সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনুভূতি

আনোয়ার রশীদ সাগর
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ঘোর অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভিজে যাচ্ছি জ্যোৎস্নালোতেও। মেঘ ভেসে যেতে যেতে তার পাখাগুলো উঁচু করে মেলে ধরছে, ঠিক তখন চাঁদ তার সোনাঝরা মুখ বের করে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর আমি জ্যোৎস্না আলোয় পস্নাবিত হচ্ছি। একটু পরেই বেজে উঠবে 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে......' রাত পোহালেই বিজয় দিবস।

নূপুর তার নৃত্যের তালে তালে রুমুঝুমু রুমুঝুমু শব্দ করে দখলে নিচ্ছে মন ও মগজকে। আমি দিশেহারা হয়ে ঘুরছি মাঠ থেকে মাঠে মাঠে। দুপুর রাতের ঘুম স্বপ্ন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে জানি না। ক্যানেলের পানিতে ঝাপড় খেলতে খেলতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সাদা চোখের মনি। নূপুর মিষ্টি গাল জড়িয়ে খিলখিল করে হেসে জড়িয়ে ধরছে পাঁজা করে। নূপুরের চোখও হালকা লাল হয়ে গেছে। ফর্সাগালের সঙ্গে লালচোখ, তারপর ভেজা ঠোঁট অপরূপ সৌন্দর্যের মহাবন্যা বয়ে যেতে থাকে। পেছনে ছড়ানো একগুচ্ছ ভেজাচুল থেকে টপটপ করে ঝরছে ঝরনাধারার পানির নাচন।

নূপুরের মা এসে বকা দেয়, ধামড়ি মেয়ে বড় হচ্ছে হুঁশ হচ্ছে না।

নূপুর পানি থেকে খাড়া হয়ে, তার দু'হাত দিয়ে শরীরে সেঁটে থাকা ভেজা ফ্রক টেনে টেনে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। তারপর ধীর পায়ে পা ফেলে পানি থেকে উঠে চলে যায় তার মায়ের সঙ্গে। আমিও হাপুস-হুপুস দু'ডুব দিয়ে, মুখে দুহাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করে উঠে দৌড়াই। স্কুলে যাব, বেলা হয়ে গেছে।

প্রতিবেশী ঝুমু খালার মেয়ে নূপুর। ওর বাবা আব্দুল প্রাইমারি স্কুলের নাইটগার্ড। বেতন খুবই কম আব্দুল চাচার। স্বভাব-আচার-আচরণ ভালো হওয়ার কারণে কমিটির লোক বেশ কিছু টাকা উৎকোচ নিয়ে তাকে নিয়োগ দিয়েছে। রাতে স্কুল পাহারা দেয় এবং দিনে স্কুলের পাশে ঝালমুড়ি বিক্রি করে। প্রাইমারি স্কুলে দপ্তরি বা পিওন না থাকার কারণে মাঝে মাঝে আব্দুল চাচাকে শিক্ষকদের অথবা কমিটির লোকের হুকুম শুনতে হয়। কোনো শিক্ষা অফিসার বা গেস্ট এলে, আপ্যায়নের জন্য আব্দুল চাচার ডাক পড়ে। আর সে কারণে স্কুলের পাশে থেকেই বাড়তি কিছু আয় করার কৌশল বের করে নিয়েছে আব্দুল চাচা। শিক্ষকরাও দেখে, আব্দুল স্কুলের পাশে থাকলেই সুবিধা হয়। অনেকটা পুরাতন প্রবাদের মত 'রথ দেখাও হবে- কলা বেচাও হবে'।

আমি আর নূপুর পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করি।

প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গেই হাইস্কুল। অজপাড়া গাঁয়ের এই স্কুলের খুব নাম-ডাক। অনেক বড় বড় কর্মকর্তারা এই স্কুলের ছাত্র ছিল। কিন্তু তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বাড়িগাড়ি করে বসবাস করে। তাই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে, প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা বদর স্যারের আফসোস, কাউকে দেশপ্রেমিক বানাতে পারলাম না গো!

তিনি বলেন, শোন বাবারা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, তোমরা এখন দেশটাকে গড়বা। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি হলেই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

স্যারের বড় আফসোস ছিল, যুদ্ধের কারণে এসএসসি পাস করে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। তাই শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য এই গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষ বানাতে পারছে না। যত ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ তৈরি হচ্ছে।

তিনি জোর গলায়ই বলে, গ্রামের কৃষক-শ্রমিকরা ওই শিক্ষিত লোকগুলোর চেয়ে অনেক ভালো-রে বাবা। আমি শিক্ষক, আমার কাছ থেকেও টাকা নেয়। কারা তাদের এই লেখাপড়া করিয়েছে, বলো-তো বাবা?

এ ধরনের অনেক আফসোস তার। স্বাধীনতা পঞ্চাশটা বছর হয়ে গেল অথচ দেশের মানুষকে মানুষ হতে দেখেনি, দেখেনি দেশের জন্য কিছু করতে।

টিপটপ বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়োহাওয়া বয়ে যায়। শ-শ শব্দ হয়। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় নরম ও কুসুম কুসুম ঠান্ডা বাতাস। অনুভূতিতে নাড়া দেয়। নূপুর তার রাঙা পায়ে নেচে নেচে দুলেদুলে দোলা দেয় মনের গহিনে। দশম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে পালিয়ে যাব আমরা, এরকম ভাবনা মাথায় দোল খেয়ে যায়। এরই মধ্যে হাইস্কুলের অফিসে চুরি হয়ে যায়। চোররা কিছু নেয়নি। শুধু রেগুলেশন এবং হাজিরা খাতা নিয়ে গেছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক নূপুরের বাবাকেই দোষ দিতে থাকে। এক সময় পুলিশেও ধরিয়ে দেয়।

\হপরিচালনা কমিটি উৎকোচ নিয়ে একজন অতিরিক্ত অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু ওই অফিস সহকারী সরকারি বেতনের অংশ পেত না। একই ক্যাম্পাসে থাকার সুবাদে আব্দুল চাচার সঙ্গে ওই অফিস সহকারীর সুসম্পর্ক হয়ে যায়। যে কারণে আব্দুল চাচা প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতিকে অফিস সহকারীর জন্য সুপারিশ করেছিল। আব্দুল চাচা অফিস সহকারীর হাঁড়ির খবর জানতো। তার বাড়ির হাঁড়িতে ভাত জুটতো না, না খেয়ে অফিসে আসতো। বউটা চলে গেছে বাপের বাড়ি। লোকটি হুঁ হুঁ করে কাঁদতো। এমন কষ্টের দিনে আব্দুল চাচাই লোকটির বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল, সহানুভূতি দেখাত। প্রয়োজনে অভাবের সংসার থেকেও দু'কেজি চাল কিনে দিত। এটায় দোষ ছিল।

একদিন আব্দুল চাচাসহ ওই অফিস সহকারীর নামে থানায় মামলা দেয় এবং তাদের পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

এদিকে আমাদের ফুলফুটা পথে কাঁটা বিছানো হয়ে যায়। অন্ধকার নেমে আসে, স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

নূপুরের বাবার এই দুর্দিনে সে আমার সঙ্গে রাতের আঁধারে যেতে রাজি নয়। আমি হতাশ হয়ে কিশোর মনে, ব্যর্থ প্রেমে হাবু-ডুবু খেতে থাকি।

কয়েক মাস জেলহাজতে থাকার কারণে আব্দুল চাচার যৎসামান্য বেতনও বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের এই দুর্দিনে নূপুরের মা নূপুরকে নিয়ে নানিবাড়ি গোপালগঞ্জ চলে যায়।

আর আমরা বসবাস করতে থাকি কুষ্টিয়ার ধলা গ্রামে। সিনেমার বিরহগান অথবা হারানো দিনের গানই হয় আমার বেঁচে থাকার পাথেয়। গান শুনি, একটু-আধটু পড়াশুনাও করতে থাকি। এভাবেই জীবনের বিশটা বছর পার করে ফেলি। আমার সৌভাগ্য হয় না গোপালগঞ্জে যাওয়ার।

রাতের আঁধারে বৃষ্টি হলে বৃষ্টির শব্দে নূপুরের পায়ের শব্দ শুনি। পানির ঢেউ দেখলে হারিয়ে যেতে থাকি নূপুরের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। সবুজ ছায়ায়, গাছের ডালে ডালে অথবা ফসল ভরা মাঠে মাঠে নূপুরের সঙ্গে দৌড়াই, জড়াজড়ি করি মটর শুঁটির লতার মধ্যে। খুঁজে পাই সুখের ঠিকানা। জোরে জোরে গলা ছেড়ে গান করি 'তুমি আজ কতদূরে...।'

\হজ্যোৎস্নার আলোছায়ায় আমার জানালার পাশে প্রতিবেশী নঈম আর নাইমা জড়াজড়ি করে চুমু খায়। আর আমার কণ্ঠনালির ভেতর নূপুরের জিহ্বার সাধ জেগে উঠে, জেগে উঠে বয়ঃসন্ধিকালের জ্বলন্ত বুকের ওম ওম অনুভূতি। ঠিক তখনই দূরে আমার কিশোর বেলার স্কুলে বিজয় দিবসের গান বেজে উঠে মনের মনিকোঠায় 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা'। মনে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বদর স্যারের কথাগুলো...।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে