বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মরক্ষার যত আইনি অধিকার

দন্ডবিধির ১০৬নং ধারা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সীমা আরও বিস্তৃত করেছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যদি নিরপরাধ ব্যক্তিরও ক্ষতি করতে হয় তবে সে তাও করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি না করেও যদি আত্মরক্ষা করা যায় তবে সেক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি করলে তা হবে অপরাধ। যেমন- একদল লোক 'ক'-কে হত্যার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় 'ক' ওইসব লোকের ওপর গুলি না চালালে মৃতু্য নিশ্চিত। কিন্তু লোক দলের সঙ্গে থাকা ছোট শিশুদের ক্ষতির ঝুঁকি না নিয়ে সে গুলি চালাতে পারে না। এক্ষেত্রে গুলি চালিয়ে কোনো শিশুর ক্ষতি হলেও তা অপরাধ হবে না।
অ্যাডভোকেট মুকুল মুস্তাফিজ
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
আত্মরক্ষার যত আইনি অধিকার

'জীবনের অধিকার' মানুষের অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকারটি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ সব মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রই একবাক্যে স্বীকার করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ তাই নাগরিকদের এ অবিচ্ছেদ্য ও মৌলিক অধিকারটির স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।

প্রশ্ন হলো- এ অধিকারটি রক্ষার দায়িত্ব কার? এ অধিকার রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। তবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে যখন রাষ্ট্রের ওই দায়িত্ব পালনের মতো যথেষ্ট সময় বা সুযোগ থাকে না। যেমন- কোনো একজন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী আক্রমণ করল, তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রের (রাষ্ট্রীয় বাহিনীর) সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলে না।

ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আইন নিরীহের মতো চুপ মেরে বসে থাকার আদেশ দেয় না। আইনে রয়েছে আত্মরক্ষার বিধান। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারা প্রত্যেক নাগরিককে আত্মরক্ষার অধিকার দিয়েছে। এ আত্মরক্ষা করতে গিয়ে হামলাকারীকে জখম করলে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মৃতু্য ঘটলেও তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। দন্ডবিধির ৯৬ ধারা এমনটাই বলেছে।

যে ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার প্রযোজ্য : দন্ডবিধির ৯৭ ধারা অনুসারে দুটি ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার ভোগ করা যায়। প্রথমত, কোনো ব্যক্তির নিজের ও অন্য ব্যক্তির দেহ ক্ষুণ্ন্নকারী যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে তার আত্মরক্ষার অধিকার আছে। এবং দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তির নিজের বা অন্য কারও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি, চুরি, দসু্যতা, অনিষ্ট বা অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ বা এসবের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার আছে।

যেসব কাজের বিরুদ্ধে এ অধিকার প্রযোজ্য নয় : কোনো সরকারি কর্মচারী তার পদাধিকার বলে ও সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করলে বা করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যাবে না যতক্ষণ না ওই কাজ যুক্তিসঙ্গতভাবে মৃতু্য বা গুরুতর আঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। ওই সরকারি কর্মচারীর নির্দেশে কেউ একই কাজ করলে তার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। উলেস্নখ্য, ওই কাজটি আইনের দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত হতেও পারে আবার নাও পারে।

অধিকার প্রয়োগের সীমা : কেউ বেআইনিভাবে আক্রমণের স্বীকার হলে সে যদি পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আশ্রয় লাভের সুযোগ পায় এবং পর্যাপ্ত সময় থাকে তবে সেক্ষেত্রে আত্মরক্ষার এ অধিকার সে ভোগ করতে পারবে না।

আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণকারীর যতটুকু ক্ষতি করা প্রয়োজন তার বেশি ক্ষতি করা যাবে না।

কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সরকারি কর্মচারী (যখন সে সরকারি দায়িত্বরত অবস্থায় থাকে) দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি যদি বুঝতে না পারে যে সে সরকারি কর্মচারী, তবে ওই ব্যক্তি আত্মরক্ষার অধিকার ভোগ করবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীকে আঘাত করলেও তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

দন্ডবিধির ১০৬নং ধারা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সীমা আরও বিস্তৃত করেছে। এতে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যদি নিরপরাধ ব্যক্তিরও ক্ষতি করতে হয় তবে সে তাও করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি না করেও যদি আত্মরক্ষা করা যায় তবে সেক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি করলে তা হবে অপরাধ। যেমন- একদল লোক 'ক'-কে হত্যার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় 'ক' ওইসব লোকের ওপর গুলি না চালালে মৃতু্য নিশ্চিত। কিন্তু লোক দলের সঙ্গে থাকা ছোট শিশুদের ক্ষতির ঝুঁকি না নিয়ে সে গুলি চালাতে পারে না। এক্ষেত্রে গুলি চালিয়ে কোনো শিশুর ক্ষতি হলেও তা অপরাধ হবে না।

যে ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার মৃতু্য ঘটানোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য : কোনো ব্যক্তি বেশকিছু পরিস্থিতিতে আক্রমণের স্বীকার হলে তার দেহ বা অন্য কারও দেহ প্রতিরক্ষায় অপরাধীকে হত্যা করার অধিকার রাখে।

এমন আক্রমণ যার পরিণতি নিশ্চিতভাবেই মৃতু্য। : এমন আক্রমণ যা যুক্তিসঙ্গতভাবে গুরুতর আহত হওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ।

প্রকৃতি বিরুদ্ধ কামলালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ,

অপহরণের উদ্দেশ্যে আক্রমণ : এমন পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করে রাখার উদ্দেশ্যে আক্রমণ, যে পরিস্থিতির জন্য এমন আতঙ্ক সৃষ্টি হয় যে, তার মুক্তির জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষসমূহের আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হবে।

কোনো ব্যক্তি নিম্নোক্ত পরিস্থিতিগুলোতে নিম্নোক্ত অপরাধগুলোর স্বীকার হলে তার সম্পত্তি বা অন্য কারও সম্পত্তি প্রতিরক্ষায় অপরাধীকে হত্যা করার অধিকার রাখে

দসু্যতা (যেমন মৃতু্য ঘটিয়ে বা আহত করে সম্পত্তি চুরি করা)

রাত্রি বেলায় অপথে গৃহপ্রবেশ :বাসগৃহ বা সম্পত্তি সংরক্ষণের স্থানরূপে ব্যবহৃত হয় এমন ইমারত, তাঁবু বা জাহাজে অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে করা ক্ষতি।

এমন অবস্থায় চুরি, সম্পত্তির ক্ষতি বা অনধিকার গৃহপ্রবেশ যা যুক্তিযুক্তভাবে এমন ভয়ের সৃষ্টি করে যে, আক্রমণকারীকে হত্যা না করলে মৃতু্য বা গুরুতর জখমই হবে তার পরিণতি।

আত্মরক্ষা অধিকারের শুরু ও স্থিতিকাল : দেহের ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার আক্রান্ত হওয়ার আগেই শুরু হয়। ওই অপরাধ সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ বা ভীতি থেকে দেহ বিপন্নকারী যুক্তিযুক্ত আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অধিকার শুরু হয়ে যায়। এবং যতক্ষণ এ আতঙ্ক বিরাজ করে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অধিকার বলবৎ থাকে।

সম্পত্তি রক্ষার ক্ষেত্রে এ বিধানটি একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে যতক্ষণ না আক্রমণ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অধিকার সৃষ্টি হয় না। চুরির ক্ষেত্রে এ অধিকারটি, ওই সম্পত্তি সহকারে অপরাধী না পালানো বা সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য লাভ না করা বা ওই সম্পত্তি উদ্ধার না করা পর্যন্ত বলবৎ থাকে। দসু্যতার ক্ষেত্রে, কোনো ব্যক্তির মৃতু্য ঘটানো, আঘাত করা, অবৈধভাবে আটক করা বা এসবের উদ্যোগ চলতে থাকা পর্যন্ত চলতে থাকে।

মুকুল মুস্তাফিজ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ইমেইল: সঁশঁষসঁংঃধভরু@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে