যান। তবে ভবন মালিকদের কেউ এ নিয়ে আপত্তি তুললেই তার ওপর আইনি খড়গ নেমে আসছে।

এ অবস্থায় রাজধানীর অধিকাংশ ভবন মালিক রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে যে যার সুবিধামতো বাহারি ডিজাইনের ভবন নির্মাণ করছেন। ছয়তলা ভবনের পস্ন্যানে অহরহ সাততলা ভবন নির্মিত হচ্ছে। রাজউকের নকশায় প্রতি ফ্লোর দেড় হাজার স্কয়ার ফিট তৈরি করার কথা থাকলেও তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে দু'হাজার স্কয়ার ফিটে। ভবনের সামনে-পেছনেসহ চারদিকে যে পরিমাপে জমি ছেড়ে স্ট্রাকচার নির্মাণের কথা তাও অবলীলায় উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি বারান্দার জায়গায় বাড়িয়ে রান্নাঘর কিংবা লিভিং রুম; ভয়েড ভেঙে বেড রুম তৈরিরও অসংখ্য নজির রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ভবনের রাজউকের অনুমোদিত নকশায় কোনো ভাঁজ পড়ে না। ভবন মালিকরা জানান, রাজউক থেকে নকশা অনুমোদন করে আনার পর অধিকাংশ ভবন মালিকই তা অনেকটা সযতনে তাদের আলমারিতে তুলে রাখেন। এর পরিবর্তে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ভবনের পরিধি বাড়িয়ে নতুন নকশা তৈরি করে তা সাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছে তুলে দেন। যা 'ওয়ার্কিং পস্ন্যান' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তা দেখেই প্রকৌশলীরা ভবন নির্মাণ করছেন। এ সময় রাজউকের পরিদর্শকরা নিয়মিত সাইট পরিদর্শনে আসলেও তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব বিষয় দেখেও না দেখার ভান করছেন। তবে ভবনের ভিত থেকে পিলার মাথা জাগানোর পর তারা একে একে বিভিন্ন ভুলত্রম্নটি ভবন মালিকদের সামনে তুলে ধরছেন। পাশাপাশি এসব অনিয়মের জন্য মোটা অংকের উৎকোচ দাবি করছেন। যা ভবন মালিকরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেননা মূল স্ট্রাকচার নির্মাণের পর তা ভেঙে ফেলে একদিকে যেমন দুষ্কর, অন্যদিকে তেমনি ব্যয় সাপেক্ষ।

হারুন-উর-রশিদ নামের একজন প্রকৌশলী জানান, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ হচ্ছে, এটা বোঝার জন্য প্রকৌশলী হতে হয় না। একটু ভালো করে নির্মাণাধীন ভবনে চোখ বুলালেই তা সহজেই বোঝা যায়। অথচ নির্মাণ কাজের শুরুতে রাজউক পরিদর্শকরা এ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, নির্মাণাধীন ভবনগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায়- কোনো ভবনের সামনে- পেছনে ও দুই পাশে সামান্য জায়গা ছাড়া হয়েছে। আবার এর পাশের ভবনটিই চারদিকে পরিমিত জায়গা ছেড়ে নির্মিত হচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক ভবনের সামনে 'ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য' সাইনবোর্ড থাকলেও বেশিরভাগ ভবনের সামনে এর কোনো নমুনা নেই। অথচ নির্মাণাধীন সব ভবনের সামনে 'ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য' সাইনবোর্ড প্রদর্শন করা রাজউকের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় রাজউকের তালিকায় প্রায় ১৫ হাজার ত্রম্নটিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এসব নকশা ব্যত্যয় ঘটানো ভবনের বেশির ভাগ তথ্য এসেছে সাধারণ মানুষের অভিযোগ থেকে। অথচ নির্মাণ কাজের ভুল-ত্রম্নটি ও অনিয়ম দেখভালের জন্য প্রতিটি জোনে রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক রয়েছে। যাদের কাছ থেকে ভবন নির্মাণের অনিয়ম সম্পর্কে খুবই স্বল্পসংখ্যক অভিযোগ এসেছে।

রাজধানীর ধোলাইপাড় এলাকার একজন ভবন মালিক বলেন, রাজউক থেকে কোনোভাবে নকশা অনুমোদন করিয়ে আনতে পারলেই হলো। এরপর নিজের ইচ্ছামতো ভবন নির্মাণে কোনো সমস্যা নেই। বিশেষ করে যেসব পস্নট প্রধান সড়ক থেকে কিছুটা দূরে কিংবা সরু গলিতে নির্মাণাধীন ভবন মালিকরা আরও বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। কেননা ওইসব গলিপথে বেশিরভাগ সময়ই রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢু মারেন না। তাই সেখানে পরিদর্শকদের ম্যানেজ করতে পারলেই নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনায়াসে ভবন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।

তবে প্রধান সড়কের পাশেও রাজউকের নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণের অসংখ্য নজির রয়েছে। যদিও এসব ভবন মালিকদের কাউকে কাউকে এক বা একাধিক নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। যা শুধু নথিতেই গন্ডিবদ্ধ থাকছে।

রাজধানীর তালতলা মার্কেটের বিপরীতে ৫৫১/সি হোল্ডিংয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার ব্যত্যয় ঘটায় রাজউক কর্তৃপক্ষ ভবন মালিক মো. ইকবাল গং বরাবরে নোটিশ পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভবনটির ডান পাশে ২ দশমিক ০৬ মিটারের পরিবর্তে ১ দশমিক ৬৫ মিটার এবং বাম পাশে ১ দশমিক ৭৭ মিটারের পরিবর্তে ১ দশমিক ০৪ মিটার জায়গা রাখা হয়েছে। এছাড়া ৪ দশমিক ২২ বাই ৪ দশমিক ৩৫ মিটার এবং ৩ দশমিক ৩৫ বাই ১ দশমিক ৮২ মিটার ভয়েড অননুমোদিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যা অপসারণ করার জন্য বলা হলো।

সাত দিনের মধ্যে নকশা বহির্ভূত অংশ ভেঙে ফেলা না হলে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ এর ধারা ৭ মোতাবেক রাজউক কর্তৃপক্ষ তা ভেঙে ফেলবে। ইমারত নির্মাণ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ভেঙে অপসারণ বাবদ যাবতীয় খরচ ভবন মালিকের কাছ থেকে আদায় করা হবে।

এই নোটিশের অনুলিপি রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ), পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২), পরিচালক (জোন-৬) এবং ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৯ জনের কাছে পাঠানো হয়েছে। উলেস্নখিত ভবনে ইউলিটি সার্ভিস না দেয়ার জন্যও সব সেবা সংস্থা বরাবরে অনুরোধ জানানো হয়।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উলিস্নখিত ভবন মালিককে এ ধরনের নোটিশ পাঠানো হলেও নকশা বহির্ভূত অংশ ভেঙে ফেলা দূরে থাক, ওই কাজ বন্ধ রাখারও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং তোড়জোড়ে এ ভবনটির ফিনিসিং কাজ এগিয়ে চলছে।

চূড়ান্ত নোটিশ দেয়ার পরও ওই ভবন মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ব্যাপারে রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের পরিদর্শক তামান্না ইসলামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি।

শুধু এ ভবনটিই নয়, এ ধরনের চূড়ান্ত নোটিশ দেয়ার পর রাজউকের ইমারত পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে অহরহ নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে নকশা বহির্ভূত অংশ ভেঙে ফেলারও সামান্য কিছু নজির রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ভবন নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ শাখার। এ শাখার পরিচালকের অধীনে পরিদর্শকরা কাজ করেন। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতনরা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<41678 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1