রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সবজি ফসল ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হচ্ছেন কৃষক

কুমড়া পরিবারের অধিকাংশ সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গাছে স্ত্রী ফুল ফোটার কিছুদিন পর ফল পচে যায় বা ঝরে যায়। পোকা ও মৌমাছির অনুপস্থিতিতে পরাগায়ন না হওয়ার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই কৃত্রিম উপায়ে এসব ফসলের পরাগায়ন করা দরকার। ফল ধারণের জন্য হাত দিয়ে ফলের পরাগায়ন করতে হয়। সকালের অথবা বিকালের দিকে একটি সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল নিয়ে ফলের পুংকেশর ঠিক রেখে পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হয়। তৎপর ওই পুংকেশর দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভকেশরের ওপর কোমল হাতে ২-৩ বার ছুঁয়ে দিলেই পরাগায়নের কাজ হয়। এভাবে একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ৮-১০টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা যায়
অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে গাছের যথাযথ বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য বীজবপন অথবা চারা রোপণের পর থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত যে সব কাজ বা পরিচর্যা পর্যায়ক্রমে করা হয় তাদের একত্রে ফসল ব্যবস্থাপনা বলে। সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনাগুলো নিম্নরূপ :

১। মালচিং : পচা কচুরিপানা, খড়কুটা, শুকনা ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি দ্বারা মাটির উপরিভাগ ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে। গাছের গোড়ায় খড়কুটা বিছিয়ে দিয়ে এ কাজ করা হয়। মালচের সঠিক পরিমাণ হচ্ছে ২.৫-৫ সেমি। নিড়ানি, আঁচড়া ইত্যাদি দ্বারা ২-৪ সেমি গভীর করে মাটির উপরের শক্ত স্তর ভেঙে দেওয়াকেও মালচিং বলা হয়।

২। ছায়া দেওয়া : চারা রোপণের পর রোদের তাপে অথবা বৃষ্টিতে চারারসমূহ ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থায় গাছের শিকড় সহজে মাটিতে বিস্তার লাভ করতে পারে না এবং চারার খাদ্য গ্রহণে অসুবিধা হয়। ফলে চারা মারা যায় অথবা চারা মাটিতে লেগে যেতে বেশ সময় লাগে। তাই চারা রোপণের পর পরই কলার খোল বা অন্য কিছু দিয়ে চারাকে সূর্যের তাপ এবং বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ছায়া দেওয়া প্রয়োজন যাতে করে চারা সহজে বেঁচে মাটিতে লেগে যেতে পারে।

৩। বেড়া দেওয়া : সবজি ফসল চাষাবাদের জন্য জমিতে বীজবপন বা চারা রোপণের পর যে কাজটা অবশ্য করণীয় তা হচ্ছে বেড়া দেওয়া। এটা করা হয় গরু, ছাগল ও মানুষের অনিষ্ট থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য। বাঁশ, কঞ্চি বা অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় গাছের ডালপালা দিয়ে এ কাজ করা যায়। তবে স্থানীয়ভাবে সহজ প্রাপ্য জিনিস দিয়ে বেড়া দেওয়ার কাজ সুবিধাজনক।

৪। পানি সেচ : ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও জন্মানোর জন্য কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহকে পানি সেচ বলে। মানুষের জীবন ধারণের জন্য যেমন পানির প্রয়োজন, তেমনি ফসলের জীবন ধারণের জন্যও পানির প্রয়োজন। ফসল তার প্রয়োজীয় খাদ্যের অনেকটা মাটি থেকে শিকড়ের সাহায্যে গ্রহণ করে থাকে। ঝরনা, ছোট বালতি ইত্যাদির মাধ্যমে চারার উপরে ও চারপার্শ্বে ভালোভাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে- যাতে করে পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে। পানি দেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে শেষ বিকাল যখন সূর্য পড়ন্ত অবস্থায় থাকে। আগাছা পরিষ্কার করার পর পানি সেচ দেওয়া উত্তম।

৫। আগাছা দমন : আগাছা ফসলের মারাত্মক শত্রম্ন। সবজির জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা দরকার। সময় মতো আগাছা দমন না করলে ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। কারণ, আগাছা মূল ফসলের সঙ্গে খাদ্য, পানি, আলো-বাতাস ও জায়গা ইত্যাদির জন্য প্রতিযোগিতা করে। আগাছা পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই ফসল চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায়েই আগাছা দমন করা অপরিহার্য। নিড়ানি, কোদাল, আঁচড়া ইত্যাদি দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। জমিতে আগাছা দেখা মাত্রই নিড়ানি দিয়ে মূলসহ দমন করতে হবে।

৬। মাটি আলগাকরণ : জমিতে সবজি ফসল থাকা অবস্থায় মাটিকে নরম ও ঝুরঝুরে রাখার জন্য বিভিন্ন সময় যে কাজ করা হয় তাকে মাটি আলগাকরণ বলে। নিড়ানি, কোদাল, আঁচড়া ইত্যাদির মাধ্যমে মাটি আলগাকরণ করা হয়। বৃষ্টিপাত বা সেচের পর আইলের মাটি শুকিয়ে চটা বেঁধে গেলে এ কাজ করা দরকার। এতে মাটিতে সহজে আলো, বাতাস, পানি চলাচল করতে পারে এবং মৃত্তিকা অণুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও জমির আগাছা দমন হয় ও গাছ দ্রম্নত বেড়ে উঠে।

৭। চারা পাতলাকরণ : বপন পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ করার ক্ষেত্রে সব সময়ই সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে বীজবপন করা সম্ভব হয় না। সে সব ক্ষেত্রে বীজ গজানোর পর দেখা যায় যে, গাছ ঘন হয়েছে। এ সব গাছ একে অপরের সঙ্গে খাদ্য, আলো-বাতাস ও স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করে, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ফলন কম হয়। তাই এ অবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত চারা ছোট সময়েই উঠায়ে ফেলতে হয়। সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে চারা গজানোর ৮-১০ দিন পর ঘন জায়গা থেকে সুস্থ সবল চারা রেখে সাধারণত: দুর্বল এবং অতিরিক্ত চারা উঠিয়ে পাতলা করে দিতে হয়।

৮। সারের উপরি প্রয়োগ : গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্য চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। খাদ্যের অভাবে গাছের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং ফুল ফল উৎপাদন কম হয়। তাই জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় সার উপরিপ্রয়োগ করা দরকার। সাধারণত ইউরিয়া এবং এমপি সার গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি শুরু হলে পার্শ্ব প্রয়োগের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়।

৯। শূন্যস্থান পূরণ : চারা রোপণের পর কখনো কখনো বিভিন্ন সবজির চারা মারা যায়। আবার কখনো দেখা যায় যে, বপনকৃত বীজ গজায় না। ফলে জমিতে চারার পরিমাণ কমে যায়। জায়গা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয় এবং ওই জায়গায় আগাছার জন্ম হয়। এতে ফসলের ফলন কমে যায়। সুতরাং, ওই সব শূন্যস্থানে আবার নতুন করে ওই একই জাতের, একই বয়সের চারা লাগানো বা বীজবপন করা উচিত।

১০। গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া : ফলন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কিছু ফসলের ক্ষেত্রে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সময় ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। এর ফলে কন্দের বৃদ্ধি ভালো হয়। যেমন : আলু, মিষ্টিআলু, গাজর প্রভৃতি।

১১। খুঁটি/বাউনি দেওয়া : লতানো সবজি ফসলসহ অন্যান্য বিশেষ কিছু ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির সময় খুঁটি/বাউনি দেওয়া প্রয়োজন। খুঁটি/বাউনি না দিলে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গাছ মাটিতে নুয়ে পড়ে, ফলে ফলন কম হয়। বাঁশ, কঞ্চি, পাটকাঠি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি দিয়ে এ কাজ করা হয়। এ ছাড়া জমিতে পাতলা করে ধৈঞ্চা গাছ জন্মিয়ে সেগুলিকেও খুঁটি/বাউনি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। খুঁটি/বাউনি দেওয়ায় গাছ পরিমিত আলো বাতাস পায়, সবজির ফল পচনের হাত থেকে রক্ষা পায় ও ফলন বেশি হয়। শিম জাতীয় ফসল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, বরবটি প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত্রে বাউনি দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

১২। মাচা দেওয়া : সব রকমের ফসলই মাটির উপরে মুক্তভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। বিশেষ করে লতানো সবজি ফসল। এ সব ফসল মাটিতে থাকলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়, গাছ পচে যেতে পারে, ফলনও কমে যায়। এ সব গাছ মাটির উপরে কোনো অবলম্বন পেলে তাতে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে। তাই লতানো প্রকৃতির সবজি চাষাবাদ করতে হলে গাছের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের জন্য বাঁশ, কঞ্চি, পাটকাঠি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি দিয়ে মাচা তৈরি করে দিতে হয়। বিশেষ করে, কুমড়াজাতীয় ফসল, করলা, পটল, শসা প্রভৃতির ক্ষেত্রে মাচা দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

১৩। ছাঁটাইকরণ : গুণগত মানসম্পন্ন সবজি ফল পাওয়ার জন্য অনেক সময় ছাঁটাইকরণের প্রয়োজন হয়। ফলজাতীয় ফসলের অঙ্গজ অংশ খুব বেশি বৃদ্ধি পেলে গাছ উপযুক্ত পরিমাণে ফলন দিতে ব্যর্থ হয়। তাই গাছের দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ও ফলায়নকে উৎসাহিত করার জন্য অতিরিক্ত শাখা প্রশাখা অঙ্গজ বৃদ্ধির সময়েই কেটে দিতে হয। এ ছাড়া রোগ ও পোকা আক্রান্ত ডালপালা, লতাপাতা কেটে গাছ ছাঁটাই করে দিতে হয়। ফলে গাছে ফুল ও ফল বেশি হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। ঝিঙ্গা ও ধুন্দুল চারার অগ্রভাগ ছাঁটাই করলে তা আগাম শাখা বিস্তার ও নীচের পর্বে ফল ধারণে উদ্দীপিত করে। টমেটো গাছের শাখা ছাঁটাইকরণে বড় আকারের টমেটো উৎপন্ন হয়। ঢেঁড়স এবং বেগুনের পুরাতন গাছ ছাঁটাই করলে তা চারা ফসল থেকে আগে ফল উৎপাদন করে থাকে।

১৪। পরাগায়নকরণ : কুমড়া পরিবারের অধিকাংশ সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গাছে স্ত্রী ফুল ফোটার কিছুদিন পর ফল পচে যায় বা ঝরে যায়। পোকা ও মৌমাছির অনুপস্থিতিতে পরাগায়ন না হওয়ার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই কৃত্রিম উপায়ে এসব ফসলের পরাগায়ন করা দরকার। ফল ধারণের জন্য হাত দিয়ে ফলের পরাগায়ন করতে হয়। সকালের অথবা বিকালের দিকে একটি সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল নিয়ে ফলের পুংকেশর ঠিক রেখে পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হয়। তৎপর ওই পুংকেশর দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভকেশরের ওপর কোমল হাতে ২-৩ বার ছুঁয়ে দিলেই পরাগায়নের কাজ হয়। এ ভাবে একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ৮-১০ টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা যায়। কৃত্তিম পরাগায়নের ফলে গাছে ফল ধারণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

১৫। ফল পাতলাকরণ : অনেক সময় পেঁপে, টমেটো এবং অন্যান্য গাছে বা থোকায় ছোট বড় অনেক ফল ধরে। পুষ্টির অভাবে সবগুলো ফল যথাযথভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে না। এগুলো আকারে ছোট থাকে, বিকৃতরূপ ধারণ করে এবং নিম্নমানের হয়। ছোট ফলগুলো ছোট অবস্থাতেই তুলে ফেলে দিয়ে সতেজ ও আকর্ষণীয় ফলগুলোকে রেখে দিলে ওইগুলো আরও বড় হয়। রোগাক্রান্ত, বিকৃত ও ক্ষুদ্রাকৃতির ফল পাতলা করে দিতে হবে। এখানে উলেস্নখ্য যে, গাছের ফল পাতলা করে দিলে গাছে আরও বেশি পরিমাণ ফল ধরে। ফল পাতলাকরণের ফলে গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস পায়, ফলের আকার-আকৃতি ও গুণগতমান উৎকৃষ্ট হয় এবং গাছে রোগবালাই কম হয়।

১৬। পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা : রোগবালাই ও পোকামাকড় ফসলের চরম শত্রম্ন। রোগবালাইর হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে না পারলে ফসলের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং পরিমাণে ফলনও কম হয়। অনেক সময় ফসল পোকামাকড় ও রোগবালাইর আক্রমণে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। ভালো ফলন পেতে হলে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করা দরকার।

অন্য যে কোনো ফসল চাষের চেয়ে সবজি ফসল চাষের জন্য বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। ফলে সবজিচাষে তুলনামূলকভাবে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। তদাপিও উচ্চ বাজারমূল্যের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকরা সবজিচাষে অধিক মনোযোগী হচ্ছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকের ভাগ্য বদলে দিতে পারে সবজি চাষ।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে