শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

পুষ্টিকর সবজি টমেটোর আবাদ বাড়ছে

আলতাব হোসেন
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
পুষ্টিকর সবজি টমেটোর আবাদ বাড়ছে

টমেটো একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। কাঁচা কিংবা পাকা দুভাবে টমেটো খাওয়া যায়। খাবারের স্বাদ বাড়াতে টমেটোর জুড়ি মেলা ভার। অনেকে আবার সালাদে টমেটো খেয়ে থাকেন। শুধু খাবারে স্বাদই বাড়ায় না, টমেটো থেকে তৈরি হয় নানা রকমের কেচাপ, সস।

টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও কৃষির বৈপস্নবিক পরিবর্তনে এবং বিজ্ঞানীদের নব নব উদ্ভাবনে এটি এখন গ্রীষ্মকালেও চাষাবাদ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মে থেকে জুলাই মাসে লাগানো জাতের টমেটো শীতের আগ পর্যন্ত সময়েও বাজারে পাওয়া যায়। ভারত থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আমদানি হলেও বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের সহায়তায় দেশজুড়ে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড জাতের টমেটো কৃষক পর্যায়ে বিস্তার ঘটছে। টমেটো চাষে কৃষকের সফলতার গল্পও শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ যাবত বেশ কিছু গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব জাতের মধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, হাইব্রিড টমেটো-৮, হাইব্রিড টমেটো-১০ ও হাইব্রিড টমেটো-১১ দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তারমধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ সর্বোচ্চ শিখরে রয়েছে বলে জানা যায়। বিগত কয়েক বছর থেকে মাঠপর্যায়ে এসব জাতের বিস্তারও ঘটছে উলেস্নখযোগ্যভাবে। কৃষকও চাষাবাদ করে লাভের মুখ দেখছেন।

টমেটো একটি পুষ্টিকর সবজিও বটে! ইউরোপে টমেটোর গুণ সম্পর্কে বলা হয়, 'টমেটো যদি লাল হয়, চিকিৎসকের মুখ হয় নীল।' অর্থাৎ নিয়মিত টমেটো খেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। বারি সূত্র মতে, টমেটোতে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন 'এ', ভিটামিন 'সি'সহ অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ইয়ুথ হেলথ ম্যাগ ও টাইমস অব ইন্ডিয়া তথ্য সূত্রে, টমেটোতে রয়েছে বয়স প্রতিরোধী বিশেষ প্রভাব। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন প্রোস্টেট, কলোরেকটাল বা পেটের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমিয়ে দেয়। শরীরের ত্বক কুঁচকে যাওয়া, ভাঁজ পড়া বা বলিরেখা পড়া দূর করতে পারে। টমেটো হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। টমেটোর মধ্যে থাকা ভিটামিন 'বি' ও পটাশিয়াম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। চোখের দৃষ্টি উন্নত করতে টমেটোর ভূমিকা অপরিসীম। তাই শিশুদের ডায়েটে টমেটো রাখতে পারলে উপকার মিলবে।

বর্তমানে দেশে বছরে ১৫ হাজার টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদিত হচ্ছে, পাশাপাশি বিদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার টন টমেটো আমদানি করতে হচ্ছে। গবেষকরা বলেন, দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বাড়ানো গেলে কৃষকরা যেমন লাভবান হবে একই সঙ্গে আমাদের টমেটো আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে বিপস্নব ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরার কৃষক। এ জেলার উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। ফলে দিন দিন দেশের বহু জেলায় গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের বারি টমেটো চাষের খুবই সম্ভাবনাময় জেলা সাতক্ষীরা। জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ৭১২.৫০ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো চাষ হয়েছে।

ভিটামিনসমৃদ্ধ টমেটো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং স্ট্রেস হরমোন কমায়। এ কারণে নিয়মিত টমেটো খেলে শরীরের শক্তি বাড়ে এবং শরীর সুস্থ থাকে। টমেটা খেলে শরীরের রক্তশূন্যতা দূর হয়। নিয়মিত দু'য়েকটি করে টমেটো খেলে রক্তের কণিকা বৃদ্ধি পায়, রক্তশূন্যতা রোধ হয়। এ ছাড়া রক্ত পরিষ্কার, হজমে ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। টমেটোতে থাকা লাইকোপিন ত্বকের ক্লিনজার হিসেবে কাজ করে। এটি ত্বক পরিষ্কার ও সতেজ রাখে। টমেটোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন কে এবং ক্যালসিয়াম থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০০ গ্রাম টমেটোতে ১১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। এ কারণে নিয়মিত টমেটো খেলে হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। টমেটো ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি'র ভালো উৎস। এ দুটি উপাদান ক্ষতিকারক ফ্রির্ যাডিকেল থেকে শরীরকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে। এতে শরীর সুস্থ থাকে। টমেটোতে থাকা ভিটামিন এ, ভিটামিন বি এবং পটাশিয়াম কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সঙ্গে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। টমেটো ক্রোমিয়াম নামক এক ধরনের খনিজ থাকায় এটি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এ কারণে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও উপকারী।

কৃষিবিদ আব্দুল হাই বলেন, বারি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো কৃষক পর্যায়ে দ্রম্নত বিস্তার ঘটাতে হলে এর উৎপাদন খরচ কমাতে নিম্নোক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তা হলো: কৃষক পর্যায়ে বারি হাইব্রিড জাতের টমেটোর গ্রাফটেড চারা ও বীজ উৎপাদনে কৃষককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তুলে কমিউনিটি এপ্রোচের মাধ্যমে এগোতে হবে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এসব জাত ও উৎপাদন কলাকৌশলের ওপর ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার; বেশি ব্রষ্টিপাতকে এড়িয়ে কম বৃষ্টিপাতের সময়ে পলিশেড ছাড়াই পলি-মালচিং প্রয়োগ করে চারা লাগালে খরচ সাশ্রয় হবে; উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষক দলভিত্তিক কার্যকর বিপণন চ্যানেল তৈরি করে টমেটো বাজারজাত করতে পারলে লাভবান হবে বেশি; দেশীয় উৎপাদন বাড়লে আমদানি সীমিত রাখা এবং লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম চলমান রাখা দরকার।

জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষকের আয় বাড়াতে, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বারি জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে টমেটোর বছরব্যাপী দেশের চাহিদা পূরণ হবে এবং আমদানি নিভর্রতা কমবে।

পুষ্টিতে ভরপুর টমেটো। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, সি, কে, ফলেট ও পটাশিয়াম। টমেটো থেকে আরও পাওয়া যায় থায়ামিন, নায়াসিন, ভিটামিন বি৬, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস এবং কপার। এ ছাড়াও এই এক কাপের টমেটোর মধ্যেই থাকে দুই গ্রামের মতো ফাইবার। অনেকটা পানিও রয়েছে এর মধ্যে। চর্মরোগের জন্য টমেটো অত্যন্ত কার্যকর উপাদান। ত্বকে যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, তবে প্রক্রিয়াজাত করে টমেটোর ব্যবহার করতে পারেন। চর্মরোগ নিরাময়ে এর রস কাজ করে থাকে। মুখের সৌন্দর্য ধরে রাখতে এবং বয়সের ছাপ দূর করতে টমেটো বেশ কার্যকর। এর রস মুখের ত্বক মসৃণ ও কোমল করে। বয়স বাড়তে থাকলে মানুষের মুখে যে বয়সের ছাপ পড়ে, তা টমেটো দেওয়ার ফলে সেই ছাপ লুকাতে সাহায্য করে। এটি খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে একটি বা দুটি টমেটো খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সাহায্য করে।

রক্তস্বল্পতা দূরীকরণে সাহায্য করে। যারা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন, তাদের জন্য টমেটো বেশ উপকারী। প্রতিদিন এক বা দুইবার টমেটো খেলে রক্তস্বল্পতার সমস্যা অনেকটাই দূর হতে পারে। সর্দি-কাশি প্রতিরোধেও টমেটো বেশ কার্যকর। সর্দি-কাশি হলে এক বা দুটি টমেটো নিয়ে স্স্নাইস করে অল্প চিনি বা অল্প লবণ দিয়ে পাত্রে গরম করে সু্যপ তেরি করে খেতে পারেন। এর ফলে সর্দি-কাশিতে উপকার পাবেন। জ্বরের নিরাময়ে সহায়ক। গায়ের তাপমাত্রা নানান কারণে বাড়তে পারে। সামান্য জ্বর হলে টমেটো খেলেই আরাম পেতে পারেন। মাড়ি থেকে রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ভিটামিন সি'র অভাবে মাড়ি থেকে যদি রক্তপাত হয়। টমেটোতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি রয়েছে। তাই প্রতিদিন একটি করে টমেটো খেলে মাড়ি থেকে যদি রক্তপাতের বিষয় থেকে উপকার পাবেন।

নিয়মিত টমেটো খেলে ত্বক সুস্থ থাকে। আর ত্বক হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত। সূর্যের ক্ষতি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। ফলে ত্বকে বলিরেখা পড়ার পরিমাণ কমে যায়। টমেটোর মধ্যে রয়েছে লাইকোপেন এবং ভিটামিন এ। যা অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই নিয়মিত টমেটো খেতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম। যা হাড়ের জন্য অনেক উপকার। আপনার হাড় দুর্বল থাকে তবে টমেটো খেতে পারেন। টমেটো সস ও কেচাপ যে কোনো খাবারের সঙ্গে বিশেষ করে মুখরোচক ভাজাভাজি বা নাশতার সঙ্গে খেলে মজা লাগে। আজকাল নানা নতুন কায়দার গরুর মাংস, মুরগির মাংস রান্নায় টমেটো সস মেশানো হয়। তাতে স্বাদে ভিন্নতা আসে। খেতেও সুস্বাদু হয়।

টমেটো অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। তবে এই উপকারী সবজিটি সবার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। এমনকি কিছু মানুষ আছে যারা টমেটো খেলে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় পড়তে পারেন। টমেটো খেলে কাদের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

জিইআরডি বা গ্যাস্টোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ থাকলে টমেটোর থেকে কিছুটা হলেও দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। কারণ এই সবজিতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে- যা আপনার পেটের অস্বস্থির কারণ হতে পারে। পেটের একটি জটিল অসুখ হলে আইবিএস। এই রোগে ভোগা রোগীদের টমেটো এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ টমেটোতে মজুত থাকা ফাইবার এই রোগীদের অন্ত্রে অস্বস্থি তৈরি করে। এর ফলে পেটে ব্যথা থেকে ডায়রিয়া, বমির মতো সমস্যা হতে পারে। টমেটোয় রয়েছে বেশ কিছুটা পরিমাণে হিস্টামাইন। এই উপাদান অনেকেরই সহ্য হয় না। আর এই কারণেই টমেটো খাওয়ার পরপরই অনেকের নাক বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পেটে ব্যথাও শুরু হয়। ত্বকেরর্ যাশও দেখা দেয়। এ কারণে টমেটো খাওয়ার পর এই ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রম্নত বাদ দিন। এই সবজিতে রয়েছে অক্সালেটের ভান্ডার। কিন্তু এই উপাদান কিডনি স্টোনের আকার বাড়াতে পারে। তাই যাদের কিডনি স্টোন আছে তারা টমেটো খাবেন না। এতে সমস্যা আরও বাড়বে। টমেটোর বীজে রয়েছে অত্যধিক পরিমাণে পিউরিন- যা রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়াতে পারে। তাই যাদের রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি কিংবা গাউট আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন, তারা যত দ্রম্নত সম্ভব টমেটো থেকে দূরে থাকুন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে