রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছাদবাগানে মাটি প্রস্তুত প্রণালি

পৃথিবীর অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দ্রম্নত নগরায়ণ ঘটছে। সঙ্গত কারণেই তাই ছাদবাগানের গুরুত্ব বাড়ছে। পাকা বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শাকসবজি, ফুল-ফলের বাগান গড়ে তোলাকে ছাদবাগান বলা হয়। ছাদবাগানে যেমন ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রোপণ করা যায়, তেমনি ফল, শাকসবজি, মশলা, ঔষধি গাছসহ নানাবিধ উদ্যান ফসলও চাষাবাদ করা যায়। এতে করে একদিকে টাটকা ও নিরাপদ খাবারের সংস্থান করা যায়, অন্যদিকে শহুরে যান্ত্রিক জীবনেও সুশীতল ছায়া, পশুপাখির আশ্রয়, খেলা ও বিনোদনের স্থান নিশ্চিত করা যায়। খোরাক জোগায় অবসরের। আমরা বাজার থেকে যেসব ফল ও শাকসবজি কিনে খাই তাতে নানা ধরনের রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ থাকে- যা অনেক সময় নানাবিদ স্বাস্থ্যঝুঁঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দেশে ছাদবাগান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজধানীতে ছাদবাগান দিন দিন বাড়ছে। ছাদে এখন শুধু ফুল বা বাহারি গাছ নয়, শাকসবজি, ফলমূল সবই চাষ করা হচ্ছে। শুধু রাজধানী নয় বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ির ছাদে বাগান করা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছাদবাগানের প্রতি নগরবাসীর আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বহুমাত্রিক সুবিধা ও সাফল্যের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোদ বা গরম সহ্য করতে পারে এমন গাছই ছাদে বপন করা উত্তম। ছাদে বাগান করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নিয়মিত পানি সেচ দেয়া। কারণ, বাগানের গাছগুলো যেহেতু সাধারণ মাটির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে তাই নিয়মিত পানি সেচ না দিলে গাছগুলো যে কোনো সময় মারা যেতে পারে। সাধারণত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে গাছ ভালো জন্মে। ছাদে বাগান করতে হলে এ ধরনের মাটি ব্যবহার করলে ভালো হয়। শখ করে আমাদের দেশে ছাদে বাগান করার প্রথা শুরু হলেও এখন রীতিমতো অর্থনৈতিক খাত হিসেবে চিহ্নিত।

অনেকেই আছে যারা বাড়ির ছাদে বাগান করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে। ইচ্ছে করলেই শহরবাসী ফলের বাগান বা সবজি বাগান করতে জমি পান না। তাই বিকল্প উপায় বের করে আবাদি জমি নষ্ট না করে ছাদকে কাজে লাগিয়ে বাগান করা যায়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে এই ছাদে বাগান যা পরিবারকে করবে স্বচ্ছল। পৃথিবীর অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দ্রম্নত নগরায়ণ ঘটছে। সঙ্গত কারণেই তাই ছাদবাগানের গুরুত্ব বাড়ছে। পাকা বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শাকসবজি, ফুল-ফলের বাগান গড়ে তোলাকে ছাদবাগান বলা হয়। ছাদবাগানে যেমন ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রোপণ করা যায়, তেমনি ফল, শাকসবজি, মশলা, ঔষধি গাছসহ নানাবিধ উদ্যান ফসলও চাষাবাদ করা যায়। এতে করে একদিকে টাটকা ও নিরাপদ খাবারের সংস্থান করা যায়, অন্যদিকে শহুরে যান্ত্রিক জীবনেও সুশীতল ছায়া, পশুপাখির আশ্রয়, খেলা ও বিনোদনের স্থান নিশ্চিত করা যায়। খোরাক জোগায় অবসরের। আমরা বাজার থেকে যেসব ফল ও শাকসবজি কিনে খাই তাতে নানা ধরনের রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ থাকে- যা অনেক সময় নানাবিদ স্বাস্থ্যঝুঁঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ছাদবাগানের ফসল নিরাপদ রাখার জন্য জৈবিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বালাইনাশক এবং রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করা নিরাপদ।

ছাদবাগানের প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ হলো হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, স্টিল বা পস্নাস্টিক ট্রে, স্থায়ী বেড, সিকেচার, কোদাল, কাঁচি, ঝরনা, বালতি, করাত, খুরপি, স্প্রে মেশিন, পাইপ প্রভৃতি। মাটি তৈরির জন্য দোঁআশ মাটি, পচা গোবর ও কম্পোস্ট, বালু ও ইটের খোয়া প্রয়োজন হয়। এছাড়াও ছাদবাগানর জন্য গাছের চারা বা কলম ও বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ইত্যাদি দরকার হয়। ছাদবাগানে ফসল নির্বাচনে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলো- মূলের গভীরতা কম এমন ফসল, সারা বছর ফলন দেয়, যে সব ফসলের পানির চাহিদা কম, বারোমাসি ফলের জাত, উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত, খর্বাকার ফলের জাত ছাদবাগানের জন্য উত্তম। ছাদবাগানে মিশ্র ফসল চাষ করা ভালো। সালাদ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল যেমন- মরিচ, লেবু, ধনিয়াপাতা, পুদিনাপাতা, শসা, টমেটো ইত্যাদি ছাদবাগানে চাষ করা যেতে পারে। ছাদে গাঁদাফুল, পুদিনা, তুলসী, লেমনগ্রাস লাগানো থাকলে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। এছাড়াও কুমড়া গোত্রের লতানো সবজি ছাদে ভালো হয়।

ছাদবাগানে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মাটি প্রস্তুত করা। ছাদবাগানের মাটি তৈরিতে নিচের শুরুতে উপদানসমূহ ধারাবাহিকভাবে মিশিয়ে নিতে হবে- রোদে শুকানো দোআঁশ মাটি (এক তৃতীয়াংশ), ভার্মিকম্পোস্ট বা জৈবসার (এক তৃতীয়াংশ) এবং কোকোডাস্ট বা ধানের চিটা (এক তৃতীয়াংশ)। ওই মিশ্রণের সঙ্গে হাড়ের গুঁড়া-১ কেজি বা ঘনমিটার, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি সার-২০০-৫০০ গ্রাম প্রতিটি বা ঘনমিটার হারে মিশাতে হবে। মাটি এসিডিক হলে গাছ লাগানোর আগে ডলোচুন ১ গ্রাম বা ২ কেজি হারে মাটির সঙ্গে মিশাতে হবে। জৈবসার মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। কোকোডাস্ট বা ধানের চিটা মাটিতে বায়ু চলাচল বাড়ায়- যা গাছের শিকড় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ছাদবাগানের পোঁকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য মাটি তৈরি হতে শুরু করে সব পর্যায়ে সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। ছাদবাগানে মাটি তৈরির সময় মাটিতে সব ধরনের জৈব ও রাসায়নিক সার মিশানোর পর ফুরাডান বা সেভিন ১ থেকে ২ গ্রাম হারে প্রতি ৫ কেজি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে মাটির ক্ষতিকর পোকামাকড় ও কৃমি মারা যায়। এর সাতদিন পর মাটিতে ট্রাইকোডার্মাভিত্তিক অনুজীব জৈব বালাইনাশক মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে বা মাটিতে স্প্রে করা মাটিবাহিত জীবণুসমূহ দমন করা যায়। এরপর মাটি ১৫ দিন রেখে দিয়ে গাছ বা চারা লাগাতে হবে।

ছাদবাগান পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। ভবনের তাপমাত্রা কমায় কমপক্ষে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অবকাঠামো তৈরিতে যে জমি নষ্ট হয় ছাদে বাগানের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পুষিয়ে নেওয়া যায়। ছাদবাগান বায়ো-ডাইভারসিটি সংরক্ষণ করে, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে এবং বায়ু ও শব্দ দূষণ কমায়। ছাদবাগান বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যেতে বাধা দেয় এবং নগরে জলাবদ্ধতা কমায়। সর্বোপরি ছাদবাগান নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করে। তাই শহরের প্রতিটি বাড়ির ছাদে ছাদবাগান গড়ে তুলতে পারলে আমরা সবাই লাভবান হতে পারব।

লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে