সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

বনে ভীষণ বিপদ

মাসুদ রানা আশিক
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

'হঠাৎ কী হলো এই বনে? এত বছর হয়ে গেল আমি এই বন শাসন করছি। কোনো দিন তো এমন হয়নি। মন্ত্রী, বনের ঘটনা আমাকে বল তো। তুমি তো বনের সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখ। আমি তো ওত পেতে দেখার সুযোগ পাই না।' হুংকার ছেড়ে বলে সুরসুরিয়া বনের রাজা সিংহ। বনের মন্ত্রী শিয়াল। সে রাজাকে কুর্নিশ করে। বড় করে হুক্কা হুয়া ডাক দিয়ে বলে, 'রাজা সাহেব। মনে হচ্ছে, আমরা ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছি। তবে আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে।' রাজার ডেরার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল হাতি। তাকে খুব বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। তাকে দেখে রাজা বলল, 'হাতি সাহেব, আপনার এ অবস্থা কেন বলুন তো? এত ঘামছেন যে! প্রেশার বেড়ে যায়নি তো? আমাদের বনের বৈদ্য কচ্ছপকে ডেকে আনি। উনি আপনার চিকিৎসা করবেন।' ধপাস করে বসে পড়ে হাতি। পুরো বনটা নড়ে ওঠে। নিজের পা দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে হাঁপাতে হাঁপাতে হাতি বলে, 'রাজা সাহেব, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তো আগে কখনো এভাবে ঘামিনি। দেখে মনে হচ্ছে, এই মাত্র গোসল করে ফিরলাম। আসার সময় ভালুককে দেখলাম পানিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভালুককে বললাম, 'ও ভালুক ভাই, ওভাবে পানিতে বসে আছ যে। ঘরে যাবে না।' ভালুকের কথা শুনে খুব হতাশ হতে হলো। বলল, 'বাড়ি যেয়ে আর কী করব। এত গরম আর ভালো লাগে না। তাই পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। এখানেও খুব একটা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ফোটানো পানি। অথচ কয়েক বছর আগেও এই পানি ছিল খুবই ঠান্ডা।' 'উঁহু, কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না।' ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে রাজা। নিজের ডেরার ভেতর আগে আরামে ঘুমাতে পারত সে। এখন সেটা আর হয় না। ঘুমালেই শরীরটা ঘামে ভিজে যায়। এখন খুব একটা বাতাসও হয় না বনে। কী যে হলো! এভাবে বেশ কিছুদিন যায়। রাজা মিটিং ডাকে বনে। বনের সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয় সেই মিটিংয়ে। ডেরার সামনে দাঁড়িয়ে সিংহ বলে, 'বনের দুরাবস্থা সম্পর্কে আপনারা কিছু জানেন?' সবার মুখই ভীষণ রকম বিষাদগ্রস্ত। সবাই যেন ক্লান্ত। ডেরার সামনে দাঁড়িয়ে বনের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক শিয়াল পন্ডিত বলে,' রাজা, আমাদের বনের পড়াশোনা ব্যাঘাত ঘটছে। অতিরিক্ত গরমে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। পড়াশোনায় আমাদের বন পিছিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।' বানর বলে, 'আমরা আগে বনে খেলতাম। ক্লান্ত বোধ করতাম না। এখন আমরা খেলাধুলাতেও পিছিয়ে পড়ছি। খেলতে গেলেই হাঁপিয়ে যাই। দিন দিন আমাদের স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।' পানির মাছ বোয়াল বসে ছিল আরও একটু পেছনে। সে একটা লাফ দিয়ে বলল, 'আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে। আমাদের জলাশয়ে আগে অনেক পানি ছিল। এখন পানি দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা মনে হয়- মারা যাব। আহারে জলাশয়। আর মনে হয়, সেখানে ফিরে যেতে পারব না।' হরিণ খুবই মন খারাপ করে বসে ছিল। সে মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, 'আগে বনে অনেক তাজা ঘাস পাওয়া যেত। গাছে অনেক ফল থাকত। আমরা তৃণভোজী প্রাণিরা এসব খেয়েই বেঁচে থাকতাম। এখন ফলও নেই, ঘাসও নেই।' 'বল কী তোমরা! বনে ফল, ঘাসেরও আকাল পড়েছে!' সজারুর গায়ে শুধু কাঁটা। তাই সে দাঁড়িয়ে ছিল আরও অনেকটা দূরে। যাতে তার কাঁটায় কেউ বিদ্ধ না হয়। সে একটু জোরে বলল, 'আমাদের বনের মাটি ক্ষয় হওয়া শুরু করেছে। বনের শেষ প্রান্তে ভূমিধস হচ্ছে। সম্ভবত বনটাই এক সময় থাকবে না। এই বনে কোনো বাতাস নেই। মাঝে মাঝে বড় ঝড় হলে বনের বাড়িগুলোর অনেক ক্ষতি হয়।' বন কর্মকতা বাঘ হালুম করে বলল, 'আমরা দাপ্তরিক কোনো কাজই করতে পারছি না গরমের কারণে। একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা। দাপ্তরিক কাজগুলো করতে না পারার কারণে বনের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।' সিংহ রাজা আশপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো পাখি বসে থেকে কাঁদছে। রাজা মুখটা ম্রিয়মাণ করে বলে, 'তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা কাঁদছো কেন? এই বনে থাকতে তোমাদেরও কি কষ্ট হচ্ছে?' 'হঁ্যা রাজা সাহেব। এই বনে আমাদের থাকার জায়গাটাই তো নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের খাবারের আকাল পড়েছে। ক্ষুধা পেটে নিয়ে আমরা এখানে ওখানে ঘুরছি।' 'বল কী পাখি! তোমরা তো গাছে থাক। তাহলে থাকার জায়গার অভাব পড়ল কেন। এটা তো একটা বন। অনেক অনেক গাছ আছে এখানে। গাছে অনেক পোকা-মাকড় থাকে। ওগুলোই তোমরা খাবে। গাছের ফল খাবে। তোমাদের সমস্যা হচ্ছে কেন?' মাছরাঙা পাখি চিৎকার করে কেঁদে বলে, 'এই বনে তো গাছই শেষ হওয়ার পথে। আমাদের থাকার জায়গাই নেই।' 'গাছ নেই!' প্রায় চিৎকার করে বলে- রাজা সিংহ। তারপর নিজে নিজেই ভাবে, তাই তো। এই বনের গাছগুলো তো গত কয়েক বছর ধরেই কাটা হচ্ছে। কারও বাড়ি বানানোর জন্য গাছ কাটতে হয়েছে। রাস্তা বড় করার জন্য গাছ কাটতে হয়েছে। গাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য পাওয়ার জন্য গাছ কাটতে হয়েছে। গাছ কাটতে হয়েছে বনের পশুদের বাড়িতে আসবাব বানানোর জন্য। এই বনের গাছ কাটতে হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার জন্য। গাছ তো কাটা হয়েছে। কিন্তু সেই গাছের জায়গায় গাছ তো লাগানো হয়নি। নিজের ডেরা থেকে বের হয়ে আসে রাজা সিংহ। তাকিয়ে দেখে নিজের প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন। শুধু প্রখর রোদ বনে। কোনো ছায়া নেই। হাতে গোনা কয়েকটা গাছ আছে বনে। রাজা বুঝতে পারল বেঁচে থাকার জন্য শুধু খেলেই হবে না। গাছও লাগাতে হবে। এই বনকে বাঁচাতে হলে গাছ লাগাতে হবে। বনের পশু-পাখিদের বাঁচাতে হলে গাছ লাগাতে হবে। রাজা তখন চিৎকার করে বলল, 'শোনো বনবাসীরা, একটি গাছ আমাদের প্রাণ বাঁচাতে পারে। একটি গাছ এই বনকে রক্ষা করতে পারে। আমরা গাছ কেটেছি নিজেদের উপকারের জন্য। এখন আমাদের উপকারের জন্যই গাছ লাগাতে হবে। গাছ না থাকার কারণে একটি বন অকালেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। পরিকল্পনা মতো গাছ লাগাও। যেখানে সেখানে নয়। যাতে বনের উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য ভবিষ্যতে গাছ কাটার প্রয়োজন না পড়ে।' সবাই গাছ লাগিয়েছিল সেই বনে। অতঃপর আবারও খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল সে বন। সেই বন আর কখনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে