রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস

পুঁজিবাদী-শ্রমশোষণ বিরোধী বাস্তব আলেখ্য

ড. মুসাফির নজরুল
  ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে আত্মপ্রত্যয়ী একদল তরুণ লেখক রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে অস্বীকার করে, 'রবীন্দ্র বলয়' থেকে বেরিয়ে এসে এক স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি করেন। আর সে কাজটি একটি স্থির আত্মপ্রত্যয়ের বিপরীত চেতনা নিয়ে 'কলেস্নাল' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। এ তরুণ লেখকদের আবির্ভাব হয় বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। গতানুগতিক সাহিত্যধারা থেকে সরে এসে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রত্যয়ে তাঁরা 'কলেস্নাল' পত্রিকাসহ আরও কয়েকটি উলেস্নখযোগ্য পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নবতর সাহিত্য সৃষ্টিতে প্রয়াসী হন এবং যথারীতি তাঁরা সার্থক হন। বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) 'কলেস্নাল গোষ্ঠী'র অন্যতম প্রধান লেখক। তিনি ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আর এই যুগের বৈশিষ্ট্যকে তাঁর মানসে লালন করেই তিনি সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তাঁর সাহিত্যে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় এ কথা আরও স্পষ্ট করেছেন এভাবে : 'অনুকূল ছিলো না সময়টা- কারও পক্ষেই নয়, সদ্য যারা উপার্জনে সচেষ্ট তাদের পক্ষে রীতিমত বৈরী। জগৎ জুড়ে ব্যবসা-মন্দা চলছে, ভারতবর্ষে গান্ধীজীর উপবাস, ঢাকা চাটগাঁর সন্ত্রাসবাদ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লো। আর অবশ্য বিবর্ণমান বেকারবাহিনী, বেসরকারি আপিসগুলোতে ছাঁটাই- বাঙালির বিপুল বাঞ্ছিত সরকারি কর্মেও কুঞ্চিত হলো মাসান্তিক বেতন, যেন ব্রিটিশ দম্ভের শৈথিল্য প্রাপ্তির ইঙ্গিত জানিয়ে।' (বুদ্ধদেব বসু, আমার যৌবন, পৃষ্ঠা-৮২)। এই প্রতিকূল অবস্থায় ব্যক্তি মানুষও ক্রমান্বয়ে তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে পরিবর্তিত পরিচয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। ফলে, মানুষের ক্রমাবলুপ্তিও লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। এ সময়ের মুখোমুখি হয়েই মানুষ বাঁচার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে।

বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে আমিত্ব, আত্মতা এবং নিঃসঙ্গতা। পরিবার-সমাজ ও স্বজনের সঙ্গে বিশেষ যোগসূত্র না থাকায় প্রতিকূল পরিবেশ এবং বিরূপ ঘটনাধারা তাকে ক্রমশ আত্মসমাহিত, নিভৃতচারী, অন্তর্মুখী, সীমাহীন একাকিত্ববোধ ও নিঃসঙ্গচেতনায় আবিষ্ট করে তুলেছিল। তাই তার সাহিত্যে ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাবধারার প্রভাব লক্ষণীয়। তার রচনায় তিনি মধ্যবিত্তশ্রেণির চিত্তসংকট উপস্থাপনের অন্তরালে আত্ম-অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ কারণে অনেকে মনে করেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাসে সমষ্টিচেতনা তথা বৃহত্তর সমাজচেতনা উপেক্ষিত হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, প্রতিকূল সমাজ প্রতিবেশ ও বিনাশী যুগচৈতন্য তাকে বিচলিত করে তুলেছিল।

ত্রিশের যুগের কালপ্রবাহে বুদ্ধদেবের পরিচয় কলেস্নালপন্থী হিসেবেই স্মরণীয়। তবে 'কলেস্নালের কথাকোবিদ' অভিধার অধিকারী হলেও তাঁর লেখায় স্বাতন্ত্র্যের ছাপ সুস্পষ্ট। বস্তুত, সাহিত্যের সব শাখায় বুদ্ধদেবের অসাধারণ দখলদারিত্ব থাকলেও ত্রিশের পূর্বেই তিনি ঔপন্যাসিক পরিচয়ে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কলেস্নালীয় বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটলেও বুদ্ধদেবের স্বকীয়তা তাকে স্বতন্ত্র রূপেও পরিচিত করে তুলেছিল। এই পরিচয়ের গৌরব বহন করেই উপন্যাসের জগতে তার আবির্ভাব, বিস্তৃতি ও প্রতিষ্ঠা।

দাম্পত্য সংকট ও বিবাহোত্তর প্রেম বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়। প্রেমের সঙ্গে জীবনকে তিনি অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে সংযুক্ত করেছেন। জীবনকে প্রেমের আঁধারে সন্ধান করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তিনি তার উপন্যাসে বৈনাশিক যুগসংকটের প্রভাবে দাম্পত্য-বিচ্ছিন্নতাজাত এক নিঃসঙ্গতার শিল্পরূপ নির্মাণ করে বাংলা উপন্যাসে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। তাঁর প্রথম পর্বের উপন্যাসে প্রেমই মৌল চেতনার পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল। সাড়া (১৯৩০), ধূসর গোধূলি (১৯৩৩), বাসর ঘর (১৯৩৫) প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেবের কবিত্ব শক্তির পরিচয় যেমন অস্পষ্ট থাকেনি, তেমনি প্রেম চেতনাও হয়ে উঠেছে স্পষ্টতর। প্রেমের এই জাগতিক রূপ প্রকাশে তিনি শরীর ধর্র্মকেও অস্বীকার করেননি। তাঁর কবিসত্তারই ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছে তাঁর উপন্যাসে। উপন্যাসের প্রধান বা কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র অথবা নায়ক চরিত্রটি তারই প্রতিভূ পরিচয়ে সমৃদ্ধ এক সৃষ্টি। লেখক নিজস্ব চরিত্র বৈশিষ্ট্যের আভাসই সূচিত করেছেন এই সব চরিত্রে- প্রায়শই তারা কবি-শিল্পী অথবা অধ্যাপক।

আধুনিক নগরজীবনের বহুমাত্রিক বিকৃতি ও বিচু্যতি এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার শ্রমশোষণ পদ্ধতি বুদ্ধদেব বসুর 'যবনিকা পতন' (১৯৩১) উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। এ উপন্যাসের অনেক দৃশ্যই কুৎসিত কিংবা জুগুপ্সাপূর্ণ। বাস্তবতার জোয়ারে প্রকৃত তথ্য বর্ণনা করতে গিয়ে অমিয়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবন ও ব্যাভিচারপূর্ণ আচরণের বর্ণনা নিতান্ত অপরিচ্ছন্ন। অঞ্জলি বসুর সঙ্গে তার যৌন মিলনের দৃশ্যাবলি চুম্বন ও আলিঙ্গনপূর্ণ দৃশ্যে সে কথা মনে করিয়ে দেয়। অঞ্জলি প্রচলিত নীতিবোধকে কখনো গ্রহণ করে না। যৌবনের ধর্ম পালন করতে দেহকে নির্বিচার রাখতে অমিয় রাজি নয়। তার চিন্তা-চেতনায় ঘুরেফিরে একটা জিনিসই কাজ করছে।

এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের সুখবাদী নীতির পরিণাম হিসাবে সমাজের অপরাধের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে গিয়ে আমাদের বলতে হবে এই অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতাকে আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না। যখন যা ভালো লাগে তাই করো- এই নৈরাজ্যের সুখ সমাজ জীবনের কখনো কল্যাণ সূচিত করতে পারে না। তাই একে আমরা কঠোর অন্যায় আর অপরাধ বলে গ্রহণ করব, যদিও নায়ক-নায়িকারা কখনো এই অপরাধের দায়িত্ব স্বীকার করে না বা তাদের পাপবোধ তাদের অন্তরে ক্ষণকালের জন্যে অনুশোচনাকে পীড়িত করে না।

এ উপন্যাসের মৃগাঙ্কশেখর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অভ্যন্তর নিয়মে মানুষ কীভাবে অপর মানুষ থেকে, পরিবার থেকে, নিজের শ্রম থেকে এবং আপন সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মৃগাঙ্কশেখর সাহিত্যিক, সাহিত্যপণ্য সৃষ্টি করাই তার পেশা। সংসারে সে একা, আছে শুধু এক মা। সাহিত্যের প্রতি তার ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ ও অন্তরঙ্গ অনুরাগ। ফলে সুখবাদের মোহ রসে তাকে বেশি দিন থাকতে হয়নি। প্রথম জীবনে সাহিত্য তার জীবনে দেখা দিয়েছিল ত্রাণকর্তার ভূমিকায়; সাথে ছিল বন্ধু অমিয়ভূষণের অনুপ্রেরণা। অমিয়ও এক সময় লিখত বলে মৃগাঙ্কের বন্ধু ছিল সে। অমিয়ের সাহিত্য জীবন ঘুচে গেছে এখন। এখন সে অনাচারী, মদ্যপ, উচ্ছৃঙ্খল; করতে পারে না এমন তার সামনে কিছু নেই।

বুদ্ধদেব বসুর 'অসূর্যস্পশ্যা' উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অনিবার্য চাপে নিষ্পেষিত ব্যক্তি হৃদয়ের নৈঃসঙ্গ্য ও সত্তাশূন্যতার অন্তহীন যন্ত্রণার ছবি চিত্রিত হয়েছে। এই সমাজের নারীর সীমাহীন অসহায়াত্ব ও শূন্যতা এ উপন্যাসের সরমা চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরুষশাসিত সমাজের বিধিবিধান আধুনিক নারীকে চারদিক থেকে যখন দলিত-মথিত করেছে তখন তার অন্তঃসারশূন্যতার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে। 'অসূর্যম্পশ্যা' সরমা পারিবারিক ও সামাজিক ব্যভিচার-অবিচারের নির্মম শিকার। দরিদ্রতা তার মা ভানুমতী সেন তথা তার পরিবারকে রুচিহীনতা ও অনৈতিকতার অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। স্বামী ব্যারিস্টার অক্ষয় সেনের মৃতু্যর পর ভানুমতী জীবনধারণ আর মিথ্যা আভিজাত্য প্রদর্শনের আর্থ-উৎস হিসেবে তার নিজকন্যা সরমার উদ্ভিন্ন যৌবনকে বেছে নেয়।

'তিথিডোর' (১৯৪৯) উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে বুদ্ধদেব বসু বাংলা উপন্যাসের ধারায় পরিবর্তনের প্রয়াসী হন। মননকে প্রাধান্য দিয়ে সহজ-সরল কাহিনী অবলম্বনে তিনি বাংলা উপন্যাসকে গ্রাম প্রধান করতে সক্ষম হন। শহুরে জীবনের সচেতনতা না থাকায় একঘেয়েমি শিল্পবোধের নতুন উদ্ভাস কমে আসে। এ উপন্যাসে কবি বুদ্ধদেব বসু ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে চলেছেন। এ কারণে 'তিথিডোর' একটি নিখুঁত আধুনিক প্রেমের কাহিনী হয়ে উঠেছে। আঙ্গিকের পরাকাষ্ঠায় অবিস্মরণীয় এ উপন্যাস। টুকরো টুকরো ছবি- অনেকগুলো মানুষের, অনেকগুলো মনের, অনেক কথার, অনেক দৃশ্যের টুকরো জুড়ে কয়েকটা মুহূর্ত একটি ক্ষণ তৈরি হয়েছে। বস্তুত, এ উপন্যাসে স্বাতীর প্রেম আখ্যানের অন্তরালে চলিস্নশের দশকের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ জীবনের নানামাত্রিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষের অন্তঃবাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বহিরঙ্গ রূপ অঙ্কনের মাধ্যমে তিনি এ উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বিশেষ কালের শিল্পীত স্বরূপ চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

'তিথিডোর' উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু মগ্নচৈতন্যের অন্তরালে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার গরল, বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজজীবনে শূন্যতা- একাকিত্বের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেছেন। এ উপন্যাসের চরিত্রসমূহ কেবল রোমান্টিক নৈঃসঙ্গ্যানুভূতি দ্বারাই প্রভাবিত হয়নি একই সঙ্গে যুদ্ধকালীন সমাজবাস্তবতার টানাপোড়েনে সংক্ষুব্ধ পীড়িত ও পর্যুদস্ত হয়েছে। ফলে, উপন্যাসের মৌল জীবনার্থে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে একদিকে মধ্যবিত্ত সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে চোরা কারবারি কালোবাজারির সাহায্যে নব্য ধনিক শ্রেণির উত্থানের ফলে মানুষের সব প্রত্যয় যুগস্রোতে ভেসে গিয়েছিল। এই নষ্ট সময়ের ছোঁয়া তার উপন্যাসের মানুষদের গায়েও লেগেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে