শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্য অবহেলার কাল

হাসান মাহমুদ
  ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সাহিত্য; সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত একটি শাখা হলেও সাহিত্য ছাড়া সংস্কৃতির সব শাখাই যেন অচল। সংস্কৃতির সব শাখায় রয়েছে সাহিত্যের প্রত্যক্ষ ও সফল বিচরণ। আর ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিতে সাহিত্যের অবস্থান সবার শীর্ষে। এ ছাড়া ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি কিংবা অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতিতেও সাহিত্যের উপস্থিতি স্বদর্পে দৃশ্যমান। ভাব আদান-প্রদানের জন্য ভাষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনিই যে কোনো ভাষার জন্য সাহিত্যও ততটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভাষার প্রাণ হচ্ছে সাহিত্য। শুকিয়ে যাওয়া মৃত বৃক্ষে যেমন ফুল, ফল, পাতা কিছুই হয় না, সময়ের ব্যবধানে বিলীন হয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে ঠিক তেমনিই সাহিত্যহীন ভাষা মৃত বৃক্ষের মতো, সময়ের ব্যবধানে কালের গর্ভে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন ভাষা বিলুপ্তির ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। সাহিত্য না থাকার কারণে অসংখ্য ভাষা হারিয়ে গেছে সময়ের অতল গহ্বরে। একটি ভাষার উৎকর্ষ সাধনের জন্য, প্রসার ও বিকাশের জন্য, সময় উপযোগিতা স্থাপনের জন্য, শব্দ ভান্ডার বিস্তৃতির জন্য বেশি বেশি সু-সাহিত্যচর্চার কোনো বিকল্প নেই। যেমন আর্য ভাষা থেকে সংস্কৃত, মাগধী ইত্যাদি স্তর পার হয়ে আজকের এ উন্নত বিকশিত বাংলা ভাষা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সাহিত্যের একথা যে কোনো ভাষাবিদ এক বাক্যে স্বীকার করবে। চর্চাপদ থেকে সোনালি কাবিন থেকে ভাষার যত চড়াই-উতরাই সব সাহিত্যের ঘাড় বেয়েই পার হয়ে এসেছে। সেই দুর্বোধ্য ভাষা আর এ সময়ের সুবিকশিত সাবলীল বাংলা শব্দ হয়ে ওঠার ইতিহাসের মহানায়ক বাংলা সাহিত্য। কোনো একটি শব্দ মহাকাল পাড়ি দিলেই যে তা সহজ ও বিকশিত হয়ে যাবে বিষয়টা মোটেও তেমন নয়, ভাষা বিকাশের জন্য প্রয়োজন অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। সাহিত্যিকরা ভাষা বিকাশের প্রধান কারিগর। সাহিত্যের মাধ্যমে ভাষা হয়ে ওঠে সুন্দর সাবলীল ও বোধগম্য। বিশ্ব ভাষায় বাংলার যে সু-গর্ব অবস্থান তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র সাহিত্যের জন্য। কোনো ভাষাবিদ ভাষার উৎকর্ষ সাধনে এত অবদান রাখতে পারে না যতটা রাখতে পারে একজন সাহিত্যিক। একটি জাতীর জন্য ভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সুচিন্তিত মানুষ মাত্রই বুঝতে পারে। ভাষার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল একটি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি। এমনকি জীবনব্যবস্থার ওপরও ভাষা প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। রীতিনীতি প্রথার ওপর ভাষার যেমন প্রভাব রয়েছে তেমনি প্রভাব রয়েছে ভাষাভাষী মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপরও। ভাষার গুরুত্ব তো সবাই স্বীকার করবে; কিন্তু ভাষার প্রাণ যে সাহিত্য তা নিয়ে ভাবে কজন। সাহিত্য হচ্ছে একটি ভাষার সজীবতা, জীবনীশক্তি। সাহিত্য ভাষাকে বিকশিত করে, মাধুর্যতা দান করে, সাবলীল করে এবং প্রসার করে। শব্দ ভান্ডারের বিস্তৃতির জন্য, ভাষার সজীবতা রক্ষার জন্য সাহিত্যচর্চার বিকল্প আর কী হতে পারে? কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিই, ভাষাগত চেতনা ধারণ করে ভাষার রাজনীতি করি, কিন্তু এ ভাষার যে জীবনীশক্তি তার দিকে একবার ভ্রম্নক্ষেপও করি না। আজকের দিনে সাহিত্য এতটাই অবহেলিত যে, মানুষ সাহিত্যচর্চাকে বেকার মনে করে। সাহিত্যচর্চা আজকের সমাজে নিছক সময় অপচয় কিংবা পাগলামি। কেউ একবার চিন্তা করে না আমাদের যে চেতনা, যে অহংকার তার ধারক বাহক এ ভাষা আর এ ভাষার সাহিত্য। সংস্কৃতির এমন কোনো শাখা আছে যেখানে সাহিত্যের ভূমিকা নেই? সংগীত, নৃত্য, নাটক, সিনেমা সব কিছুরই মূলে কী সাহিত্য নয়? প্রতি বছর সংগীত ও চলচ্চিত্রের পিছনে আমাদের রাশি রাশি টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু এ সংগীত (গান) ও নাটক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে যে সাহিত্যের অবস্থান তার জন্য আমরা কত ব্যয় করি? বর্তমান বাংলা সিনেমা (চলচ্চিত্র) মানুষ দেখে না, কারণ এ সিনেমার মূল থিম সাহিত্য থেকে কিছুটা সরে এসে কতিপয় পরিচালক ও পডিউসারের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। সিনেমার পরিচালকরা গল্প সাহিত্যিকদের কাছ থেকে না নিয়ে নিজেরাই রচনা করে। কিন্তু এক সময় আমাদের সাহিত্যিকরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করত। চলচ্চিত্রের নির্মাতারা নিজেরা গল্প বানায় সাহিত্যক না হয়েও এবং সিনেমা তৈরি করে, ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়। বর্তমান সিনেমাতে না আছে কাহিনির ধারাবাহিকতা, না আছে সুন্দর উপস্থাপন। নোংরামি আর বেহায়াপনাই হয়ে উঠেছে বর্তমান চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য। পথে-প্রান্তরে বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে মানুষ কৌতুক করে, অবজ্ঞার ঝড় তোলে। টিভির পর্দায় বাংলা সিনেমা দেখলে রিমোট খুঁজতে ব্যস্ত যায়। তাই তো আমাদের ঘরে ঘরে চলে বিদেশি চ্যানেল। আমরা যে সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করি সে সংস্কৃতির মূল উপজীব্য বাংলা সাহিত্য, সে সাহিত্যে আমাদের উদাসীনতার কারণে আজ সাধারণ মানুষ বিদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে কিন্তু সংস্কৃতির প্রধান সাহিত্যের জন্য কোনো মন্ত্রণালয় নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংস্কৃতি অন্য সব শাখার প্রতি কাগজে-কলমে সামান্য ভ্রম্নক্ষেপ করলেও সাহিত্যর প্রতি চির-উদাসীন। যেন সংস্কৃতিতে সাহিত্যের কোনো অবদানই নেই, সাহিত্য যেন চির অপ্রয়োজনীয়। বাংলা সাহিত্যে যেন এক অবহেলার মহাকাল পাড়ি দিচ্ছে। দিনের পর দিন অবহেলিত হতে হতে সাহিত্য নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে বসেছে। ফলে সাহিত্যে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা সাহিত্য থেকে দূরে সরে গেছে, ফলে সাহিত্যিকদের জায়গা দখল করেছে প্রতিভাহীন স্বঘোষিত সাহিত্যিক বা স্বঘোষিত কবি লেখকরা। এখনকার বাংলা সাহিত্য মানে অশ্লীলতা, ব্যক্তি পূজা কিংবা শব্দ চুরি। তাই তো দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্য পাচ্ছে না কোনো গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, দেবদাস কিংবা সোনালি কাবিন। অল্পস্বল্প সৃজনশীল যা আসছে তাও থাকছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কোনো মূল্যায়ন নেই, উৎসাহ নেই, নেই সাহিত্যিকদের প্রেরণা দেওয়ার মতো কোনো কার্যক্রম। অবহেলার মহাকাল পাড়ি দিতে বাংলা সাহিত্য আজ পঙ্গু প্রায়। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রতি আমাদের অবস্থানের উন্নয়ন না করলে অবহেলার মহাকাল পাড়ি দিতে দিতে বাংলা সাহিত্যের প্রদীপ একদিন নিভে যাবে, সজীবতা হারিয়ে ফেলবে বাংলা ভাষা। মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আমাদের অহংকার, আমাদের চেতনা ও জাতিগত স্বকীয়তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<116140 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1