রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অসময়ের বৃষ্টিতে ফসলের সর্বনাশ

আলতাব হোসেন
  ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৫

টানা তিন দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে চট্টগ্রামে। আবহাওয়া অফিস বলছে, চট্টগ্রামে এবার গত ৩৮ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে ১৯৮৫ সালে পার্বত্য এলাকায় এরকম বৃষ্টি হয়েছিল। চলতি বছরের ২ জুন সিলেটে ৮ বছরের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ ৩০৭ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছিল। এটিকে চলতি মৌসুমে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর এই অসময়ের বৃষ্টিতে ফসলের সর্বনাশ হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক।

২০২০ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।

রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরুতে স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙে শীতে তাপমাত্রা নেমে আসে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তারপর শরৎকালে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। অথচ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারা দেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।

এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আমিনুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মানুষ। শীতও তার প্রচলিত সময়ের নিয়ম মানছে না। আবার বন্যাও ব্যাকরণ ভুলে হানা দিচ্ছে অসময়ে। এর প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে একেক বছর একেক ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত পাঁচ বছরের আবহাওয়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়ছে। অসময়ে একই সঙ্গে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গঙ্গা অববাহিকায় প্রায় বছরই রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যে, প্রতিবছর এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ওই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ১৯৫০ সাল থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক দ্য লোভেনের তথ্য অনুসারে, ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ২২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার। জুলাইয়ে ভারতের দিল্লিতে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ১৯৮২ সালের পর থেকে দিল্লিতে জুলাই মাসে এত বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টিতে ১২ জনের প্রাণহানি হয়।

এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা-মাছ গিয়ে ডিম পাড়ে।

এ সময় পাট জাগ দিতেও প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে স্বাভাবিকের চায়েও গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতিবছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। হেমন্তের বৃষ্টি অস্বাভাবিক এবং কৃষির জন্য ক্ষতিকর।

এ বিষয়ে পরিবেশবিদ গোলাম আব্দুস সাত্তার বলেন, ২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওড়ের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে যায়। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। বাংলা চৈত্র মাসে আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি হয়। এতে আগাম বন্যায় আঘাত হানে শস্যভান্ডার খ্যাত দেশের হাওড়াঞ্চলে। অসময়ের বন্যায় হাওড়ের ফসলহানি হয়। এতে ধানের দেশ হিসেবে পরিচিত হাওড়াঞ্চলে ভাতের আকালে পড়েন ধনাঢ্য কৃষকরা। ২০১৮ সালের অক্টোবরেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। ওই বছর পাহাড়ে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের জুনে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রত্যাশার চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে ৩৪ দশমিক চার ভাগ কম। অথচ ২০২০ সালের অক্টোবরে (মধ্য আশ্বিন-কার্তিক) ৪৬ দশমিক ১ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে দেশে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন দেশের কৃষক। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জসহ হাওড়াঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছেন, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের শুরুতে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নামে। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের প্রস্তুতিও থাকে ওই সময়কে ধরে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রত্যাশার চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে ১৩ দশমিক চার ভাগ কম। পুরো বাংলাদেশে তখন ১৫ হাজার ৬১৯ মিলিমিটারের চেয়ে দুই হাজার ১০০ মিলিমিটার কম বৃষ্টি ঝরেছে।

অথচ পরের বছরের অক্টোবরে (মধ্য আশি^ন-কার্তিক) ৪৬ দশমিক এক ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে জুলাই মাসের বৃষ্টির হিসাব তো আরও কম। ওই মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আশা ছিল, বাংলাদেশে ১৭ হাজার ৭৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। সে জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৮ মিলিমিটার। অর্থাৎ স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে পাঁচ হাজার ২৮৬ মিলিমিটার বা ২৯ দশমিক সাত ভাগ কম। ২০১৯ সালের ভরা বর্ষাকাল মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য শ্রাবণ, অর্থাৎ বছরের জুলাই মাসে প্রায় ৩৪ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছে, যা ২০১৩ সালের চেয়ে চার ভাগ কম।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে