শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পাটজাতীয় আঁশ ফসলের গুণগত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন

বীজ পেতে হলে ডগা রোপণ পদ্ধতিতে পাটগাছ লম্বায় বৃদ্ধি কম হলেও অধিক সংখ্যক ডালপালাসহ সুপুষ্ট ফল ও উন্নতমানের অধিকসংখ্যক বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে তোষা জাতের পাট বীজ ফাল্গুন মাসের ৩য় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহের মধ্যে মাতৃগাছের জন্য বীজ বপন করতে হয়। ডগা সংগ্রহের সময় শ্রাবণে মাতৃগাছের জমি থেকে সুস্থ ও সবল গাছ বেছে নিতে হবে। তবে যে সব মাতৃগাছে ফুল ধরেনি কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ফুল আসবে, সেসব গাছের কান্ড ও ডগা নির্বাচন করতে হবে।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. আল-মামুন
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পাট বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তাজাতীয় পাট ফসল চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৃষকের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় এ বছর পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের বীজের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারিত হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৯ টন। এর মধ্যে বিএডিসি সরবরাহ করবে ১ হাজার ৩০০ টন বীজ, আর প্রায় ৫ হাজার ২০০ টন বীজ ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। উলেস্নখ্য, গত ২০২২-২৩ উৎপাদন বছরে ৪ হাজার ১৬৬ টন পাট ও কেনাফ ফসলের বীজ আমদানি করা হয়েছিল ভারত থেকে। এভাবে প্রতি বছর পাট ও কেনাফ বীজ আমদানি করতে প্রায় ৫ থেকে ৭ শত মিলিয়ন টাকার বিশাল বাজার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাছাড়া অনেক সময়ই কৃষক বীজের গুণাগুণ সম্পর্কে না জেনে, মাঠে বপন করে কাঙ্ক্ষিত ফলন না পেয়ে প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশে পাট ও কেনাফ বীজ উৎপাদনে সাবলম্বী হওয়া এবং নিজের বীজ নিজেই উৎপাদন করে কৃষকরা যাতে অধিক লাভবান হতে পারেন, সেজন্য উন্নতমানের পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের বীজ উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকা দরকার।

পূর্বে পাটের আঁশ ফসলের ক্ষেতের এক কোণায় কিছু পাটগাছ বীজ উৎপাদনের জন্য রেখে যথাসময়ে সে গাছ থেকে পাট বীজ সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু আঁশ ফসলের গাছ দীর্ঘদিন মাঠে থাকার ফলে ঝড়, শিলাবৃষ্টি, বন্যা, রোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণে গাছ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সেই গাছ থেকে ভালো গুণাগুণ সম্পন্ন বীজ পাওয়া যায় না। অধিকন্তু কম আলোকসংবেদনশীল তোষা পাটের জাত উদ্ভাবনের ফলে এখন আর পূর্বের মতো বীজ উৎপাদন করা হয় না। তবে এখনো দেশি পাটের বীজ তুলনামূলকভাবে দেরিতে ( মে-জুন) বপন করে একই সঙ্গে বীজ ও আঁশ উৎপন্ন করা যায়।

নাবী শব্দের অর্থ দেরিতে বীজবপন করে পাট গাছের দৈহিক পর্যায়ের বৃদ্ধির সময় কমিয়ে, প্রজনন পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এর ফলে পাটগাছ লম্বায় কম হয় কিন্তু অধিক ডালপালাসহ সুপুষ্ট ফল ও বীজ পাওয়া যায়। তিনটি পদ্ধতিতে নাবী পাট বীজ উৎপাদন করা যায়। সরাসরি বীজবপন পদ্ধতিতে উঁচু জমিতে যেখানে বৃষ্টি হলেও পানি জমে না, সারাদিন রৌদ্র থাকে এ রকম জমিতে দেশি পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের বীজ শ্রাবণ (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট) এবং তোষা পাটের বীজ ভাদ্র (মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর) মাসের মধ্যে বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহে ১৫ দিন আগে বীজবপন করতে হবে। কেননা, শীত ওই অঞ্চলে আগে আসে।

বীজ পেতে হলে ডগা রোপণ পদ্ধতিতে পাটগাছ লম্বায় বৃদ্ধি কম হলেও অধিক সংখ্যক ডালপালাসহ সুপুষ্ট ফল ও উন্নতমানের অধিকসংখ্যক বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে তোষা জাতের পাট বীজ ফাল্গুন মাসের ৩য় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহের মধ্যে মাতৃগাছের জন্য বীজ বপন করতে হয়। ডগা সংগ্রহের সময় শ্রাবণে মাতৃগাছের জমি থেকে সুস্থ ও সবল গাছ বেছে নিতে হবে। তবে যে সব মাতৃগাছে ফুল ধরেনি কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ফুল আসবে, সেসব গাছের কান্ড ও ডগা নির্বাচন করতে হবে। গাছ নির্বাচনের পর ডগাগুলো ধারালো চাকু বা বেস্নডের সাহায্যে তেরচা করে কেটে নিতে হবে। প্রতিটি ডগার দৈঘ্য ১৫ থেকে ২০ সে. মি. হতে হবে। ডগা কাটার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কাটা জায়গা থেতলে না যায় এবং যেদিন ডগা সংগ্রহ করা হয়েছে সেদিনই উহা যেন রোপণ করা হয়। তবে মেঘলা দিনে বা পড়ন্ত রোদে ডগা রোপণ করা উত্তম। ডগা বা কান্ড সারি করে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি, যেখানে বন্যার পানি উঠে না বা ঘন ঘন বৃষ্টি হলেও পানি দাঁড়ায় না, সে ধরনের জমিতে রোপণ করতে হবে। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০ সে. মি. এবং ডগা থেকে ডগার দূরত্ব ১০-১৫ সে. মি. হতে হবে। প্রতিটি ডগার প্রায় ১ থেকে ৩ ভাগ পরিমাণ অংশ ৪৫ ডিগ্রি কোণে অর্থাৎ তীর্যকভাবে মাটির নেচে পুতে দিতে হবে।

চারা রোপণ পদ্ধতিতে শ্রাবণ মাসের মধ্যে ৩ মি. দৈর্ঘ্য ও ১ মি. প্রস্থ আকারের বীজতলায় ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম বীজ বপন করে চারা উৎপন্ন করা হয়। শ্রাবণ মাসে বপনকৃত বীজ থেকে উৎপাদিত চারার বয়স ২৫-৪০ দিন হলে চারাগুলো ভাদ্র মাস থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোপণ করা যায়। বীজতলা থেকে চারা তুলে নিয়ে ছায়ায় রাখতে হবে। প্রতিটি চারার ডগায় ২ থেকে ৩টি পাতা রেখে অন্যান্য সব পাতার বোঁটা বাদে বাকি অংশ ফেলে দিতে হবে। বীজতলা থেকে চারা তোলার দিনই মূল জমিতে চারা রোপণ করা ভালো। মূল জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সে. মি. বা ১ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ১০-১৫ সে. মি. বা প্রায় ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি করে চারা রোপণ করতে হবে। মেঘলা দিনে অথবা সন্ধ্যার আগে যখন রোদ থাকে না তখন চারা রোপণ করা উচিত। এটি একটি আপদকালীন প্রযুক্তি বিশেষ করে বন্যাপরবর্তী পাট বীজ উৎপাদনের জন্য উত্তম।

মাঝে মাঝে আঁচড়া বা নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে করে দিতে হবে। ২য় কিস্তির সার প্রয়োগের ২/১ দিন পূর্বে নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। শেষ বা ৩য় কিস্তির সার প্রয়োগের পূর্বে আর একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছের আগামরা বা কান্ড পচা রোগ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে রোগাক্রান্ত গাছসমূহ উপড়ে ফেলতে হবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

৭০-৮০ শতাংশের রং বাদামি ধারণ করলে গাছের গোড়া থেকে রৌদ্রজ্জ্বল সকাল বেলা কেটে ক্ষেতে বিছিয়ে রেখে বিকাল বেলা সংগ্রহ করে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে রাত্রিতে বড় কোনো গাছের ছায়ায় বা কোনো ত্রিপল দিয়ে বায়ু চলাচল করতে পারে এমনভাবে ঢেকে রাখতে হবে। পরের দিন পুনরায় আঁটি শুকাতে হবে যেন ২৪ ঘণ্টায় পাট বীজের মধ্যে থাকা প্রায় ৩৫% আর্দ্রতা অর্ধেকে নেমে আসে। এভাবে দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে ৫ দিন শুকাতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা ৭-৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে এবং শুকানোর পর চালের মতো দুই থেকে একটা পাট বীজ মুখে নিয়ে কামড় দিলে কট করে শব্দ হলে বোঝা যাবে বীজ শুকিয়েছে। বীজের সমায়তনের পস্নাস্টিক বা টিনের পাত্রে ভালোভাবে বায়ুরোধী করে মুখ বন্ধ করে বীজ সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি বীজের জন্য ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে শোধন করে রাখলে বীজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং পরবর্তী বপন মৌসুমে বীজ ভালোভাবে গঁজিয়ে থাকে।

কৃষক ভাইয়েরা নিজেদের উদ্যোগে যে বীজ উৎপাদন করে থাকেন তা যদি উপযুক্ত সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে কর্তন এবং সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদিত বীজের গুণগত মান খারাপ হবে, অন্যদিকে, বীজের অপচয় হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদন বৃদ্ধিতে ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকদের কাছে সব সুবিধা দ্রম্নত পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের দেশে অন্তত ১০ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ সম্ভব। এছাড়া শুধু ভালো মানের বীজ ব্যবহার করে শতকরা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি করা যায়। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব পাট শিল্পের এ বৈপস্নবিক পরিবর্তন দ্রম্নতই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে এবং বিশ্ববাজারে একটি উলেস্নখযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ,

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে