শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরএসএন স্টিমারের টিকেট ক্লার্ক

সমীর আহমেদ
  ১৪ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

দুপুরে খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে এসে বাসার দিকে বাঁক নেওয়ার আগেই কাজী শাজাহান ওরফে খোকা মিয়া বা খোকা কাজীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ঢাকা থেকে খুলনাগামী আরএসএন স্টিমারের এককালের টিকেট ক্লার্ক সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির। খোকা কাজী ব্যস্ত। বঙ্গবন্ধু আসবেন রাঙামাটি। দিন-তারিখ-সময় ঠিক হয়ে গেছে। পুলিশ, প্রশাসন ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তাকে প্রটোকল দেওয়ার জন্য প্রস্তুতির কোথাও কোনো ঘাপলা আছে কিনা, রাত-দিন তাই শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবাই। এলাকায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত লোকের আনাগোনা বেড়েছে কিনা ডিএসবির লোক হিসেবে সেদিকে তীক্ষ্ন নজর দিতে হচ্ছে খোকা কাজীকেও। এখন সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির দিকে তাকানোর তার সময় কোথায়! সে তাকে এড়িয়েই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ভিড়ভাট্টাহীন, প্রায় ফাঁকা রাস্তার মোড়ে দুজন মুখোমুখি, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তারপরও সে তাকে লক্ষ্য করেনি, এমন একটা ভাব নিয়ে তার পাশ দিয়ে কেটে পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি তার সামনে এসে একেবারে পথ আটকে দাঁড়িয়ে, খোকা ভাই! বঙ্গবন্ধু তো আগামী কাল আসছেন। আমার কথা মনে থাকবে তো ভাই? এবার যদি কিছু না হয়, তাহলে...।

তার চোখে প্রায় টলমল করে জল। খোকা কাজী বলেন, ঠিক আছে চিন্তা করবেন না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

কিন্তু তাতেও যেন নাসির উদ্দিন আশ্বস্ত হতে পারেন না। খোকা কাজীর হাতটা চেপে ধরে বলেন, ভাই, পিস্নজ। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি, জানেন তো।

জানি। তা আর বলতে হবে না। আমি চেষ্টা করব, বললাম তো।

তারপরও নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি পথ ছাড়তে চায় না। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলাও তার উচিত না। গোয়েন্দারা তার ওপরেও তো নজরদারি করতে পারে। কাল যদি কোনো সমস্যা হয়, সেও ছাড় পাবে না, কোথায় কার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কী কথা বলেছে, কেন বলেছে, জবাবদিহি করতে হবে। যদিও কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই। পাকদের দোসর রাজাকাররা এই সদ্য স্বাধীন দেশে ঘাপটি মেরে থাকলেও সহসাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পাবে না। তবে তা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। সবকিছু বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখতে হচ্ছে। কিন্তু এখন এই নাসির উদ্দিনকে নিয়ে সে কী করে? তাকে তো উপেক্ষা করাও কঠিন। সে তাকে আশ্বস্ত করে ফের, কাল সারাক্ষণ আপনি আমার কাছাকাছি থাকবেন। যে যা-ই বলুক, আমার কাছ থেকে দূরে যাবেন না। তারপর কী করতে হবে কাল বলে দেবো। এখন আমার তাড়া আছে, ভাই। যাই।

নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির চোখেমুখে কিছুটা আশার ঝিলিক খেলা করে। সে আর কোনো কথা বলে না। খোকা কাজী তার পাশ দিয়ে চলে গেলে সে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির আদি ঠিকানা মাদ্রাজ বলেই নামের সঙ্গে মাদ্রাজি যুক্ত হয়ে গেছে। প্রায় পঁচিশ বছর আগে সে আরএসএন স্টিমারের টিকেট ক্লার্ক ছিল। তখন নাসির উদ্দিনের সঙ্গে খোকা কাজীর বেশ খাতির। খাতির ছিল শেখ মুজিবের সঙ্গেও। ঢাকা থেকে পাটগাতি কিংবা পাটগাতি ঘাট থেকে ঢাকা আসা-যাওয়া করতে স্টিমারে কখনো কামরা পাওয়া না গেলে নাসির উদ্দিনের কামরাই ছিল রাতে ঘুমানোর একমাত্র উপায়। শেখ মুজিবকে সে খুব পছন্দ করত। দেখা হলেই বলত, লিডার কামরা পাইছেন? না পাইলে চলে আসেন আমার কামরায়। এই যে রুমের চাবি।

একদিন স্টিমারে এসে শোনেন সেই নাসির উদ্দিন হঠাৎ উধাও। ঝালকাঠীর এক হিন্দুর মেয়ের সঙ্গে তার কীভাবে প্রেম হয়েছিল, স্টিমারের কেউ কিছু বলতে পারে না। কয়েকদিন পর স্টিমারের লোকজন জানতে পারে নাসির উদ্দিন পালিয়েছে হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করেই। বউকে নিয়ে কোথায় গেছে কেউ জানে না।

খোকা কাজী পুলিশে চাকরি করেন। বছর পাঁচেক আগে বদলি হয়ে রাঙামাটি ডিএসবি অফিসে। এখানে আসার পর তার প্রথম তদন্তের দায়িত্ব পড়ে রাঙামাটি ফিসারিজ প্রকল্পের পরিচালকের। তাকে সরকারি খেতাব দেওয়া হবে, এজন্যই তদন্ত। অফিসে গিয়ে দেখেন তিনি নেই। কী করা যায়, হাতে সময়ও নেই। তদন্ত রিপোর্ট দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। কাগজে নামটা দেখেই তার মনে কেমন যেন খটকা লাগে। তাই অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে খোকা কাজী সরাসরি তার বাসায়। গিয়েই চমকে ওঠেন, তার সন্দেহ তো অমূলক নয়। এ তো সেই আরএসএন স্টিমারের টিকেট ক্লার্ক সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি! খোকা কাজীকে দেখে সেও বিস্মিত।

আরে খোকা ভাই আপনি!

তারপর দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। নাসির উদ্দিন বলে, কোথা থেকে কীভাবে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

এলাম আপনার খোঁজখবর নিতে। কয়েকদিন আগে ডিএসবি অফিসে বদলি। আজ হাঁটতে হাঁটতে গেলাম আপনার অফিসে। নাম দেখেই সন্দেহ হলো, আপনিই সেই নাসির উদ্দিন কিনা। আপনাকে অফিসে না পেয়ে বাসার ঠিকানা নিয়ে চলে এলাম।

খুব ভালো করেছেন। এখানেই মন খুলে কথা বলা যাবে। কতকাল পর দেখা! তাই না?

হুম। তদন্তের কথা চেপে গেলেন খোকা কাজী। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন নাসির উদ্দিনের প্রেমকাহিনি।

স্বপ্না রায়, বুঝছেন ভাই। আমার স্বপ্ন, সারাজীবনের স্বপ্ন। আরএসএন স্টিমারেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তারপর আর মন ফেরাতে পারিনি। সেও তাই। ঠিকানা চেয়ে নিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র লিখতাম। সেও জবাব দিত। দুজনের প্রেম একেবারে কাঁঠালেরর মতো লেগে গেল। ওর পরিবারের লোকজন কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। পাত্র দেখাদেখি চলছিল। বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। একদিন সে কাপড়ের একটা পুঁটলি নিয়ে পালিয়ে এলো স্টিমারে। বলল, বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। একবারে চলে এসেছি। আমি দেখলাম মহাবিপদ। স্বপ্নাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না। আবার বিয়ে করেও ঢাকায় রাখতে পারব না। ওর পরিবার খোঁজখবর পেয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু না বলে ওকে নিয়ে পালিয়ে এলাম রাঙামাটি। এখানে আমার এক মাদ্রাজি বন্ধু ছিল ফিসারি প্রজেক্টের মৎস্য গবেষক। সোজা গিয়ে উঠলাম ওর বাসায়। আর কী সৌভাগ্য আমার! একদিন পরই ফিসারি প্রজেক্টের হিসাবরক্ষকের পদটা খালি হয়ে গেল। বন্ধুর কৃপায় চাকরি হয়ে গেল এখানে। স্বপ্নাকে নিয়ে সংসার পাতলাম। সতী লক্ষ্ণী বউ আমার। ওকে না পেলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যেত।

খোকা কাজী বুঝতে পারলেন সংসার, ছেলেমেয়ে, চাকরি, সব মিলিয়ে বেশ সুখেই আছেন মাদ্রাজি। নাসির উদ্দিন বললেন, ঢুকেছিলাম হিসাবরক্ষক পদে। কাজকর্ম ভালো পারি। তা ছাড়া আমার বাড়ি মাদ্রাজ। ভালো উর্দু জানি বলে অফিসের উপরের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার বেশ খায়খাতির। তারা খুশি হয়ে আমাকে প্রকল্প পরিচালকের পদে পদোন্নতি দিয়েছে। রুল কিছুটা ব্রেক হয়েছে বটে। এজন্য তো আমি দায়ী না। তবু অফিসের কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে ফোঁস ফোঁস করছে। করুক, কী আসে যায় তাতে। আমার কাজ আমি করছি। আমি তো পদটা জোর করে আদায় করিনি। আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে, আমি নিয়েছি। সাধা লক্ষ্ণী পায়ে ঠেলে দেওয়া তো উচিত নয়, তাই না ভাই?

খোকা কাজী বলেন, হ। তা তো ঠিকই। আপনার সেই বন্ধুর খবর কী, মৎস্য গবেষক?

ওহ! আবছার উদ্দিন মোলস্না? ওর কথা আর বলবেন না ভাই। সংসারে হাজার সমস্যা। একমাত্র পোলা তো, বাবা-মা কিছুতেই চায় না, ও এত দূরে চাকরি করুক। আমি আসার পর ও মাস ছয়েক ছিল। তারপর বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে চলে গেছে মাদ্রাজ। সেখানেও বেশ ভালোই আছে আবছার।

যোগাযোগ হয়?

হয়। চিঠিপত্র লিখি আমি। আবছারও লেখে।

বউকে না দেখিয়ে সে ছাড়লই না নাসির। বেশ সুন্দরী। দেবীর মতো স্বপ্না রায়। যেমন রূপে, তেমনই গুণে- কথাবার্তা, আচরণেও।

চা-নাশতা খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলেন খোকা কাজী। পরদিন অফিসে গিয়ে তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন, 'খেতাবের যোগ্য নয়। কারণ হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে।' এ ছাড়া তার কোনো উপায়ও ছিল না।

স্বাধীনতার পর অফিসের পুরনো শত্রম্নরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নাসিরের। তারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকদের সঙ্গে মিশে এলাকার জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। কোলাবোরেট আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলে। বিচারের মুখোমুখি করা হয় তাকে। ব্যাপক তদন্ত হয়। সাক্ষীসাবুদে প্রমাণিত হয়, অফিসে উচ্চপদ বাগিয়ে নেওয়া ছাড়া পাকদের সঙ্গে এলাকার ধ্বংসাত্মক কোনো কাজে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। জেল থেকে খালাস পায় সে। তবে প্রকল্প পরিচালকের পদটি হারায়; যেহেতু সে তা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পেয়েছে। এখন পুরোপুরি বেকার। বড় পদে ছিল বলে, ছোটখাটো কোনো কাজও করতে পারছে না। টাকা-পয়সা যা জমিয়েছিল, তা প্রায় সবই খুইয়েছে মামলায়। এখন বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ কষ্টে আছে। কয়েক দিন আগে সে গিয়েছিল খোকা কাজীর বাসায়, ভাই, লিডার তো এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। আপনার বাল্যবন্ধু। আপনার সঙ্গে বেশ খাতির। আমার ব্যাপারটা তাকে খুলে বলুন। আমার চাকরিটা ফিরিয়ে দিন। পরিচালকের পদ না হোক, হিসাবরক্ষক পদ দিলেই চলবে।

খোকা কাজী বলেছিলেন, দেখি কী করা যায়।

কী করবেন তিনি। শেখ মুজিব তার বাল্যবন্ধু। শৈশবে একসঙ্গে খেলাধুলা করেছেন, স্কুলে গিয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন। গরিব ছাত্রদের জন্য মুষ্ঠি চাল সংগ্রহ করেছেন। তাদের গৃহশিক্ষক শাখাওয়াত উলস্নাহ পাটোয়ারী স্যারের কাছে দুজনে একসঙ্গে পড়েছেন। দীর্ঘ ছুটিছাটায় শাখাওয়াত স্যার নোয়াখালী যেতেন। তখন তার ট্রাঙ্ক মাথায় করে পাটগাতি লঞ্চঘাট দিয়ে আসতেন তারা দুজন। কিছুদূর শেখ মুজিব, কিছুদূর খোকা- মাথায় বহন করতেন তার ট্রাঙ্ক। এভাবে পর্যায়ক্রমে পথ শেষ হতো। তার কারণেই গোপালগঞ্জে পিএম হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা, দুজনে একসঙ্গে সেই মোলস্নাহাটে আব্বাস উদ্দীনের গান শুনতে যাওয়া, আরও কত স্মৃতি! তার নামও খোকা বলে, শৈশব থেকেই দুজনের মধ্যে মিতালীর সম্পর্কে। একে অন্যকে সম্বোধন করেন মিতা বলে। কলকাতায় মিতা তাকে বলেছিলেন রাজনীতি করতে।

মিতা তোমার পড়াশোনার সব খরচ আমার। তুমি ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হও। রাজনীতি করো।

খোকা কাজী রাজি হননি। শৈশব থেকেই মা হারা সে। সংসারের যা অবস্থা, বড় ভাইয়ের ঘাড়ের ওপর আর কতদিনই বা চেপে থাকা যায়! চাকরিটাই বড় প্রয়োজন। মিতার সায় নিয়েই তো চাকরিতে যোগ দিয়েছিল সে। শৈশবের সেই মিতা কি তাকে ভুলে গেছে! না, তা অসম্ভব। শেখ মুজিব শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট হলেও তাকে সে চিনবে। জড়িয়ে ধরবে। প্রাণ খুলে সেই আগের মতই কথা বলবে। সে যেখানেই থাকুক, যত ছোট পদেই চাকরি করুক না কেন- এ বিশ্বাস তার আছে।

কিন্তু নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির ব্যাপারটা তাকে সে কীভাবে বলবে? নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কোনোদিন সে তদবিরে যায়নি। এই যে সে রাঙামাটি পড়ে আছে প্রায় ৪-৫ বছর, শুধু তাকে একটু জানালে দেশের যেখানে খুশি সেখানে সে বদলি হতে পারে। কিন্তু এটুকু বলতেই তার খুব অস্বস্তি। খুব লজ্জা লাগে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। বাল্যবন্ধু এখন দেশের প্রেসিডেন্ট বলেই সে সুবিধা নেবে, দাপট দেখাবে, তদবির করবে, তা হয় না। তার দ্বারা এসব হবে না। দুজনের মধ্যে শৈশব থেকে যেরকম একটা পবিত্র সম্পর্ক বিদ্যমান আছে, সেরকমই থাক। শেখ মুজিবও জানেন, তার মিতা মোটেও ধান্ধাবাজ লোক না। কিন্তু সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির ব্যাপারটাও তো উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তার সংসারে চার-পাঁচজন লোক। অভাব-অনটন লেগেই আছে। হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করেছে বলে সহজে সে কোথাও কাজও পাবে না। আর কাজ না পেলে সে খাবে কী? পরিবারের ভরণপোষণ সে কীভাবে করবে? সব মিলিয়ে তার জীবনমরণ দশা। তা ছাড়া তার বুকের ভেতর একটা বিষয় খালি খোঁচায়। যদিও এতে তার কোনো অপরাধ ছিল না। সে তো সত্যিই লিখেছিল। তারপরও ব্যাপারটা এখন মাঝেমধ্যে তাকে পীড়া দেয়। রিপোর্টটা ভালো দিলে হয়তো বা সে খেতাবটা পেয়েও যেতে পারত। যদিও খেতাব না পেয়ে তার জন্য শাপেবরই হয়েছে। তাহলে তার শত্রম্নরা আরও বড় ধরনের ঝামেলার জালে তাকে জড়িয়ে ফেলত। এত তাড়াতাড়ি জেল থেকে বেকসুর খালাস পেত না নাসির। তবু ব্যাপারটা তার কাছে কেমন যেন লাগে। যখনই মনে পড়ে বেশ অস্বস্তি বোধ করে খোকা কাজী। এখন তার জন্য আসলে কিছু একটা করা উচিত। কিন্তু সে তো এগোতে পারছে না। সব সংকোচ তাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে স্থবির করে দিচ্ছে।

বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে নাসির উদ্দিন মাদ্রাজির মুখখানা মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছয় মাস জেল খেটে, চাকরি হারিয়ে তার অবস্থা কী শোচনীয়! শরীর বেশ ভেঙে গেছে। এভাবে বেশিদিন সে বাঁচবে না।

বঙ্গবন্ধুর রাঙামাটি আসা ফাইনাল। এ সংবাদ শোনার পরই সে তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়েছিল বাসায়।

ভাই, শোনলাম বঙ্গবন্ধু রাঙামাটি আসতেছে, সত্যিনি?

হ। সত্যিই।

তার কোটরাগত চোখমুখ থেকে তখনই বেরিয়ে এসেছে কিছুটা আশার ঝিলিক। তাহলে এবার ভাই, আমার জন্য কিছু করেন।

আপনিই বলুন তাকে। আপনাকে ভুলে যাওয়ার কথা নয় তার।

আমি তো তার কাছে ঘেঁষার সুযোগই পাবো না।

হ। তাও তো ঠিকই।

আপনার বাল্যবন্ধু। তাছাড়া আপনি ডিএসবির লোক। আপনার সুযোগ হবে তার কাছে যাওয়ার। ভাই, পিস্নজ, আমার জন্য কিছু করুন। তা না হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না। দেখি কী করা যায়।

তারপর থেকে সে পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। দেখা হলে আর ছাড়তে চায় না। মাঝেমধ্যে অফিসে গিয়েও খোঁজ করে। সেখানে না পেলে বাসায়। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্ত হন খোকা কাজী। কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকালে কিছু বলতে পারেন না। বিধ্বস্ত চেহারা। ভীষণ মায়াই লাগে। তার উছিলায় আবার যদি চাকরিতে পুনর্বহাল হতো সে! আগামীকাল কি আদৌ দেখা হবে তার মিতার সঙ্গে?

অফিসের কাজকর্ম, মাদ্রাজির জন্য খানিক টেনশন, বহুদিন পর মিতার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার উত্তেজনায় ঘুমে-জাগরণে রাতটা কেটে গেল। সকালেই তিনি চারদিকে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন।

\হমিতা এসেছেন। এই নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, প্রেসিডেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মঞ্চে তার আবেগঘন বক্তৃতা চলছে। মানুষকে পাকদের হাতে বিধ্বস্ত এই বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। মানুষ কাঁদছে তার বক্তৃতা শুনে। সর্বস্ব হারিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে তারা। খোকা কাজীর চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পড়ে, এই মহান নেতাই তার মিতা! বাল্যবন্ধু! আনন্দে ও গর্বে তার বুকটা ভরে যায়।

\হসৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি আছেন তার খুব কাছে। সকালেই তিনি তাকে বলে দিয়েছেন, আজ আপনি আমার খুব কাছাকাছি থাকবেন। আমি থাকব এমন এক জায়গায় যাতে নেতা আমাকে দেখতে পায়। আর আমাকে দেখলে তিনি এক মিনিটের জন্য হলেও গাড়ি থামাবেন। আমার সঙ্গে কথা না বলে তিনি যাবেন না। সে সময় আপনি তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকবেন। তারপর যা বলার আমি বলব।

ঠিক আছে ভাই। আপনার ওপর আমার ভরসা আছে।

ডিসি অফিসে মিটিং। তারপর মঞ্চে বক্তৃতা শেষে খোকা কাজী দেখেন, মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন তার মিতা- স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তার গাড়ি বহরের দিকে। তাকে ঘিরে রেখেছে নিরাপত্তা রক্ষী, ডিসি, এসপি, ডিএসবির কর্মকর্তা ও বিশ্বস্ত নেতারা। গাড়িবহর নিয়ে এখনই বেরিয়ে যাবেন তিনি। খোকা কাজী আবার চোখ বুলালেন জায়গারটার দিকে যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, এখান দিয়েই যাবে তার গাড়ি বহর। আর বিধাতা যদি সহায় হোন মিতার সঙ্গে দেখা তার হবেই।

\হপোঁ পোঁ পোঁ, পিঁ পিঁ পিঁ হর্ন বাজিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়ি একের পর আরেক বেরিয়ে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে নেতার গাড়ি। এত লোকের মধ্যে সে কি তাকে দেখতে পাবে? এতদিন পর চিনতে পারবে!

আরও কাছে আসতেই নেতার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল খোকা কাজীর। তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। শেখ মুজিবের চোখটাও ক্ষণিকের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপরই চালককে বললেন, থামাও গাড়ি, নামতে হবে।

চালক গাড়ি থেকে নেমে দরোজা খুলে দিলেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এগিয়ে গেলেন খোকা কাজীর দিকে।

আরে মিতা! কেমন আছো তুমি? অনেক বছর পর দেখা, তাই না?

তুমি কেমন আছো?

হাত বাড়িয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। জড়িয়ে ধরলেন শৈশবের মিতাকে। খোকা কাজীর চোখ থেকে আবেগে টপাটপ নীরবে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রম্ন।

সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি তখন বঙ্গবন্ধুর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছেন। তার দিকে একবার তাকিয়ে খোকা কাজীকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, কে এই লোক? এভাবে কাঁদছে কেন, মিতা?

\হখোকা কাজী বললেন, তাকে তুমিও বেশ ভালো করেই চেনো। আরএসএন স্টিমারের টিকেট ক্লার্ক...

সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজি! তার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে তার?

\হখোকা কাজী সংক্ষেপে খুলে বললেন সব। মাত্র মিনিট দুয়েক সময় পেলেন। এর মধ্যেই সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে উঠছে। ডিসি, এসপি এবং নিরাপত্তা রক্ষীরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন প্রেসিডেন্টের কাছে। ডিসিকে শেখ মুজিব নির্দেশ দিলেন, আজই সৈয়দ নাসির উদ্দিন মাদ্রাজিকে ফিসারি প্রজেক্টের হিসাবরক্ষক পদে পুনর্বহাল করুন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108725 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1