শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হারাম শরিফের পথে

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
  ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

মুছা মিয়া এক মনে পাট ক্ষেতের আগাছা সাফ করছেন। মাথার ওপর সূর্য। কাঠফাটা রোদ। বাতাসে জলীয় বাষ্প নেই বললেই চলে। তবু তার ক্লান্তি নেই। আসলে ক্লান্তি শব্দটাই তার অভিধানে নেই। ছোট ছোট পাটের চারাগুলো যেন হাসছে। মৃদু দখিনা বাতাসে ক্ষেতের ওপর যেন সাগরের ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ের আঁচড় আঁছড়ে পড়ছে মুসা মিয়ার বুকের ভেতর। মুছা মিয়া জানে, পাট আর সোনালি আঁশ নেই। তবু পাটের চাষ ছাড়তে পারেন না। অন্তত সারা বছরের লাকড়ির চাহিদার কথা ভেবে। একসময় হাওরে প্রচুর বড় বড় ঘাস হতো। শুষ্ক মৌসুমে সেগুলো কেটে এনে লাকড়ি বানানো যেত। তাছাড়া গোয়াল ভরা গরু ছিল। গোবর শুকিয়েও রান্না করা যেত। গাছের শুকনো পাতাও ভালোই সাপোর্ট দিত। আজ আর সেদিন নেই। মুছা মিয়ার বুক ছিঁড়ে নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস দ্রম্নত বেরিয়ে যায়।

মুছা মিয়া সজ্জন মানুষ। সহজ-সরল। ধর্মপরায়ণ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়েন। লেখাপড়া জানেন না। ছোটবেলায় স্কুলে গিয়েছিলেন কিনা মনে নেই। অবশ্য পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের আগ্রহে কয়েকদিন নৈশ বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সে সুবাদে নাম দস্তখত করতে পারেন। বয়স কত সঠিক জানেন না। শুধু মনে আছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা। তখন তিনি তাগড়া জোয়ান। গায়ে অসুরের মতো শক্তি। একবার এক পাকিস্তানি সেনাকে খালি হাতেই নাকাল করেছিলেন। কমান্ডার এ আর সাইদ তার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, শাবাশ.. বাপের বেটা, শাবাশ।

আজ দেশ স্বাধীন। বিজয়ের আনন্দ এখনো মুছা মিয়ার শরীরে শিহরণ জাগায়। সেদিনের কথা মনে হলেই মুছা মিয়া যেন বদলে যান। গায়ে অন্যরকম শক্তি অনুভব করেন। সে শক্তির তুলনা বুঝি ত্রিভুবনে নেই। আমেরিকা মুছা মিয়ার সংসার যেমন ছোট নয়; আবার খুব বড়ও নয়। মজার ব্যাপার হলো, প্রথম স্ত্রী আদুরীর সন্তান না হওয়ায় ; আদুরী নিজেই তার চাচাত বোন কমলার সঙ্গে মুছা মিয়ার বিয়ে দেন। তারপর কমলার যেদিন মেয়ে হলো; সেদিনই আদুরীরও ছেলে হলো। একদিনে দুই সন্তানের পিতা! গাঁয়ে এ নিয়ে হাসাহাসির অন্ত ছিল না। অবশ্য মুছা মিয়ার মনে সেদিন আনন্দের সীমা ছিল না। আদুরী এবং কমলার মাঝে খুবই সদ্ভাব। সাধারণত দুই সতীনের ঘরে যতটা অশান্তি হওয়ার কথা; তার ছিটে ফোঁটাও মুছা মিয়ার সংসারে ছিল না। এখনো নেই। প্রথম তরফের তিন ছেলে। আর দ্বিতীয় তরফের তিন মেয়ে। ছেলেরা সবাই লেখাপড়া জানে। তবে লোকে বলে, সবার ছোট ছেলেটা নাকি অসাধারণ মেধাবী। আর মেয়েগুলো পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেনি। তবে মুছা মিয়ার চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না।

দূরের মসজিদে মুছাজ্জিনের সুললিত কণ্ঠ ভেসে আসে। মুছা মিয়ার মন নামাজের জন্য আকুল হয়ে উঠে। এখনো কাজের অনেক বাকি। সংসারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে কামলা নেননি। উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। পোষায় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেই কোনো রকমে চালিয়ে নেন। ছেলেরা মাঝে মাঝে সাহায্য করে। দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়েই আসেন। মনে মনে ঠিক করেন, নামাজ শেষে ক্ষেতের উত্তর দিকেই বরই গাছের নিচে বসে ভাত খাবেন। তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবেন। মুছা মিয়া খাবারের পুটলি আর নিড়ানিটা হাতে নিয়ে উঠে পড়েন। ওজু করার জন্য আবার একটু দূরে যেতে হবে।

নামাজ এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্লান্ত অবসন্ন মুছা মিয়া বরই গাছের শীতল ছায়ায় একটু গা এলিয়ে দেন। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। কয়েকটি পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে। কিছু দূরে হাওড়ের চারণ ভূমিতে কয়েকটি রাখাল ছেলে ডাংগুলি খেলছে। মুছা মিয়ার দুই চোখে হঠাৎ রাজ্যের ঘুম নেমে আসে।

কথায় আছে, ঘুম আসলেই স্বপ্ন আসে। স্বপ্ন আসলেই তুমি আস। ঘুম নেই, স্বপ্নও নেই ; তুমিও নেই। মুছা মিয়া ঘুমের মধ্যে একটি স্বপ্ন দেখলেন। পবিত্র কাবা শরিফের চারপাশে তাওয়াফ করছেন। সাফা ও মারওয়া সায়ি করছেন। অঞ্জলি ভরে জমজমের পানি পান করছেন। তার চোখেমুখে স্বর্গীয় জ্যোতি। মুছা মিয়ার মন চলে যায় সোনার মক্কা-মদিনায়। তার আর কিছুই ভালো লাগছে না। কাজ-কর্ম, সংসার, টাকা-পয়সা, স্ত্রী-সন্তান সবকিছুকে অর্থহীন মনে হয়। আজ আর কাজ করার মতো মানসিকতা নেই। মুছা মিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়ান। আর একটু পরে পরে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকান।

মুছা মিয়ার বড় ছেলে আবুল মিয়া। শিক্ষিত। শান্ত ও ভদ্র। তার মনে কষ্টের অন্ত নেই। আজ যদি তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট থাকত! একটি চাকরির জন্য তার এত পথ মাড়াতে হতো না। একদিন আবুল মিয়া বাবাকে বলল, বাবা, সার্টিফিকেট নিলেন না কেন?

মুছা মিয়া ভাব লেশহীন। কোনো জবাব দেন না।

আবুল মিয়া আবার জিজ্ঞেস করে, বাবা, সার্টিফিকেট নিলেন না কেন?

উত্তরে মুছা মিয়া বলল, সেইটা আরার কি জিনিস? সেইটা দিয়া কি অইব?

কেন, সরকার আপনেরে ভাতা দেব।

ভাতা নেওয়ার জন্য তো দেশ স্বাধীন করিনি। মুছা মিয়ার স্পষ্ট উত্তর।

আবুল মিয়া আমতা আমতা করে আবার বলল, আমার চাকরি পাইতে সহজ হইত। মুক্তিযোদ্ধার কোটা পাইতাম।

মুছা মিয়া বলে, কি পড়াশোনা করলা মিয়া! চাকরির জন্য কোটা ধরবার চাও।

এই উত্তর আবুল মিয়া বুঝে। আর কথা বাড়ায় না। চলে যেতে চায়।

মুছা মিয়া বলে, শোন মিয়া! তোমার লগে আমার একটা কথা কইবার আছে।

কী কথা?

আমি এইবার হজে যাবার চাই। তোমার কী মতামত?

আবুল মিয়া একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কষ্টের সংসার। হজে যাওয়ার মতো টাকা কি তাদের আছে? কিন্তু বাবাকে কোনো মতেই না বলা যাবে না। বাবা বড় আঘাত পাবেন। আর সে আঘাত লাগবে কাবার ঘরে। এই মানুষটি ফেরেশতার মতন। সারা জীবন শুধু কষ্ট করেছেন। পরিবারের কারও গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগতে দেননি। আবুল মিয়া আর ভাবতে পারে না। দুই চোখ জলে ভিজে উঠে। বলে, বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এত টাকার জোগাড় কীভাবে হবে!

ছেলের মনের অবস্থা মুছা মিয়া বুঝতে পারে। বলেন, টাকা নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করবা না বাপ। আলস্নাহর কাছে যাওনের নিয়ত করছি। টাকার ব্যবস্থা আলস্নাহই করব।

এ সময় ঘরের এক কোনে একটা টিকটিকি শব্দ করে উঠে। মুছা মিয়ার মনে হয়, সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। এ সময় রান্নাঘর থেকে বড় বউ আদুরীর গলা শোনা যায়।

বাপ বেটা মিইল্যা কি কথা অইতাছে শুনি? বলি, শুক্রবারের কথা কি আপনেরা ভুইল্যা গেছেন? নামাজে যাওন লাগব না?

বড় বউয়ের কথায় মুছা মিয়ার মন খুশিতে ভরে উঠে। বলেন, ভুলি নাই গো বড় বউ, ভুলি নাই।

আর আবুলের দিকে তাকিয়ে বলে চল বাপ, গতর ধুইবার যাই।

আবুল প্রিয় মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বাবাকে অনুসরণ করে। এদিকে আজ পাড়ার মাঠে একটি ফুটবল খেলা। এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব খেলা দেখতে আসবেন।

আবুলের মুখ কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট। সে এই সংসারের বড় ছেলে। তারও তো কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ আছে। আজ যদি সে চাকরি করত! বাবার হাতে তুলে দিতে পারত কিছু টাকা। বাবা খুশি হতেন; সেই সঙ্গে খুশি হতেন আলস্নাহ। কিন্তু আজ তার কিছুই করার নেই। আবুলের নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।

সারা গ্রামে সাড়া পড়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা মুছা মিয়া এবার হজে যাচ্ছেন। গ্রামবাসী বেজায় খুশি। তার মতো সাদা মনের মানুষ হজে যাবেন না তো কে যাবেন! তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। সংসারের জন্য নিজের সুখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়েছেন। মানুষের উপকার করেন। জীবনে কাউকে কখনো কালা মুখ করেননি। বিপদে আপদে তিনি সবার পাশে থেকেছেন। ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। এই বলে সারা গাঁয়ের মানুষ ধন্য ধন্য করতে লাগল। এদিকে মুছা মিয়ার ঘুম নেই। হজে যাব বললেই তো আর হজে যাওয়া যায় না। কত টাকা পয়সা লাগব! জমি জিরাত কিছু বিক্রি করতে অইব। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে অইব। সবার কাছে মাফ চাইতে অইব। এত দূরের পথ। জীবন মরণের কথা কওন যায় না।

কার সঙ্গে যাবে, কীভাবে যাবে, কীভাবে আসবে... ইত্যাদি নানা রকম চিন্তা মুছা মিয়াকে সারাক্ষণ ব্যাকুল করে তুলছে। তাছাড়া মরিয়ম বিবির এখনো বিয়ে বাকি।

মরিয়ম মুছা মিয়ার ছোট মেয়ে। সর্বকনিষ্ঠ। অত্যন্ত দস্যি প্রকৃতির। ছোটবেলায় একবার রাগ করে গাছে উঠেছিল। আর নামে না। সারারাত গাছেই ছিল। কেউ গাছে উঠতে চাইলেই বলত, এই আমি লাফ দিলাম! পাড়া প্রতিবেশী সকলে মিলে মাছ ধরার জাল পেতে সারারাত দাঁড়িয়ে ছিল!

ছোট বউ কমলা হজে যাওয়ার কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই মেয়েটার মন খুব নরম। একদম কাদা মাটির মতন। বাসর ঘরে মুছা মিয়া কৃত্রিম একটু রাগ করতেই সে কী কান্ড! বলে কিনা আমার লগে রাগ করলে অহনই আমি বাপের বাড়ি চইল্যা যামু... এই বলে মুছা মিয়ার পায়ে পড়ে সে কি কান্না। সেদিন থেকে কমলার ওপর মুছা মিয়ার খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল। আসলে মুছা মিয়ার বউ ভাগ্যের কোনো তুলনা নেই। আদুরী-কমলা মিলেমিশে মুছা মিয়ার সংসারটিকে যেন একখন্ড স্বর্গে রূপান্তরিত করেছেন। আর সে স্বর্গের অধীশ্বর মুছা মিয়া।

হজে যাওনের সব আয়োজন শেষ। মোটামুটি ভালো দামেই জমি বিক্রি করা হয়েছে। পাড়ার টুনু মিয়ার চাকরিজীবী ছেলে রফিক মিয়ার সঙ্গে মরিয়মের বিয়েটাও ভালোই ভালোই হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একজন ভালো মোতাওয়ালিস্ন পাওয়া গেছে। নাম মাওলানা আবু সাঈদ। কী সুন্দর চেহারা! মনে হয় যেন নূরের ঝলক! ইয়া লম্বা দাঁড়ি। উঁচু বাঁশির মতো নাক। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয়। প্রতি বছরই অনেক মানুষকে হজ করিয়ে আনেন। তিনি বলেছেন, অন্যদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিই। আপনি মুক্তিযোদ্ধা, ভালো মানুষ। আপনার কাছ থেকে তিন লাখ নেব না। আপনি দুই লাখ দিলেই চলবে। আপনার পাসপোর্ট, ভিসা, কোরবানি, বিমান ভাড়া ও খাওয়া-দাওয়া সব আমার। আমি নিজে এসে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব। আপনার কোনো চিন্তা নেই।

মুছা মিয়া মাওলানা সাহেবের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। এত ভালো মানুষ! মনে মনে মহান আলস্নার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। কপাল ভালো না হলে এমন মানুষ পাওয়া যায় না!

সারা গ্রামে উৎসবের আমেজ। হবেই বা না কেন? মুছা মিয়াই এই অচিন্ত্যপুর গ্রামের প্রথম হজযাত্রী। এর আগে এই গ্রাম থেকে কেউ কখনো হজে যাননি। আজ মুছা মিয়া মহান আলস্নাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। আকাশ খুব পরিষ্কার। সকাল থেকেই বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগে আছে। সবাই মুছা মিয়ার সঙ্গে মুসাফা করছেন, দোয়া চাইছেন। মুছা মিয়া বিনয়ের সহিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

মুছা মিয়া পদব্রজে রওনা হলেন। সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ। নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখর। গন্তব্য গচিহাটা রেলস্টেশন। সেখান থেকে আন্তঃনগর এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসে ঢাকা বিমানবন্দর। তারপর হাজি ক্যাম্প। সেখান থেকে পরদিন সোনার মদিনার উদ্দেশ্যে বিমানে চড়বেন। সব টাকা মাওলানা আবু সাঈদ সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

দুপর ১২ টায় ট্রেন গচিহাটা স্টেশন ছাড়ল। মুছা মিয়া জীবনে কখনো ট্রেনে উঠেননি। ট্রেন ছুটে চলছে।

মুছা মিয়ার মনে হলো, ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সাদা মেঘগুলো যেন পালস্না দিয়ে চলছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তার দুই পাশের গাছের সারি যেন দুরন্ত বালকের মতো দৌড়াচ্ছে। মুছা মিয়ার প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগলেও এখন আর ভয় করছে না। মাওলানা সাহেব দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। ভয়ের সময় ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়তে হয়।

মুছা মিয়া একমনে দোয়া পড়ছেন।

আবুল মিয়া বাবার সঙ্গে এসেছে। বড় ছেলে বলে কথা! তার ওপর অনেক দায়িত্ব। বাবার অবর্তমানে সে-ই সংসারের কর্তা। তাছাড়া বাবাকে সে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসে। মুছা মিয়াও তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। যাওনের আগে মুছা মিয়া তার প্রাণাধিক সন্তান আবুল মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল,

বাপ, তোমার জন্য হজ থেকে কী আনব?

আবুল মিয়া কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেছিল, কিছু আনতে হবে না বাবা। শুধু আপনি ভালোভাবে ফিরে আসলেই আমার হবে। আমি এর বেশি আর কিছুই চাই না। সে কথা শুনে মুছা মিয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন।

বিকেল ৫টা। ট্রেন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে এসে থেমেছে। যাত্রীরা যে যার মতো করে নামছেন। মাওলানা সাহেব মুছা মিয়া ও আবুল মিয়াকে নিয়ে নেমে পড়লেন। আবুল মিয়া বাবাকে বিমানবন্দর চিনিয়ে দিলেন। ঢাকা শহরের অপরূপ রূপ দেখে মুছা মিয়া অবাক হয়ে গেলেন। এত গাড়ি একসঙ্গে তিনি জীবনে কখনো দেখেননি। বিমানবন্দর রোডের গাছগুলোকে দেখে মুছা মিয়ার সৌদি আরবের খেজুর গাছের কথা মনে পড়তে লাগল।

অবশেষে তারা হাজি ক্যাম্পে এসে পৌঁছলেন। হাজারে হাজারে হজযাত্রীর সমাগমে এক উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। স্বর্গীয় আবহ বিরাজ করছে। মুছা মিয়ার মনের সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। তিনি এক মনে আলস্নাহকে ডাকতে লাগলেন। লাব্বাইক আলস্নাহুমা লাব্বাইক, লা শারিকা লাব্বাইক...।

মাওলানা সাহেব মুছা মিয়া ও তার ছেলে আবুল মিয়াকে বললেন, আপনারা এইখানে চেয়ারে বসুন। আমি ভিসা, পাসপোর্ট ইত্যাদি কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে আসি। যাব আর আসব।

বেশি দেরি হবে না। এই বলে মাওলানা সাহেব চলে গেলেন। মুছা মিয়া ও আবুল মিয়া তার গমন পথের দিকে থাকিয়ে রইলেন।

রাত ১২টা বাজে। মাওলানা সাহেব সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। বাপ বেটা দু'জনেই অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন। এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করছেন। না, মাওলানা সাহেবের কোনো পাত্তাই নেই। একদম লা- পাত্তা। ক্ষুধায় একেক জনের পেট জ্বলছে। সঙ্গে সামান্য ক'টা টাকা।

আবুল শিক্ষিত ছেলে। তার কেমন জানি সন্দেহ হতে লাগল। সে বিষয়টি একজনের সঙ্গে আলাপ করল। তিনি তাকে অনুসন্ধান কক্ষে খোঁজ নিতে বললেন। আবুল মিয়া অনুসন্ধান কক্ষে গিয়ে যা জানতে পারল... তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তার বাবার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কিন্তু এই লোকটি প্রতারণা করতে পারে- এ কথা আবুল মিয়ার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। পূর্ব আকাশে ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে কোনো সময় আকাশের চোখে জল নামবে। কিন্তু সেই জল কি পারবে আবুল মিয়ার মনের আগুন নেভাতে?

আবুল মিয়া যতটা ভেবেছিল তার বাবা মুছা মিয়া ততটা আপসেট হননি। অসম্ভব শক্ত নার্ভ লোকটার। তিনি মুখে কিছুই বললেন না। শুধু কিছুক্ষণ পরে পরে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেন।

আবুল মিয়া রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় মাওলানারে বাপ তুলে গালি দিল। মুছা মিয়া অত্যন্ত শান্ত ও কোমল স্বরে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, বাপরে... মাওলানারে গালি দিলে কি অইব! আলস্নায় আমার কপালে হজ লেখেন নাই, সেইটাই আসল কথা। চল... বাপ, আমারে বাড়ি নিয়া চল।

আবুল মিয়া কিছুই বলল না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে

প্রতারিত বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে