শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা ও গণসঙ্গীত

স্বপ্ন দত্ত
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা ও গণসঙ্গীত

কবি আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে কখন পরিচয় হয়েছিল, সন-তারিখ মনে নেই। সম্ভবত সেটি ঘটেছিল গত শতকের শেষের দিকে কিংবা চলতি শতকের শুরুর দশকে। বহুকাল আগেরই স্মৃতি।

প্রথম আলাপে উচ্ছ্বসিত আবেগে বলছিলেন এ দেশের পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দাদের অতি আন্তরিক আতিথেয়তার নানান কাহিনী-কথা। সদ্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে শহর চট্টগ্রামে এসেছেন। পরিচিত কারো কাছে আমাদের, অর্থাৎ 'স্পার্ক জেনারেশন'-এর সদস্যদের কারো সঙ্গে কিছুক্ষণের দেখা-সাক্ষাৎ ও আড্ডায়-আলাপে বসা যায় কিনা, তার খোঁজ-খবর করছিলেন। কে যে সেদিন কবি আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে কবি আবসার হাবীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল, আজ তা এতকাল পরে মনে পড়ে না। কিন্তু ভাবী, সে সংযোগটা হয়ে ভালোই হয়েছিল।

ততদিনে, স্পার্ক জেনারেশনের সদস্যরা পেশার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে, এই স্পার্ক জেনারেশন চট্টগ্রাম থেকে এস্টাবিস্নশমেন্ট বিরোধী এক প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা করেছিল। সেই প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র ঠেকানোর লক্ষ্যে জাগরণের ডাক ছিল কিনা, তা বোঝার জন্য কবি আবসার হাবীব ও আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ প্রশ্নাতুর হয়েই, আবসারের দেউড়ি ঘরের চিলে-কামরায় কবি আবুবকর সিদ্দিক একটি মগ্ন অপরাহ্ন থেকে শুরু করে অতিক্রান্ত সন্ধ্যাউত্তীর্ণ কাল পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। স্পার্ক জেনারেশনের বিভিন্ন প্রকাশনা, লিফলেট সাহিত্য, পোস্টার সাহিত্য এবং 'সম্পাদক' প্রকাশনীর নানাবিধ প্রকাশনা কান্ডগুলোকে পরখ করে দেখতে দেখতে, এসবই লেখক তৈরির 'কৌশলের খেলা বলে' মন্তব্য করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি আবুবকর সিদ্দিক 'স্পার্ক জেনারেশন'-এর লেখক তৈরির কৌশলটি যে যথার্থই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা তার এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা গিয়েছিল।

এ দেশের কিছু বাছাইকরা কবিকে নিয়ে 'সম্পাদক' প্রকাশনী 'স্বনির্বাচিত' প্রকাশ করেছিল। কাব্য সংগ্রহটি দেখে আবুবকর সিদ্দিক বেশ চমৎকৃত হয়েই বলেছিলেন, এই সংগ্রহশালায় সম্ভবত আমার কবিতা আর কাব্যভাবনাও থাকতে পারত। বলস্নাম, পারত থাকতে। কিন্তু, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভালো ভালো কবি-লেখকরা প্রচার পান না বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। আবুবকর সিদ্দিক বই থেকে মুখ তুলে তাকান। তারপর বলেস্নন, তা ঠিকই বলেছেন। সে কথা থাক, শিল্পী মুর্তজা বশীর কিন্তু লেখকদের ছবির স্কেচগুলো রেখাচিত্রের টানে আকর্ষণীয়ই করেছেন। তবে, একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সব স্কেচেই তিনি একই স্বাক্ষর দেননি। তাই না? কিন্তু কেন? বলস্নাম, আপনার দৃষ্টি এড়ায়নি দেখছি। স্বাক্ষরের পার্থক্যটা সর্বসাধারণে খোলাসা করা যাবে না। শিল্পীর বারণ আছে। আসলেই, কাহিনীটা কিছুটা নাজুকই।

এভাবে কথার পিঠে কথা বলতে বলতে অনেক ধরনের আলাপই হয়েছিল। তিনি কতটুকু বাম-ভাবনায় তার নোঙর ফেলে চলছেন, সেই প্রশ্নটিও উঠে এসেছিল। আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সম্প্রদায়িক আর সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতির নিয়ে মতবিনিময়ে ঐকমত্যের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও, আলাপে-আলোচনায় কোথাও-না কোথাও ভাবনায় আর উপলব্ধির ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ব্যাখ্যার ভিন্নতা প্রকাশ ও সমঝোতা সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা।

চমৎকার একজন কবি-মানুষের সঙ্গে সেদিন মিলেছিলাম আমরা। আমাদের পরস্পরকে চিনেছিলাম। তাতে জানাও হয়েছে অনেকটাই। বুঝেছিলাম মানুষ তাদের সব ধরনের প্রতিকূলতার বিপক্ষে নিজ নিজ বোধকে সম্বল করেই দাঁড়ায় ও নিজেকে পরিচালিত করে। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই একা। যূথবদ্ধতার অবয়ব গঠন করলে তা শুধু উদ্যম ও প্রেরণার জোগান দেয় মাত্র। লেখকদের একাই হাঁটতে হয়। যূথবদ্ধ আন্দোলন পরিবেশই গড়ে দেয়।

কবি আবুবকর সিদ্দিক কেবল কবিতাই লিখে গেছেন, তা নয়। বেশ কিছু গণসঙ্গীতও রচনা করেছেন এবং সেগুলো এক সময়ে বহুল পরিমাণে গীতও হয়েছে। বাংলাসাহিত্যে আবুবকর সিদ্দিক একজন স্মরণে রাখার মতোই কবি। তার বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ আছে। ১৯৬৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ধবল দুধের স্বরগ্রামে' প্রকাশিত হয়। তার এই একটি বই-ই আমি পড়েছি। সেকালে ঘোর বামপন্থির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্তির কারণে বইটি দ্রম্নতই আমার হাতে এসে পৌঁছায়। পরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা পেলেই তাকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।

১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট তার জন্ম। বাগেরহাটে তার পৈতৃক নিবাস বলেই জানা যায়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের, আমাদের এই বঙ্গভূমির ৮৭টি পূর্ণ ঋতুচক্রকে তিনি তার জীবনকালে ধারণ করে আছেন। বয়ঃভারাক্রান্ত হওয়ার ফলে আগের মতো সৃষ্টিশীলতায় তিনি এখন আর বিশেষ সমর্থ নন।

নিজেদের বসবাসের ভিটেবাড়ি হারানোর এক ধরনের বেদনা দেখেছি আবুবকর সিদ্দিকের মনের ভেতরে। তা প্রকাশ পেয়েছে আমাদের সঙ্গে সেদিনের আড্ডায়। তার হৃদয়ের এক কোণায় ওই বেদনার ভার বড়ো ভারী হয়ে রয়েছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ, পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক গৃহকোণ থেকে তাদের উচ্ছেদ করেছে। পরিণত বয়সে স্মৃতির বসতবাড়িটি দেখতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। গ্রাম দর্শন শেষে বাড়িটিও দর্শন করেন। সেই সময়ে ওই বাড়িতে বসবাসকারীকে অনুরোধ করে গৃহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন। খানিকটা ছুঁয়ে এসেছেন নিজের বাল্যস্মৃতিকে। আবুবকর সিদ্দিক লক্ষ্য করেছেন তার সঙ্গে কয়েকজন সঙ্গীসাথী হোমরাচোমরা ব্যক্তিবর্গ থাকায় ঘরের মালিক শঙ্কা বোধ করেছেন, না-জানি গৃহ মালিকানা-না কোনদিন ছেড়ে দিতে হয়! আসলে, কোনো অনুষ্ঠানের অতিথি হয়েই তিনি হয়তো সেই এলাকার কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ছেলেবেলার পূর্ব অবস্থানের স্মৃতির বিষয়টি ব্যক্ত করেছিলেন আয়োজক কর্মকর্তাদের কাছে। তারাই হয়তো পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাদের কাছেও এ সমস্ত কথার ঝুড়ি তিনিই খুলে ধরেছিলেন, সেই একদিনের আলাপে, আড্ডায়। তখনই মনে হয়েছিল তার জন্ম বুঝি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। পরে শুনি যে তার জন্মস্থান বাগেরহাটে। ইতিহাস কত কথাই-না বলে! তাই, হতে পারে সবকিছুই। সন্তানের জন্ম পিতার কর্মস্থলের বাড়িতেও হতে পরে। আদিবাস অন্য কোথাও হলে সেখানেও জন্ম হতে পারে। কিংবা আদি বাসস্থানে জন্ম নেওয়ার পর পিতার কর্মস্থলে গিয়ে বসবাসও হতে পারে। কবি আবুবকর সিদ্দিক আবেগাপস্নুত হয়ে স্মৃতির বসতবাড়ি পুনঃদর্শনের গল্পই করেন আমাদের কাছে।

সে রাতে কবি আবসার হাবীবের বাসায় নৈশ আহারে ক্ষণিকের অতিথি হয়েই বিদায় নেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। তারপর আর দেখা হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে