সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিজিয়া রহমানের উপন্যাস দেশ কাল ও শিল্পরূপ

আহমদ মতিউর রহমান
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

রিজিয়া রহমান বাংলাদেশের একজন সেরা কথাসাহিত্যিক। তিনি ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা লিখে সাহিত্য জগতে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। শিশুসাহিত্যেও ছিল তার বিচরণ। সাতচলিস্নশের আগে পূর্ব বাংলায় বাঙালি মুসলমান লেখকরা উপন্যাস রচনা করে আমাদের কথাসাহিত্যের ধারাটির বুনিয়াদ গড়ে তোলেন। মুসলমান বলতে হচ্ছে এ কারণে যে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের যে ধারাটি ছিল তা চিল প্রধানত হিন্দু লেখকনির্ভর। পূর্ব বঙ্গে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন মুসলমান তাই তাদের ভেতর থেকে উঠে এসছেন কিছু লেখক। তারা মুসলমান হবেন এটাই স্বাভাবিক। বলা হতে পারে লেখকের আবার হিন্দু মুসলমান ভাগ করা কেন? এর কিছুটা কারণ তো অবশ্যই আছে। আমাদের আরাধ্য বিষয় তা নয় বিধায় সেদিকে যাব না। আমরা বিষয়ের ওপর নিবিষ্ট থাকব। তো সাতচলিস্নশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকে পূর্ব বাংলার লেখকদের উপন্যাস লেখা শুরু হয়; এটা হয় প্রায় চলিস্নশ থেকেই। রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০১৯) তার একটু পরে বলা যেতে পারে কলম ধরেন। মূলত সেই উপন্যাসের যে-বুনিয়াদ গড়ে তোলেন সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্‌, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শাহাদাত হোসেন, শওকত ওসমান, আবু রুশ্‌দ প্রমুখ সে-ধারাতেই অনেকে অগ্রসর হন। রিজিয়া তাদের একজন। শক্তিময়ী কথাসাহিত্যিক দিলারা হাশেমও একজন। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস 'ঘর ভাঙা ঘর' লেখা শুরু হয় ১৯৬৭-৬৮-র দিকে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৪-এ। তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ 'অগ্নি স্বাক্ষরা' (১৯৬৭)। তার উলেস্নখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো : ঘর ভাঙা ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা। লিখেছেন অভিবাসী আমি ও নদী নিরবধি নামে দুটি আত্মজীবনী। উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। কিন্তু তাকে নিয়ে তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে খুব বেশি আলোচনা বা মূল্যায়নধর্মী কাজ হয়নি। তার রচনায় এসেছে বাংলা ও বাঙালির সমাজ বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম সমাজ। কাহিনী সৃজনে ও চরিত্র সৃজনে তিনি একজন নিপুণা শিল্পী ছিলেন বলা যায়।

২.

রিজিয়া রহমান ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর কোলকাতার ভবানীপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল কোলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার পারিবারিক নাম ছিল জোনাকি। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক ও মা মরিয়ম বেগম একজন গৃহিণী। তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার দাদা মুন্সী আব্দুল খালেকের পড়ালেখার অভ্যাস ছিল। তার ঘরে সেলফ ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। তিনি এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তার বাবার চাকরির কারণে তাদের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান অর্জনের পর তারা তৎকালীন পূর্ব বাংলা প্রদেশে চলে আসেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের পূর্ব অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান হয় (যা আজকের বাংলাদেশ)। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। ১৯৫০ সালে তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন তখন তার লেখা গল্প টারজান সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়েছিল। ১৯৫২ সালে তার বাবার মৃতু্যর পর তারা ঢাকার দোহারে শাইনপুকুরে নানাবাড়িতে চলে আসেন। সেই সময় তার এক মামা চাঁদপুরে চাকরি করতেন। তিনি সেখানে চলে যান এবং একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তবে বিভিন্ন কারণে স্কুলে পড়া আর হয়নি, প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা গল্প এবং দৈনিক সংবাদে তার লেখা কবিতা ছাপা হয়। তিনি অধুনালুপ্ত ললনা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। বিয়ের পর স্বামীর সাথে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে চলে যান রিজিয়া এবং সেখানে কোয়েটা গভর্মেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছর লেখাপড়া করেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট সম্পর্কিত জটিলতার কারণে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি না দিলে দেশে এসে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে তিনি সাফল্য পান। রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা 'ত্রিভুজ'-এর সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি কয়েক বছর অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন, একটি প্রতিষ্ঠানে রিসার্চ অফিসার হিসেবেও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। পরে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে। তিন বছর বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন : 'আমার শৈশবের স্মৃতিতে সশব্দে বিরাজ করছে যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ। সেখানে কান পাতলে এখনো শুনতে পাই সাইরেনের বিকট চিৎকার, বোমার গগনবিদারী আওয়াজ, জাপানি বোমারু বিমানের শব্দ আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের ঘন ঘন কড়া ধমক। এখনো মনের অবচেতনে কুন্ডলী পাকায় শিশুকালের রাতগুলোর বস্ন্যাকআউটের ঘুটঘুটে অন্ধকার।'

৩.

লেখালেখির জগতে রিজিয়া রহমান আলাদা চারিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। তিনি প্রচলিত ধারার লেখক নন, তার থেকে আলাদা। তার সাহিত্যে অসাম্য, পিছিয়ে পড়া মানুষ, গণজীবন, গলিত-পিষ্ট জীবন, ক্লিষ্ট-ক্লিন্ন নারী, ভোগবাদী সমাজের নখর, পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য এসব ফুটে উঠেছে। সমালোচকরা বলেন, শিল্পকে তিনি নিছক প্রয়োজনহীনতার আদর্শে গ্রহণ করেননি, নিয়েছেন জাত-কুল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্য-মর্যাদার আনুকূল্য হিসেবে এবং তা সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে বিস্তর বৈচিত্র্যময় জনপদে কৃষ্টি-সংস্কৃতির অন্তর্গত দ্বন্দ্বের সংগ্রামশীল শাশ্বত অভীপ্সায়। রিজিয়া রহমানকে কেউ কেউ সমাজতাত্ত্বিক ধারার একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তাদের মতে, 'তার সমস্ত উপন্যাসেই একটি সামাজিক গোষ্ঠী বা শ্রেণির জীবনযাত্রা পদ্ধতির চিত্রণ আছে। প্রভূত যত্নের সঙ্গে তিনি ওই জীবনপদ্ধতি সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক তথ্যসমূহ সংকলন করেন।' প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে প্রায় সব রচনায়ই বলতে হবে এ কথার প্রমাণ মিলবে।

রিজিয়া রহমান উপন্যাস ছাড়াও নানা বিষয়ে বই লিখেছেন। কিন্তু তার মেধার স্বাক্ষর দেখা যায় তার উপন্যাসে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অগ্নিস্বাক্ষরা ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থে লাল টিলার আকাশ গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে অশ্লীলতার অভিযোগে ছাপাতে নারাজ ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পাদনা বোর্ডকে রাজি করিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়। এরপর ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তার 'ঘর ভাঙ্গা ঘর' উপন্যাস ছাপা হয়, যা বই আকারে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তার সাহিত্যের প্রকাশ ঘটলেও পাকিস্তান আমলে তার সূচনা হয়েছিল। বস্তির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। খেয়াল করা প্রয়োজন যে ষাটের দশকে আমাদের বহু লেখক বের হয়ে এসেছেন, তাদের অনেক উপন্যাস পাঠকনন্দিত হয়েছে এবং তখন ঢাকা বাংলা সাহিত্যের একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। প্রকাশনা শিল্পে কলকাতার প্রাধান্য ঘুচিয়ে ঢাকা আস্তে আস্তে স্থান করে নিতে থাকে। ষাটের দশকে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পেরও বিকাশ হয় আর বহু দেশীয় উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তার 'উত্তর পুরুষ' উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদসু্যদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-চন্দ্র সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। অবশ্য এসব ইতিহাস নিয়ে কিছু বিতর্ক যে নেই তা নয়। মনে রাখতে হবে তার বই উপন্যাস, ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন: 'উত্তর পুরুষ উত্তর প্রজন্মের অভিঘাত। এ-অভিঘাত ইতিহাসের, পূর্বজ মূল্যবোধের। কিছুটা নবীন-প্রবীণেরও। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯১৮-৭০) উপমহাদেশ উপন্যাসের কথা। সেখানেও পর্তুগিজ-আরাকান-বাঙালি জাতি-সংস্কৃতির মিশ্রণ ও মর্যাদার দ্বন্দ্বের স্বরূপ প্রকাশ ঘটেছে। রিজিয়া রহমানও ইতিহাসপিপাসু। ইতিহাসের সঙ্গে নৃ-জীবন ও জাতি-কাঠামোর সূক্ষ্ণ সংস্রবগুলো তার আগ্রহের ক্ষেত্র। ফলে তিনিও চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত পরিবার অ্যান্টনি ডিক্রুজের উত্তরপুরুষ বনি ডিক্রুজের দ্বন্দ্ব; কিংবা এ-দ্বন্দ্বের নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব-প্রবণতা আবিষ্কারে নামেন। এক দ্বন্দ্বময় প্রজন্ম বৃত্তান্তই উত্তরপুরুষ উপন্যাসে তুলে ধরেন।' এই কথার মধ্যে যথার্থতা রয়েছে।

রিজিয়া রহমানের আরেকটি বড় কাজ উপন্যাস 'রক্তের অক্ষর'। এটি নিষিদ্ধ পলস্নীর দেহপসারিণীদের মানবেতর জীবন ও বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে লিখেছেন তিনি। ঢাকার সাহিত্যে তা অভূতপূর্ব তো বটেই চমক সৃষ্টিকারী একটি ঘটনাও বটে। রক্তের অক্ষর প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। দৈনিক বাংলা গ্রম্নপের সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় দেহপসারিণীদের নিয়ে লিখিত প্রতিবেদন পড়ে তিনি এই উপন্যাস লেখার প্রেরণা পান বলে জানা যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইয়াসমীন। সে একজন বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত সহ্য করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাকে হতে হয় বীরাঙ্গনা। এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে ইয়াসমীনের প্রশ্ন : 'কতদিন আর বিকৃত রুচি পুরুষের নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা নিষ্ফল আর্ত-চিৎকারে দীর্ণ হবে?' উপন্যাসটি বিপুলভাবে পঠিত। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় বইটির সপ্তম সংস্করণ। গত কুড়ি বছরে হয়তো আরও কয়েকটি সংস্করণ হয়ে থাকবে। সপ্তম সংস্করণের শেষ প্রচ্ছদে যথার্থই লেখা হয়েছে : ''নিষিদ্ধ পলস্নীর প্রামাণ্য দলিল, অসাধারণ এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র রক্তে ভেজা আর তীব্র আর্ত-চিৎকারে বলে ওঠে 'ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি, বাট এভরি হোয়্যার ইজ ইন চেইন।"

মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনা এ দেশের মানুষের মনে মনে ছিল। চেয়েও না পাওয়ার বেদনা কত গভীর তা তারা বুঝতে পেরে হতাশ হয়, ঘটনাগুলো মনে গেঁথে যায়। যা আশা করেছিল তার কিছুই তারা পায়নি। উপন্যাসে তাই রিজিয়া বর্ণনা দিচ্ছেন বিষয়টাকে এভাবে-

"ইয়াসমীন দাঁড়ায়নি। প্রচন্ড একটা ঝোঁকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার মনে হয়েছিল সে দিনের সেই যুদ্ধে এ দেশটা এ সমাজটা কেন ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলোর সঙ্গে মিশে যায়নি।" [পৃ-৬৮]

প্রতিটি উপন্যাসে, কথাসাহিত্যে জীবনার্থ থাকে বলে সমালোচকদের ও সাহিত্য বোদ্ধাদের অভিমত। যদি বলি এই কয়টি লাইন এ উপন্যাসের জীবনার্থ হয়ে উঠেছে, ভুল বলা হবে কি? ইয়াসমীনের কম দুঃখে তো এ উপলব্ধি আসেনি।

'বং থেকে বাংলা' তার আর একটি নাম করা উপন্যাস। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও বাংলা ভাষার বিবর্তন এই উপন্যাসের মূল বিষয়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। এই উপন্যাসের ভূমিকায় রিজিয়া রহমান লিখেছেন-

''বাংলাদেশের জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসের সৃষ্টি।" বলা যায়, এটা শুধু উপন্যাস থাকেনি নৃতাত্ত্বিক গবেষণাজাত একটি শিল্প হয়ে উঠেছে।

নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপস্নবী রহিমউলস্নাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাঁথা নিয়ে তিনি লিখেছেন 'অলিখিত উপাখ্যান'। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। বলা হচ্ছে : এটি মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরির পাতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। রিজিয়া তার স্বামীর কর্মস্থল বেলুচিস্তানে কয়েক বছর অবস্থান করেন। ১৯৫৮ সালের বেলুচিস্তান বিদ্রোহের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন শিলায় শিলায় আগুন। এটিও প্রকামিত হয় ১৯৮০ সালে। তার স্বামীর আরেক কর্মস্থল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করার সময় তিনি সাঁওতালদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের শিকারি থেকে কৃষক ও পরে শ্রমজীবী হয়ে ওঠা, এই বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে তিনি রচনা করেন 'একাল চিরকাল'। প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত 'বাঘবন্দি' উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন বঞ্চনা থেকে মুক্তির আবশ্যকতা। 'প্রাচীন নগরীতে যাত্রা' উপন্যাসে লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন সম্পর্কে।

'ঘর ভাঙা ঘর' উপন্যাসে ভাঙনের স্বর তিনি শুনেছিলেন। কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটেছে। ফুলজান, জোলেখার মা, ময়না, হাবুর মা, পাগলা হাশেম, ফকিরচাঁদ, খালেকের মা প্রমুখ প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র জীবনাচার দেখা যায়। তিনি কথার বুনুনিতে বেঁধে ফেলেন সব আর্ত কণ্ঠস্বর।

একটি চা-বাগানের কাহিনি নিয়ে রচিত সূর্য সবুজ রক্ত। প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। রিজিয়া রহমান ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শ্রেণি-শোষণচিত্র অবলোকন করেছেন। উপন্যাসের চরিত্র হরিয়া, অর্জুন, চাঞ্চল্য, বিন্দিয়া, শ্রীমতি, লছমিদের চেনা যায় তার বিবরণের গুণে। চা বাগান ঘিরে আবর্তিত এঁদের জীবন। এদের যজ্ঞ-পূজা-সংস্কৃতি-আচার আনুষ্ঠানিকতার প্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসে। উঠে এসেছে চা বাগানের ইতিহাস, ব্রিটিশ গার্ডেনারদের অত্যাচারের কথা। কুলিমেমদের পরিণামও বিবৃত হয়েছে উপন্যাসে। প্রসঙ্গত বলি, চামেলী মেমসাহেব নামে অসমীয়া ছবিতেও এই কাহিনী বিধৃত। আবদুল মজিদ এই ছবির পরিচালক। ভূপেন হাজারিকা এর সঙ্গীত পরিচালক। পরে এটি পশ্চিম বঙ্গে বাংলায় রিমেক হয় এবং জনপ্রিয়তা পায়। অসম বিয়ে পরিণাম শুভ হয় না বা একটা খারাপ পরিণতি পায় এটা উঠে এসেছে এতে, যেমনটা এসেছে সূর্য সবুজ রক্ত উপন্যাসে। এতে আরণ্যক পরিবেশ বর্ণনায় রিজিয়া বিচিত্র বৃক্ষরাজির কথা যেমন উপস্থিত করেছেন তেমনি প্রকৃতির অকৃত্রিম বিবরণও দিয়েছেন।

২০১১ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ 'চার দশকের গল্প'। এতে ১৭টি গল্প রয়েছে, যার রচনাকাল ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১২ সাল। গল্পগুলোতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। অগ্নিস্বাক্ষরা ছাড়াও আরও দুটি গল্প গ্রন্থ হচ্ছে 'নির্বাচিত গল্প' ও 'দূরে কোথাও'।

৪.

রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের ভাষা সহজ, কাহিনী বিন্যাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। ফলে তা যথার্থ উপন্যাস বা কথাসাহিত্য হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে পাঠকপ্রিয়। কাহিনী সৃজনে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। বোঝা যায় একেকটি উপন্যাস লেখার আগে তিনি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক, গবেষণা করেছেন এবং অভিনিবেশ সহকারে সমসাময়িক ও পূর্বেকার গ্রন্থগুলো পাঠ করেছেন। চরিত্র সৃজনে তিনি একজন নিপুণা শিল্পী ছিলেন বলা যায়। তার এই ইয়াসমীন চরিত্র বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অনবদ্য এক সৃষ্টি। এ রকম অনেক চরিত্র তিনি সৃজন করেছেন যেগুলো লেখিকার অবর্তমানেও পাঠকের সাথে কথা বলে চলেছে নিরন্তর।

গল্প উপন্যাস ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিরিশের বেশি। 'অভিবাসী আমি' তার মধ্যে একটি। এটি তার আত্মজীবনীমূলক প্রথম বই। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। তার দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই 'নদী নিরবধি' ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি তার শৈশবের পাশাপাশি লেখক জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন।

তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে অরণ্যের কাছে (১৯৮০), ধবল জোৎ?স্না (১৯৮১), একাল চিরকাল (১৯৮৪), ঝড়ের মুখোমুখি (১৯৮৬), প্রেম আমার প্রেম (১৯৮৫), সবুজ পাহাড় (১৯৮৫), একটি ফুলের জন্য (১৯৮৬, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক), শুধু তোমাদের জন্য (১৯৮৮), হে মানব মানবী (১৯৮৯), হারুন ফেরেনি (১৯৯৪), আবে-রওয়াঁ (২০০৬), সুপ্রভাত সোনালি দিন (২০০৬), অতলান্ত নীল (২০০৬), অন্ধকারে বেতোফেন (২০০৬), উৎসে ফেরা (২০০৯), আলবুর্জের বাজ (২০১০), পবিত্র নারীরা (২০১০), সীতা পাহাড়ে আগুন (২০১০), নিঃশব্দ শব্দের খোঁজে, তৃণভূমির বাইসন, ডাইম নিকেল, প্রজাপতি নিবন্ধ, প্রাচীন নগরীতে যাত্রা, চন্দ্রাহত, বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী ও অন্যান্য (২০১২)। শেষ বইটিতে আছে তিনটি কাহিনী ক. বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী, খ. জ্যোৎস্নার নীল সীমানা, গ. জগৎ জুড়িয়া কান্দে। শিশুসাহিত্যের অঙ্গনেও কাজ করেছেন রিজিয়া। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে : আজব ঘড়ির দেশে, ঝিলিমিলি তারা, মতিশীলের বাড়ি ও অন্যান্য গল্প। দুটি অনুবাদ গ্রন্থও আছে তার।

৫.

রিজিয়া রহমান আমাদের কথাসাহিত্যের একজন নিবেদিতপ্রাণ শক্তিময়ী লেখক। তিনি নিরন্তর লিখেছেন। উপন্যাস লিখে তিনি আধুনিক উপন্যাস শিল্পের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। জীবনের হতাশা ও দুঃখবোধ, উপজাতিদের বা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর জীবন, শ্রম ও সংগ্রামশীলতা, নারীর মূল্য ও মর্যাদা তার উপন্যাসে পেয়েছে নতুন মাত্রা। তার সব উপন্যাসই যে সমমানের বা সেরা হয়ে উঠেছে এমনটা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু ওপরে আলোচিত উপন্যাসগুলো সেরা ও পাঠকপ্রিয় সে কথা মানতেই হবে। কথাসাহিত্য রচনার জন্য অভিজ্ঞতা দরকার, গবেষণার দরকার, তেমনি দরকার সৃষ্টিশীল মেধার। এ সবকিছুই ছিল রিজিয়া রহমানের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার কয়েকটি উপন্যাসে উঠে এসেছে। বলা হয়ে থাকে এ বিষয়ে মহৎ সাহিত্য এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে সময় যায়নি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করতে সময় তো কিছু লাগতেই পারে। তার কাজগুলোকে ইতিহাস ধারণ করবে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এই প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের লেখা বিরত হবে সন্দেহ নেই। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট রিজিয়া রহমানের মৃতু্য হয়েছে। কিন্তু কথাসাহিত্যিক রিজিয়া বেঁচে থাকবেন তার লেখার মাধ্যমে অনন্তকাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে