শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধানের গোলা

নতুনধারা
  ১২ জানুয়ারি ২০২১, ২০:৫৬

‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ’ গ্রাম নিয়ে প্রচলিত প্রবাদটি আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও এখন দেখা পাওয়া যায় না বাংলার ঐতিহ্য ধান, গমসহ ফসল সংরক্ষণের গোলার। মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে এখন নেই ধান, গম মজুত করে রাখার বাঁশ-বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি গোলাঘর। দেশের একেবারে দক্ষিণে ভারত সীমান্তঘেঁষা জেলা ঝিনাইদহ। এ জেলার বেশির ভাগ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। একসময় এখানে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কয়টি ধানের গোলা আছে এই হিসাব কষে।

কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের বাড়ি থেকে ধানের গোলার খবর নেওয়া হতো। যা এখন রূপকথা। গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে গোল আকৃতির তৈরি করা ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। গোলার মাথায় থাকত টিনের তৈরি পিরামিড আকৃতির টাওয়ারের মতো, যা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন আর গোলা নির্মাণ শ্রমিকদের দেখা মেলে না।

পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে দক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি বাঁশের ধানের গোলা একসময় গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও কালের বিবর্তনে তা বিলুপ্তির পথে। মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তনের ফলে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাদের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। ফলে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের ধানের গোলার জায়গা দখল করে নিয়েছে পাটের বস্তা আর টিন বা প্লাস্টিকের তৈরি ড্রাম। এগুলো তৈরি ঝামেলামুক্ত ও সহজে বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষ বাঁশের গোলার পরিবর্তে এসব আধুনিক উপকরণ ব্যবহারে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশের গোলার কদর। গ্রামবাংলার বাঁশের গোলার চাহিদা কমে গেলেও কিছুটা ব্যতিক্রম ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ভবনগর গ্রাম। গ্রামের কিছু বাড়িতে দেখা গেছে ধানের গোলা। গ্রামের কৃষকরা বলছেন, তারা এখনো অনেকে গোলায় ধান রাখেন। আবার অনেকের গোলা পরিত্যক্ত। তবে তারা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন।

জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরের শ্যামকুড় ইউনিয়নের ভবনগর গ্রামে পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস। কৃষকরা আশপাশের চারটি মাঠে ফসল ফলান। গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, মাঠগুলোতে দুই হাজার বিঘা চাষযোগ্য জমি রয়েছে। আগে এক হাজার ২০০ বিঘায় ধানের চাষ হতো, বাকি জমিতে ফলত অন্যান্য ফসল। বর্তমানে ধান চাষ কমে ৪০০ বিঘায় দাঁড়িয়েছে। যে কারণে গোলার ব্যবহার কমে গেছে। তিনি নিজেও ধান গোলায় রাখতেন, এখন আর রাখেন না।

কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের হেলাল উদ্দীন জানান, গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গোলাগুলো আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বহন করে। আমার দাদার আমল থেকে দেখে এসেছি এগুলো। ধান রাখার পাশাপাশি ঐতিহ্য রক্ষায় তাই এখনো রেখে দিয়েছি।

কোটচাঁদপুর উপজেলার সারুটিয়া গ্রামের গৃহবধূ মিম খাতুন জানান, আমাদের বাড়িতে একসময় ধানের গোলা ছিল; এখন আর নেই। তবে আমার চাচার বাড়িতে এখনো একটি গোলাঘর রয়েছে। জেলার প্রবীণরা বলছেন, আগের দিনে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গোলা থাকত। এখন আর নেই। নাতি-নাতনিদের কাছে বললে তারা বিশ্বাসও করতে চায় না।

প্রবাদের সেই গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ এখনো আছে। দেশের প্রতিটি কৃষক পরিবারে রয়েছে কমপক্ষে একটা, দুটি গরু, পুকুরও আছে অনেকের। শুধু কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধানের গোলা।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে