সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবজি ফসলের প্রধান প্রধান রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা

পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। মাটি সঁ্যাতসেঁতে হতে দেওয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষাবাদ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব ২.৫ গ্রাম হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। মেঘলা আবহাওয়ায় রিডোমিল গোল্ড, করমিল, মেটারিল, নিউবেন, সিকিউর, মেলোডি ডুও এর যে কোনো একটি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে স্প্রে করা
অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সবজি ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসলের বীজবপন বা চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রকার রোগবালাই আক্রমণ করে থাকে। রোগের আক্রমণের ফলে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, পাতা ঝরে যায়, শাখা প্রশাখা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলন কম হয় এমনকি গাছের মৃতু্যও ঘটে থাকে। তাই এসব রোগ থেকে ফসল রক্ষা করা প্রয়োজন। আর এ রোগগুলো হয়ে থাকে সাধারণত- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও নেমাটোডজাতীয় অনুজীবের আক্রমণে। সবজি ফসলের প্রধান প্রধান রোগগুলো হলো- ড্যাম্পিং অফ, নেতিয়ে পড়া বা উইল্ট, এনথ্রাকনোজ, ডাই-ব্যাক, ফলপচা, মরিচা, ব্যাকটেরিয়াল রট, কান্ডপচা, লিফ কার্ল, রটনট নেমাটোড, ক্ষুদ্রাকৃতির পাতা, নাবীধসা, আগামধসা, পাউডারি মিলডিও, ডাউনি মিলডিও, মোজাইক রোগ ও পাতায় দাগ রোগ প্রভৃতি।

চারা ঢলে পড়া রোগ: চারাগাছে এ রোগ হয়। তাই বীজতলায় এ রোগ বেশি দেখা দেয়। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং আক্রান্ত চারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটি সব সময় সঁ্যাতসেঁতে থাকলে, ক্রমাগত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করলে এবং বায়ু চলাচলের বিঘ্ন ঘটলে এ রোগের আক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। বপনকৃত বীজ এবং চারা উভয়ই ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বীজে আক্রমণ হলে বীজ গজায় না। চারা আক্রমণ হলে প্রথমে আক্রান্ত চারা ফ্যাকাশে দেখা যায় এবং কান্ডের গোড়ায় বাদামি রঙের ভেজা দাগ দেখা যায়। পরে ভেজা দাগ কান্ডের চারিদিকে বিস্তৃত হয়। পরবর্তী সময়ে ওই কান্ডের উপরে এবং নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারার কান্ড মাটির কাছাকাছি চিকন হয়ে পড়ে। চারার গায়ে ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। আক্রান্ত অংশ পচে যায়। চারার গোড়া চিকন, লিকলিকে হয়ে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।

প্রতিকার : সূর্যালোক এবং বায়ুময় স্থানে বীজতলা তৈরি করা। বীজতলা স্যাঁতসেঁতে হতে না দেয়া। বীজ পাতলা করে বোনা এবং বীজতলায় বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকা। এছাড়াও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং একই বীজতলা বারবার ব্যবহার না করা উত্তম। চারা গজানোর পর অতিরিক্ত সেচ দেয়া যাবে না। আইলের মাটি নিড়ানি বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে শুকিয়ে ফেললে রোগের আক্রমণ কমে যায়। বীজতলায় বীজবপনের এক সপ্তাহ আগে সজিনা গাছের পাতা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া ভালো। বায়োফানজিসাইড- ট্রাইকোডারমা দিয়ে বীজ ও মাটি শোধন করতে হবে। এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম ডাইথেন এম ৪৫ বা ৩ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম চ্যাম্পিয়ন স্প্রে করতে হবে।

নেতিয়ে পড়া রোগ : সব সবজি ফসলে এ রোগ হতে পারে। ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া উভয় ধরনের জীবাণু দ্বারা এ রোগ সংক্রমিত হতে পরে। বাইরের লক্ষণ প্রায় একই রকম হবে ভেতরের লক্ষণে ভিন্নতা বিদ্যামান। ছত্রাকের আক্রমণে গাছের নরম অংশ যেমন কচিপাতা, ডগা প্রথমে দুপুরে রোদের সময় ঢলে পড়তে দেখা যায়। দু'এক দিন পর সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। এ রোগের লক্ষণের সফঙ্গ গাছের পানির অভাবজনিত লক্ষণের তুলনা চলে। ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে গাছে ঢলে পড়া লক্ষণ খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ পায় এবং ছত্রাকজনিত জীবাণুর চেয়ে খুব অল্প সময়ে গাছ মারা যায়। ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ গাছ একসঙ্গে ঢলে পড়ে কিন্তু ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রথমে গাছের এক পাশ্ব বা কয়েকটি শাখা ঢলে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে। গাছে যখন ফুল-ফল ধরা শুরু হয় তখন এ রোগের আক্রমণ হয়।

প্রতিকার : এজন্য রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। মাটি সঁ্যাসেঁতে হতে না দেয়া ও নিয়ন্ত্রিত সেচ দেয়া উত্তম। আক্রমণ ক্রমাগত হলে শস্য পর্যায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বেগুনের ক্ষেত্রে গ্রাফটেড চারা লাগালে রোগ হবে না। জমি তৈরির সময় একরপ্রতি ৩ কেজি কার্বোফুরান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বা গাছের চারা লাগানের পূর্বে গোড়ায় ৫ গ্রাম ফুরাডান ও ৫ জি ব্যবহারে রোগের আক্রমণ কম হয়। বায়োফানজিসাইড- ট্রাইকোডারমা দিয়ে বীজ ও মাটি শোধন করা ভালো। প্রতি লিটার পানিতে ৩-৪ গ্রাম ব্যাভিস্টিন দ্বারা ১৫-২০ মিনিট চারা শোধন করা যায়। চারা রোপণের ২০-২৫ দিন আগে বিঘাপ্রতি ২.৬ কেজি বিলচিং পাউডার মাটিতে প্রয়োগে ব্যাকটেরিয়াজনিত উইল্ট কম হয়।

পচন বা এনথ্রাকনোজ : একটি সবজি ফসলের একটি সাধারণ রোগ। ছত্রাকজনিত এই রোগ পাতায় এবং ফলে প্রথমে হলুদ বর্ণের ক্ষুদ্র দাগ হিসেবে প্রকাশ পায়। পরে এ সব দাগ দ্রম্নত বৃদ্ধি পেয়ে বাদামি বা কালো বর্ণ ধারণ করে। একাধিক দাগের সমন্বয়ে বড় দাগের সৃষ্টি হয়। গাছ নেতিয়ে পড়ে। ডাটা বা শাখা ফেঁটে যায় এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অতি মাত্রায় নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে এ রোগ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মাটি সঁ্যাতসেঁতে থাকলে এবং বৃষ্টিপাত বেশি হলে এ রোগ দ্রম্নত বিস্তার লাভ করে।

প্রতিকার : রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং শস্যচক্র অনুসরণ করা। আক্রান্ত গাছ ও আক্রান্ত পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলা। প্রোভেক্স ২০০ বা ব্যাভিস্টিন (২-৩ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজে) দ্বারা বীজ শোধন করা। কম নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ করা। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম টপসিন এম ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা।

আগা মরা বা ডাই ব্যাক: মরিচসহ কিছু ফসলে আগামরা রোগ দেখা দেয়। ছত্রাক প্রধানত গাছের শাখার অগ্রভাগ আক্রমণ করে গভীর দাগের সৃষ্টি করে পরিবাহী টিসু নষ্ট করে দেয়। ফলে শাখার অগ্রভাগ উপরের দিক থেকে মরতে মরতে নিচের দিকে অগ্রসর হয়; আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। ছত্রাক পাকা ফলও আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফলে প্রথমে কালো গোলাকার দাগ সৃষ্টি করে। ক্রমে ইহা ফলের দৈর্ঘ্য বরাবর লম্বা হতে থাকে এবং মেটো বর্ণ ধারণ করে।

প্রতিকার : আক্রান্ত অংশ কেটে বা পুড়িয়ে ফেলা। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম টপসিন এম ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা।

কান্ড পচা রোগ : অনেক সবজি ফসলে এ রোগ দেখা দেয়। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। রোগের আক্রমণের ফলে প্রথমে গাছের গোড়ায় এবং কান্ডে বাদামি হতে কালো রঙের দাগ পড়ে। এ দাগগুলো লম্বালম্বিভাবে বৃদ্ধি পেয়ে কান্ডের চারিদিকে বিস্তার লাভ করে। ফলে কান্ড পচে গাছ মরে যায়। আক্রান্ত স্থানে সাদা সূতার মতো রোগ জীবাণু খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। মাটি বেশি সঁ্যাতসেঁতে থাকলে এ রোগ বিস্তার লাভ করে এবং অন্য গাছকে আক্রমণ করে।

প্রতিকারঃ রোগমুক্ত বীজ এবং চারা ব্যবহার করা। আইল সঁ্যাতসেঁতে হতে না দেয়া। রোগাক্রান্ত গাছের গোড়ায় ছাইমিশ্রিত পটাশ সার ব্যবহার করা। কুপ্রাভিট ৪ মিলি বা চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম বা টিল্ট ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করা।

নাবীধসা বা লেট বস্নাইট: আলু ও টমেটোতে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। আকাশ মেঘলাসহ গুটি গুটি বৃষ্টিপাত হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। রোগের আক্রমণের ফলে প্রথমে পাতায় ফ্যাকাশে সবুজ রঙের দাগ পড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে দাগগুলো বড় হয়ে কালো বা বাদামি রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতা পচে যায়। পাতা ভেতরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়। ফলের গায়ে দাগ পড়ে ও পচন ক্রিয়া দেখা দেয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় আক্রান্ত অংশ মরে যায় কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ কান্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। এভাবে এ রোগ অন্য গাছেও আক্রমণ করে।

প্রতিকার : এজন্য রোগমুক্ত সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও বীজ শোধন করা উত্তম। পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। মাটি সঁ্যাতসেঁতে হতে দেয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষাবাদ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব ২.৫ গ্রাম হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা। মেঘলা আবহাওয়ায় রিডোমিল গোল্ড, করমিল, মেটারিল, নিউবেন, সিকিউর, মেলোডি ডুও এর যে কোনো একটি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে স্প্রে করা।

আগামধসা বা আর্লি বস্নাইট: আলু ও টমেটোতে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। এ রোগের আক্রমণের ফলে প্রথমে পাতার উপর বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট অনেক দাগ দেখা দেয়। দাগগুলো প্রথমে হালকা বাদামি বর্ণের হয়, পরে এই দাগ গাঢ় বাদামি রং ধারণ করে। দাগের মধ্যে অনেক চক্র দেখা যায়। পাতা কিছুটা কুঁকড়িয়ে যায় ও সব পাতায় দাগ ছড়ায়ে পড়ে। কিন্তু পাতা পচে না। এ রোগে গাছ সাধারণত মরে না। কিন্তু ফল আকারে ছোট হয় এবং ফলন কমে যায়।

প্রতিকার : রোগমুক্ত সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। বীজ শোধন করা উত্তম। পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো। মাটি সঁ্যাতসেঁতে হতে দেয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার করা ভালো। রোগ দেখা দিলে রোভরাল বা ডাইথেন এম ৪৫ বা নেমিসপোর ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে স্প্রে করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ,

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে