শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

রোগ প্রতিরোধে হলুদের যত গুণ বেশি খাওয়া ক্ষতি

পুষ্টিবিদ ডা. সায়লা সবনম
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রোগ প্রতিরোধে হলুদের যত গুণ বেশি খাওয়া ক্ষতি

হলুদ একটি ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ। এটি কাঁচা বা শুকনো গুঁড়া হিসেবে খাওয়া ও ব্যবহার করা হয়। হলুদের গুণকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। হাজার হাজার বছর ধরে নানা রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগানো হচ্ছে এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে। এমন কি প্রাচীনকালে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ওপর লেখা একাধিক বইয়েও এই মশলাটির গুণাগুণের উলেস্নখ ছিল। এতদিন পরে এসেও সেই কথা সত্যি প্রমাণ হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে হলুদের বিভিন্ন গুণ। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও চৈনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে হলুদের ব্যবহার হচ্ছে বহু বছর ধরে। স্বাস্থ্যকর ভেষজ হলুদকে কেউ কেউ 'ঔষধি ভেষজ' নামেও ডাকেন। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধে হলুদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বিভিন্ন সময়ে গবেষণায় দেখা গেছে হলুদ মানব শরীর বা জীবদেহে প্রায় ৪০০ রকম উপকারী ভূমিকা পালন করে। সে অর্থে মহৌষধি গুণসম্পন্ন এই হলুদ বলা চলে। হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লামেশন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, অ্যান্টি-সেপটিক, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও কার্কুমিন উপাদান আছে- যা আমাদের শরীরের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টি-বায়োটিক প্রয়োজন এমন রোগের ক্ষেত্রে।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত সকালে উঠে কাঁচা হলুদ খেলে দেহে এমন কিছু উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যার প্রভাবে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তে শকর্রার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সুযোগই পায় না। হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকে। আর্থ্রাইটিসের কবল থেকে এই উপাদান রক্ষা করে। হাড়ের কোষকে সুরক্ষা দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নড়াচড়ার অসুবিধা দূর করে। হলুদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রক্তকণিকাকে নিরাপদ রাখে। ফলে স্তন ক্যানসার, পাকস্থলী, কোলন ও ত্বকের ক্যানসার তৈরি হতে পারে না।

কাঁচা হলুদে উপস্থিত কার্কিউমিন এবং আরও নানা সব অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান যে কোনো ধরনের ক্ষতের যন্ত্রণা কমায়। এটা আঘাত সারাতেও দারুণভাবে কাজ করে। এ কারণেই তো ছোট বাচ্চাদের নিয়মিত কাঁচা হলুদ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এছাড়া ক্ষতস্থানে অল্প পরিমাণে হলুদ বেঁটে লাগিয়ে দিলেও কিন্তু সমান উপকার পাওয়া যায়। অনিয়মিত মাসিক রোধ, হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে হলুদের কারকিউমিন। এই উপাদান পিরিয়ডের আগে ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে থাকে।

হলুদে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান পার্কিনসনস, আলঝেইমার, টিসু্যর স্থবিরতার মতো অসুস্থতা রোধে সক্ষম। এটি আমাদের মস্তিষ্কে তথ্য আদান-প্রদানের পরিমাণ বাড়ায়। হতাশার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। হলুদ হৃৎপিন্ডের বা যকৃতের নানান রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। লিভারের বহুবৃদ্ধি, হেপাটাইটিস, সিরোসিস, গলবস্নাডারের মতো সমস্যা তৈরিতে বাধা দেয়। মাথা ব্যাথা কমায়। হলুদে থাকা কার্কিউমিন এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটারি উপাদান শরীরের প্রদাহ কমায়। ফলে মাথা যন্ত্রণা কমতে সময় লাগে না। নিয়মিত হলুদ খাওয়া শুরু করলে হজমে সহায়ক পাচক রসের ক্ষরণ বেড়ে যায়। ফলে বদহজমের আশঙ্কা যেমন কমে, সেই সঙ্গে গ্যাস-অম্বল এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো সমস্যা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

গবেষণায় প্রমাণিত, হলুদে উপস্থিত কার্কিউমিন শরীরে ক্যানসার সেল জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমিয়ে দেয়। এজন্য প্রতিদিন সকালে অল্প করে হলুদ খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। শরীরকে ডিটক্সিফাই বা বিষমুক্ত করতে হলুদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। হলুদে থাকা কার্কিউমিন, রক্তে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়। ফলে বস্ন্যাড ভেসেলের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। সেই সঙ্গে নানা রোগের আশঙ্কাও কমে। নিয়মিত হলুদ খেলে শরীরে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। আর একবার মেটাবলিজম রেট বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ওজন হ্রাসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। হলুদে উপস্থিত বিভিন্ন শরীরের ফ্যাট সেলগুলোর গলানোর মধ্যে দিয়ে অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলতে পারে।

হলুদে উপস্থিত অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রপাটিজ একদিকে যেমন নানাবিধ সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমায়, তেমনি এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রপাটিজ রেসপিরেটারি ট্রাক্ট ইনফেকশন এবং সর্দি-কাশির প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। লিভারকে চাঙা এবং কর্মক্ষম রাখতে হলুদের কোনো বিকল্প নেই। কারণ এর মধ্যে থাকা কার্কিউমিন লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত হলুদ মেশানো দুধ খেলে ত্বকের ভেতরের টক্সিক উপাদান বেরিয়ে যায়। সঙ্গে কোলাজেনের উৎপাদন বেড়ে যায়। ফলে ত্বক উজ্জ্বল এবং প্রাণচ্ছ্বল হয়, বলি রেখা কমে। সেই সঙ্গে ব্রণ, অ্যাকনে এবং কালো ছোপের মতো সমস্যাও কমতে শুরু করে। অ্যাকজিমার মতো ত্বকের রোগের চিকিৎসাতেও হলদ-দুধ বিশেষ উপযোগী।

দাঁতে নানারকম জীবাণু ও মাড়িতে ক্ষয় ধরে। কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল উপাদান দাঁতকে জীবাণু সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখে। সেই সঙ্গে দাঁতের মাড়ির ক্ষয় রোধ রকে মজবুত করে তোলে। হলুদে থাকে অনেক আয়রন। রক্তে আয়রনের পরিমাণ কমে গেলে বা তা বাড়াতেও সহায়তায় কার্যকর হলুদ। কোলেস্টরেল সমস্যায় যারা ভুগছেন, তাদের জন্যও কাঁচা হলুদ বিশেষ উপকার। এটা তাদের জন্য ম্যাজিকের মতো কাজ করে।

হলুদ অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা কমায়: হলুদের মধ্যে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ থাকায় এবং ভিটামি 'বি' থাকায় তা অ্যানিমিয়ার হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। মেয়েদের সাধারণত অ্যানিমিয়া হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, তাই তাদের পক্ষে হলুদ নিয়ম করে খাওয়া খুবই উপকারী। এছাড়া হলুদে থাকা কারকিউমিন লোহিত রক্তকণিকাকে রক্ষা করে। হলুদে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় তা রক্তে আয়রনের ঘাটতিকেও মেটাতে সাহায্য করে।

হলুদ অ্যান্টি-বায়োটিক ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ বিভিন্ন ক্ষত তাড়াতাড়ি সারাতে সহায়তা করে ও ক্ষতের জায়গায় নতুন চামড়া জন্মাতে সাহায্য করে। অপারেশনের পরে ব্যথা কমাতে ও পোড়ার ক্ষত কমাতে এটি সাহায্য করে। হলুদ অগ্ন্যাশয়কে সুস্থ রাখে: হলুদে থাকা কারকিউমিন ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ অগ্ন্যাশয়কে সুস্থ রাখে ও প্রদাহের হাত থেকে অগ্ন্যাশয়কে রক্ষা করে। এছাড়া অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারের থেকেও নিয়ম করে হলুদ খেলে মুক্তি মেলে।

হলুদ বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে সহায়তা করে: বিভিন্ন ব্যথানাশক ওষুধ খেলে অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়, এছাড়া বিভিন্ন ওষুধের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় তা থেকে আমাদের যকৃত, কিডনিকে হলুদ সুস্থ রাখে। এছাড়া হলুদ নিজেও অনেক সময় বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলুদ খেলে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। হলুদ ইউটেরাইন স্টিমুল্যান্ট হিসেবে কাজ করে, যা মেন্সট্রুয়াল ফ্লো কে উৎসাহিত করে। তাই গর্ভবতী ও সদ্য মায়েদের হলুদ কম খাওয়া উচিত। হলুদ বেশি খেলে কেমোথেরাপি বাধাগ্রস্ত হয়। হলুদ অনেক সময় অক্সালেটরের বিপাক পরিবর্তিত করে; ফলে ওই অক্সালেট কিডনিতে পাথর তৈরি করে। হলুদ অ্যাসপিরিন, ওয়ারফারিন এবং কিছু স্টেরয়েডের সঙ্গে ক্রিয়া করে। এতে ওষুধের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে