শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা হোসেন মিয়ার গল্প

গোলাপ মাহমুদ সৌরভ
  ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মুক্তিযোদ্ধা হোসেন মিয়ার গল্প

নাম হোসেন মিয়া বয়স ষোল বছর। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে চতুর্থ। সবেমাত্র যৌবনে টগবগে একজন পরিপূর্ণ যুবক। সাদামাটা জীবন আর বড় ভাইদের সাথে কৃষি খামারে সহযোগিতা করে। সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবেই সংসার চলছিল। হোসেন মিয়া নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর স্কুলে যেতে চায় না। তার মনে হলো এত পড়ালেখা দিয়ে কী হবে যতটুকু পড়েছি নাম দস্তখত করতে পারি তাই চলবে। পুরুষ মানুষ হইছি কামকইরা খাইতে হইব অত লেহাপড়া দরকার কী। একদিন মা বলল, হোসেন মিয়া তুমি তো এহন বড় হইছো লেহাপড়া যহন কর না বিয়া কইরা সংসারে একটা বউ এনে জীবনটা গুছাইয়া লও। হোসেন মিয়া কইলো, মা সবুর করো, আমি এখনো ভালো কোনো কামকাজ করি না, বিয়া করলে হইব। হইবোরে বাপ হইবো, আমার বয়স তো আর কম হয়নাই, এহন তোদের ঘরের পোলাপান দেইখা মরতে পারলে শান্তি পাইতাম। ঠিক আছে মা, ক'টা দিন ধৈর্র্য ধরো। দেশের যে পরিস্থিতি কখন পাক বাহিনী আইসা গুলি করে মাইরা ফালায় তা বলাই মুশকিল যদি আমাদের এ গ্রামে পাক বাহিনী আসে আমাদের কেই-ই বাঁচতে পারতাম না। হোসেন মিয়া তুই তো পুত আমার পেডেই হইছ তো আমি তরে ছিনি তুই ঘর থেকে বাইরে যাবি না। তোর জন্য আমার চিন্তা হয়। মা তুমি যে আমারে বিয়া করাইবা মাইয়া পাইবা কই। আমার হাতেই আছে তোর জামিলা খালার মাইয়া সোনিয়া, তুই রাজি থাকলেই হইব। হোসেন মিয়া মা'র আবদার পূরণে রাজি হইল। দুইপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে বিয়ার দিন-তারিখ ঠিক হইল ছাব্বিশে মার্চ ১৯৭১ সালে। বিয়ে হতে আরও একদিন বাকি। সেইদিন ছিল পঁচিশে মার্চ হোসেন মিয়া ও সোনিয়ার গায়ে হলুদ। সারাদিন মেহেদী পাতা বেঁটে গ্রামের মহিলারা বিয়ার গীত গাইল। কাল সকালে বিয়া হইব দুই বাড়িতে আনন্দের উলস্নাস চলছে। রাত এগারোটার পরে সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেল এবং সবাই শুইয়ে পড়ল। সবাই যখন ঘুমে বিভোর তখন রাত আনুমানিক দুইটা ঘুমন্ত জাতি আর স্তব্ধ পৃথিবী তখনই হঠাৎ ঢাকায় শুরু হলো পাক হানাদের নির্মমতার চিত্র, নির্বিচারে গুলির শব্দ চারদিকে ভয় আর আতংকে মানুষ মৃতু্যকে সামনে থেকে দেখছে। মানুষের কান্না আর আগুনের লেলিহান শিখা পুড়ছে বাড়ি, হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হলো হাজারো নিরীহ বাঙালি। বাদ যায়নি বৃদ্ধ, ছোট শিশু ও সারি সারি লাশের স্তূপ পড়ে আছে তাজা রক্তে ছেয়ে গেছে ঢাকার রাজপথ। মানুষ বাঁচার জন্য ছুটে যাচ্ছে দিক্‌বিদিক। কেউ কেউ শহর ছেড়ে পালাচ্ছে গ্রামের দি্েল তাতেও যেন ভয় কাটছে না কখন পাক বাহিনী গ্রামে এসে পড়ে। পরের দিন সকালবেলা গ্রাম-শহরের সব জায়গায় আতংক ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে হোসেন মিয়া ও সোনিয়ার বিয়ার আয়োজন সব বন্ধ হয়ে গেল। এখন মানুষের জীবন নিয়া টানাটানি এমন মুহূর্তে হোসেন মিয়া সোনিয়াদের বাড়িতে গিয়ে বলল সোনিয়া এদিকে এসো, সোনিয়ার হাতে পায়ে মেহেদীর সাজ হলুদমাখা মুখখানি গায়ে হলুদ শাড়ি নববধূর সাজে সজ্জিত সোনিয়া হোসেন মিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। দুইজন দু'জনার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। সোনিয়াকে দেখে হোসেন মিয়া মুগ্ধ হয়ে বলল, বাহ কতোই না সুন্দর তুমি নববধূর সাজে, যতই দেখি ততই দেখবার মনে লয় তোমারে আজই। হোসেন মিয়ার চাহনি দেখে সোনিয়া লজ্জা পেল, মুখটা আড়াল করে বলল কী দেখছেন এমন করে? হোসেন মিয়া আমতা আমতা করে বলল, না কিছু না, এসেছিলাম তোমাকে কিছু বলব বলে কিন্তু তোমার সৌন্দর্য দেখে আমি যা বলতে এসেছি তা ভুলে গেছি। তারপরেও বলতে হবে। জ্বি, বলুন। সোনিয়া তুমি জান আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা, কিন্তু কাল রাতে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল ঢাকার শহরে আজ প্রতিটি মানুষের মনে আতংক ছড়িয়ে আছে, কখন পাক বাহিনী এসে হানা দেয়। তাই আমি বলছিলাম কী, এখন আমাদের বিয়েটা বন্ধ থাকুক, যখন পরিস্থিতি শান্ত হবে তখনই আমাদের বিয়ে হবে তুমি কী বলো? হোসেন মিয়ার কথা শুনে সোনিয়া অঝোরে কাঁদল, কত্ত স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে সংসার হবে, ঘর হবে ভালোবাসা পাবে সব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে কল্পনা করা যায় না। সোনিয়ার কান্না দেখে হোসেন মিয়া বলল, আজ থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী, কিন্তু তোমার আমার দেখা হবে মিলন হবে স্বাধীনতার পর। হোসেন মিয়ার কথা শুনে সোনিয়া বলল, ভাগ্যটাই খারাপ। না সোনিয়া ভাগ্যের দোষ দিও না, দেশের এমন পরিস্থিতিতে রংতামাশা সাজে না, বরং দেশটাকে বাঁচানোর জন্য আমরাই এগিয়ে আসতে হবে, যদি তুমি অনুমতি দাও আমি যুদ্ধে যাব, আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হয়েছি এবং শপথ নিয়েছি কালই আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিব আর তার জন্য কাল সকালে আগরতলা ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। যিনি কমান্ডার তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, কিন্তু একটা কথা মাকে বলে এসেছি আমি তোমাদের বাড়িতে ক'দিন থাকব, যুদ্ধে যাব বলিনি, যদি বলতাম তাহলে মা যেতে দিবেন না, তুমি কাউকে কিছু বলবা না, খুব সকালে চলে যাব। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, যদি ফিরে না আসি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার বিশ্বাস বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব এবং তোমার সঙ্গে দেখা হবে বাসরঘরে। ভালো থেকো সোনিয়া, আসি। হোসেন মিয়া যুদ্ধে চলে গেল। প্রতিদিনই যেন ছড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধ। দেশের মানুষ অনাহারে মৃতু্যর ভয়ে রাত কাটায়, পুরো শহরে পাক বাহিনী ঘিরে ফেলেছে, মানুষ গৃহবন্দী হয়ে আছে। তিন মাস ট্রেনিং শেষে হোসেন মিয়া বাড়িতে এল মুখে বড়সড় দাঁড়ি এলোমেলো চুল কাঁধে রাইফেল সব মিলিয়ে হোসেন মিয়া একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। হোসেন মিয়াকে দেখে তার মা চিন্তে পারে না পায়ে সালাম করে বলল, কেমন আছ মা, আমি তোমার হোসেন মিয়া, এই দেখ আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি। জানো মা তারা বলে আমাদেরকে বাংলা ভাষা কথা বলতে দিবে না উর্দু ভাষা হবে আমাদের মায়ের ভাষা মুখের ভাষা, তুমি দোয়া করো মা, তাদেরকে এই দেশ ছাড়তেই হবে। বাংলা ভাষার দাবি মানতেই হবে বিজয় আমাদের নিশ্চয়ই হবে শুধু সময়ের অপেক্ষা। ছেলেকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না ধরে রাখতে পারল না। আয় বাজান, আজ আমি গর্বিত আমার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা। এদিকে সোনিয়া খবর পেল হোসেন মিয়া বাড়িতে আইছে শুনে তাদের বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছিল পথে বাচ্চু রাজাকারের সঙ্গে দেখা, কী খবর সাজগোছ কইরা কই যাইতাছ? সোনিয়া বলল, হোসেন মিয়ার বাড়িতে যাইতাছি। ও যাও শুনছি হোসেন মিয়া মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিছে, কামডা ভালো করে নাই, নিজে নিজের কপালে ক্ষতি ডাইকা আনছে তারে বলে দিও। এ কথা শুনে সোনিয়া তাড়াতাড়ি করে চলে গেল। কিছুদিন পরে পাশের গ্রামে পাক বাহিনী এলো রাজাকারের মুখে জানতে পারে এখানে নাকি মুক্তি বাহিনী আছে। হঠাৎ একদিন সোনিয়াদের বাড়িতে এসে পাক বাহিনী হাজির, সোনিয়া দেখতে খুবই সুন্দরী তারা সোনিয়াকে ধরে নিয়ে গেল ক্যাম্পে। রাতভর নির্যাতন করে সোনিয়াকে মেরে ফেলেছে তারা। খবর পেয়ে সোনিয়ার মা ছুটে যায় ক্যাম্পে, গিয়ে দেখে সোনিয়ার রক্তাক্ত দেহটা মেজেতে পড়ে আছে। মেয়ের লাশটা দেখে ওইখানেই স্টক করে মারা যান সোনিয়ার মা সখিনা বেগম। হোসেন মিয়া সোনিয়াদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে পাক বাহিনী সোনিয়াকে মেরে ফেলেছে। হোসেন মিয়ার দেহে যেন প্রতিটি শিরা-উপশিরার রক্ত টগবগ করছে প্রিয় মানুষটাকে একবার দেখতে পেল না। হোসেন মিয়া গ্রামের সব মুক্তি বাহিনীকে একত্রিত করে বলল, কাল রাতে বাচ্চু রাজাকারের বাড়িতে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করতে হবে, এভাবে বসে থাকলে চলবে না। কারণ সোনিয়ার মতো হাজারো নিরীহ নারীর জীবন শেষ হতে দিব না। রাত দশটা অপারেশন চালানো হয় বাচ্চু রাজাকারের বাড়িতে। দীর্ঘ একঘণ্টা সময় গুলাগুলি করার পর পাক বাহিনীর ক্যাম্পে রাজাকারসহ পাক বাহিনী নিহত হয় এবং শত্রম্নমুক্ত হয় কয়েক গ্রাম। স্বস্তি ফিরে পায়, মানুষ আনন্দ উলস্নাসে মেতে ওঠে। পরে আস্তে আস্তে শহরসহ সারাদেশে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ নয় মাস পর অনেক রক্ত ক্ষয় এবং ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হয়। যুদ্ধ থেমে যায়, দেশ স্বাধীন হয় কিন্তু হোসেন মিয়া নির্বাক হয়ে যায়; সোনিয়া স্মৃতি মনে করে অঝোরে কাঁদে প্রতি বছর এই দিনটি এলে। হোসেন মিয়া চুপচাপ বসে থাকে। আজও সোনিয়া কথা মনে রেখে পরবর্তীতে বিয়ে করেননি মুক্তিযোদ্ধা হোসেন মিয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে