মাস তিনেক নির্বাচনী ঢামাঢোলে মঞ্চের ব্যস্ততা কমে গিয়েছিল। এখন নির্বাচনী ঢামাঢোল শেষ। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সরব হয়ে উঠছে আবার শিল্পকলা একাডেমি, মহিলা সমিতিসহ সারা দেশের থিয়েটারগুলো।

গত বছর ৭০টির বেশি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। এবার ২০২৪ সালে এসে এর সংখ্যাটা আরও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন মঞ্চকর্মীরা। নিয়মিত চর্চা করে, এমন প্রায় সব বড় দলই নতুন নাটকের প্রস্তুতি নিয়েছে। চলছে মহড়াও। তবে বেশিরভাগ নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনীর তারিখ কিংবা মাস ঠিক হয়নি। এ বছর নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বরেণ্য এই নাট্যজনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্বপ্নদল তার নাটক নিয়ে আসবে। ১৮ আগস্ট অনুষ্ঠেয় ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মোৎসব ২০২৪’-এ নাটকটি মঞ্চে আসতে পারে। ১৫ এপ্রিল মেঘদূত নাট্যদল মঞ্চে নিয়ে আসবে গৌতম হালদার নির্দেশিত, অপূর্ব কুমার কুন্ডুর লেখা নাটক ‘আব্রাহাম লিংকন’।

মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় নিয়ে আসবে নতুন নাটক ‘ড. হ্যানিম্যান’। ‘মহাকালের শিখণ্ডী কথা’ নাটকের ২০০তম মঞ্চায়ন হবে এ বছর। গত বছরের শেষ, অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর তারা মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘সুরেন্দ্র কুমারী’। আনন জামানের লেখা এবং শামীম সাগর নির্দেশিত নাটকটি নতুন বছরে নতুন নাটক হিসেবে অনেক দর্শকের আগ্রহের বিষয় হতে পারে।

বছর শেষে নভেম্বর মাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উদ্যোগে ‘আলী যাকের নতুনের উৎসব’-এ একসঙ্গে পাঁচটি নতুন নাটক যোগ হবে মঞ্চে। গত বছর এই দলের পৃষ্ঠপোষকতায় মঞ্চে সব নাটকই সাড়া ফেলে।

ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে নাটকের দল থিয়েটার, এ বছর পালা নাটক নিয়ে আসবে তারা। নাটকের দল অনুস্বর প্রতিষ্ঠা করেছে নিজস্ব স্টুডিও থিয়েটার। চলতি বছর নিজেদের স্টুডিওকে নতুন করে সাজাবে তারা। পাশাপাশি দুটি নতুন নাটক আনার পরিকল্পনা রয়েছে এই দলের।

বাতিঘর থিয়েটার ফেব্রুয়ারি নিয়ে আসবে দলের ১৭তম প্রযোজনা মুক্তনীল নির্দেশিত নাটক ‘প্যারাবোলা’। তীরন্দাজ রেপার্টরি কৃষণ চন্দরের ‘ম্যায় গাধা হুঁ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘আমি গাধা বলছি’ নাটকের প্রযোজনা করছে। গত দুই মাস তারা মহড়া করেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এটি মঞ্চে আনবে তারা। মণিপুরী থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ আনছে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায়। থিয়েটার আর্ট ইউনিট মার্চ মাসে ফোকধর্মী নতুন নাটক নিয়ে আসছে। তবে এখনই নাটকের নাম বলতে নারাজ দলের সদস্যরা। আরণ্যকও নতুন নাটকের জন্য কর্মশালা করেছে। তবে এখন নাটকের নাম চূড়ান্ত হয়নি।

চট্টগ্রামের নান্দীমুখ এ বছর দুটি নতুন নাটক আনবে। ফেব্রুয়ারিতে তারা নিয়ে আসবে অভিজিৎ সেনগুপ্তর নির্দেশনায় নাটক ‘অর্ফিয়ুস’। এপ্রিলে আসবে এ দলের নতুন নাটক ‘ডেঞ্জারাস গেম’। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নাট্যোৎসবের পরিকল্পনা করছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। আসবে দেশের বাইরের বিভিন্ন নাটকের দল। সব মিলে নতুন বছরটি মঞ্চনাটকের জন্য জমজমাট একটি বছর হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তবে এবারে শীতকালীন মঞ্চনাটকের প্রদর্শনী একটা ভিন্ন মাত্রা পাবে না সব দিক থেকেই। নির্বাচনোত্তর নতুন সরকার ব্যবস্থা এবং থিয়েটার কর্মীদের নতুন উদ্দীপনায় একটা ভিন্ন মাত্রার আমেজ নিয়ে আসবে এ বছরের মঞ্চপ্রদর্শনীতে।

দেশের সিনেমায় ও টিভি নাটকে অনেক পরিবর্তন আসলেও মঞ্চ নাটক যেহেতু মেলোড্রামা ছাড়া চলেই না সে কারণে মঞ্চনাটক আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখনও ভাস্বর হয়ে আছে। একটা সময় ছিল যখন দেশের সিনেমা ও টিভি নাটকে মঞ্চ নাটকের শিল্পীদেরই প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। টিভিতে যত নাটক হতো তাতে অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের অভিনয় দেখেই বোঝা যেত কে কে মঞ্চের অভিনয় শিল্পী আর কে নয়। ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, তারিক আনাম খান, পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মামুনুর রশীদ, খালেদ খান (প্রয়াত), মমতাজ উদ্দীন আহমদ (প্রয়াত), ড. ইনামুল হক (প্রয়াত), আতাউর রহমান, শিমুল ইউসুফ, নিমা রহমান প্রমুখ অভিনয় শিল্পীরা তো তাদের টিভির অভিনয়ে পুরোপুরিই মঞ্চে অভিনয়ের ছাপ থাকাটা স্বাভাবিকই বানিয়ে ফেলেন। তবে এর বাইরেও আরও অনেক মঞ্চ থেকে আসা অভিনয় শিল্পী ছিলেন যাদের অভিনয় মঞ্চের মেলোড্রামা সুরের অভিনয় থেকে অনেকটা আলাদা করে নিতে পেরেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আফজাল হোসেন, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, খায়রুল আলম সবুজ, মান্নান হীরা, লাকী ইনাম, জাহানারা আহমেদ, দিলারা জামান, তানভীন সুইটি, মনিরা ইউসুফ মেমী, সালাহউদ্দিন লাভলু, জাহিদ হাসান, চঞ্চল চৌধুরী প্রমুখ।

এই মঞ্চের শিল্পীরাই সেই ষাট দশক থেকে যাত্রা করা বিটিভি দর্শকের বিনোদনের চাহিদা মিটিয়েছে গোটা নব্বই দশক পর্যন্ত। এখন যেহেতু বাইরে থেকেই প্রচুর পারফর্মার আসছে ছোটপর্দা বা সিনেমায় ফলে এখন বর্তমানে ছোটপর্দা ও সিনেমায় থিয়েটারকর্মীদের এখন থিয়েটার নিয়েই থাকতে হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন থিয়েটারেই থেকে গেছেন কিন্তু সিনেমা বা টিভিতে তেমন একটা পা বাড়াননি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শিমুল ইউসুফ। তিনি মাত্র কয়েকটি টিভি নাটক করেছেন। সেটাও নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের কথায়। তবে যারা এক সময় মঞ্চ এবং টিভি বা সিনেমা দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে গেছেন তারা সময়ের হেরফেরে এখন টিভি বা সিনেমার চাহিদা মিটাতে পারছেন না। এ কারণেই এক সময় যারা একই সঙ্গে মঞ্চে ও ছোটপর্দায় অভিনয় করতেন তাদের বেশিরভাগকে ফোন করে কাজের কথা জানতে চাইলে বলেন, ছোটপর্দায় তারা নতুন কোনো কাজ করছেন না। তার মানে তারা নতুন কোনো কাজ পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে এক সময়ের ছোটপর্দার নিয়মিত শিল্পী তানভীন সুইটিকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, এখন নতুন কোনো কাজ করছেন না। মাঝে একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছেন।

এক সময়ের ছোটপর্দার নিয়মিত অভিনেত্রী লাকী ইনাম এখন ছোটপর্দায় কোনো অভিনয় করেন না। যিনি ছিলেন ধারাবাহিক নাটকের জনপ্রিয় মুখ তাকে দেখা যায় না এখনকার কোনো ধারাবাহিকেই।

যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, এখন তিনি মঞ্চ নিয়েই স্বপ্ন দেখেন সেজন্য টিভি নাটক কমিয়ে দিয়েছেন। নিজে থেকেই কমিয়ে দিয়েছেন নাকি তার মতো অভিনয়ের উপযোগী করে কোনো চরিত্রের সৃষ্টি করে তাকে ডাকা হচ্ছে না বলেই ছোটপর্দায় অভিনয় করছেন না- কোনটা? এ নিয়ে অবশ্যই আলাদা ব্যাখ্যা দাবি রাখে কেন মঞ্চ থেকে আসা এক সময়ের ছোটপর্দার ব্যস্ত অভিনয় শিল্পীরা মঞ্চেই থিতু হচ্ছেন আবার।

যাযাদি/ এস