শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা কবিতার সন্ধ্যাতারা আল মাহমুদ

বিমল ভৌমিক
  ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
বাংলা কবিতার সন্ধ্যাতারা আল মাহমুদ

শামসুর রাহমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবির অভিধায় অভিষিক্ত। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ এ অভিধাও তো সত্যি। সুবোধ সরকার যথার্থই মন্তব্য করেছেন- 'বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবির নাম আল মাহমুদ।' বৃহত্তম কুমিলস্না জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রাম। এ গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে কবি আল-মাহমুদের জন্ম। বিখ্যাত মোলস্নাবাড়ীর ভূমিপুত্র আল মাহমুদ। এ বাড়িতেই তার জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি কর্কট রাশির জাতক। তিতাস নদীর পাড়ে এক ছোট সবুজ গ্রাম নিভৃত পলস্নী প্রান্তর ঘেরা মৌড়াইল তার নাম। যেখানে আল মাহমুদের বেড়ে ওঠা। কৈশর-যৌবনের প্রারম্ভিকতার সূচনা এখানেই। তার এ গ্রামের পাঠশালাতে প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তি। বর্ধিত গ্রাম জগৎপুর। এ গ্রামেই আঞ্চলিক প্রখ্যাত বিদ্যাপীঠ জগৎপুর হাই স্কুল। এ স্কুলেই তার মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়া-লেখা। ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় পলস্নী-প্রান্তরের গাছ-গাছালিসমৃদ্ধ এক উদার প্রাকৃতিক সুন্দরের লীলা ভূমিতেই তার কবিতার সৃজনশীল প্রেমময়তা। বর্ষার পলস্নীর নাচনে ময়ূর পূর্ণাঙ্গ পেখম মেলে কেকা রবে গেয়ে উঠেছে- নাচ ময়ূরী নাচরে! রুম ঝুমা ঝুম নাচরে। এখানেই তার মায়ের হারিয়ে যাওয়া নোলক খোঁজার শুরু। যৌবন-বসন্তের এক শুভ সন্ধিক্ষণে সৈয়দা নাদিরা বেগম নামের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অতঃপর তার সংসার জীবনে পদার্পণ। তিনি সন্তানের পিতৃত্ব অর্জনে সন্তান লালন-পালনে সঠিক কর্তব্য পরায়ণ হয়ে উঠতে সুযোগ্যা স্থরি কল্যাণে সফল পিতৃত্বের পরিচায়ক হন। ছোট একটি শহরের সন্নিকটস্থ অখ্যাত এক গ্রাম থেকে টিনের এক ভাঙা সুটকেস নিয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকা। কবিতার মাঠে চাষাবাদ করতে এবং কবি হওয়ার নির্মল স্বপ্ন-স্বপ্ন বিভোরতায় আসেন ঢাকা শহরে। রাজধানী শহরে আসার সময় সঙ্গে আনের তার জন্মভূমির সঙ্গীতের শহরস্ত সেতারের সুর-লয় তান, আপন মাঠের সোঁদা মাটির গন্ধ। দোআঁশের সারল্য, চালধোয়া হাতের স্মৃতিময়তা এবং গ্রামের জল-কাঁদায় ধোয় এক জোড়া পা। যে পায়ে ভেঙে এসেছে বাংলার পলস্নী-প্রান্তরের মেঠো পথ। এঁটেল মাটির মমতা মাখানো হৃদয়ের স্নেহসিক্ত মায়ের মুখ। শহরের যান্ত্রিকতার মাঝেও তার কবিতার পথ খুঁজে পেতে কষ্ট বেশি করতে হয়নি। যান্ত্রিক জীবন, যন্ত্রণার শহরে আসা কবি মনের প্রবল আত্মবিশ্বাসে কবিতার জগতে তার সহজবোধ্য বিচরণ উপেক্ষিত হয়নি। শহুরে বান্ধবগোষ্ঠীর তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা অগ্রাহ্য করেও প্রতিষ্ঠালব্ধতায় থেকেছেন অবিচল। কপদকহীন শূন্য জীবনবৃত্তে অমসৃন পথ; প্রতিষ্ঠা পেতে তার ছিল না কোনো উচ্চস্তরের শিক্ষা সনদ। তবু তিনি সংগ্রাম মুখর পথে শহরজীবনে প্রতিষ্ঠার আলোকচ্ছটা উদভাসিত করেছেন। সাহিত্যাকাশে কবি জীবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র 'সোনালী কাবিন'। তখন তিনি ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের। এ বয়সেই জয় করে নেন দু'দুটো কাব্য সাহিত্যের উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর বাংলা একাডেমি পুরস্কার। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ইত্যাদি কবিদের কাব্য হিংসাকে প্রতিবাদে প্রতিহত করেন কবিতালোকচ্ছটায়। কবিতার আশ্রয় অরণ্যে অনুসন্ধান করেছেন কবি জীবনের অনুষঙ্গক্রমে। কবিতা কবিজীবন পরিক্রমায় কৈশর স্মৃতি, ব্যথাহত ম্স্নান মায়ের মুখ, নিমডালের রসে থাকা হলুদ পাখি, পাতার আগুন দিয়ে রাত জাগা ভাইবোন, সেকেলের গণ্টাধ্বনি, মায়ের নামে খুলে যাওয়া জানালার কপাট। কবিতা তাকে ভোরের আযান, কুয়াশা ঢাকা পথ, মাছের আঁশটের গন্ধ, স্বাধীনতার মিছিল, নিশান, বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা, দাদির কবর আন্তরিকতার সুখস্পর্শে করেছে হৃদয় মথিত আহ্বান। যে দেশে রাজনীতির দাঁড়ি পালস্নায় মাপা হয় অনেক কিছু। সাহিত্যেও পরিমাপ, এমন কি কবি, গল্পকার প্রবন্ধকার ও ঔপন্যাসিককেও ওজন করা হয় ব্যবসায়ের কাঠগড়ার দাঁড়ি পালস্নায়। এমন একটি সভ্য সমাজে আল মাহমুদের জন্ম। আজীবন বৈপরীত্যও চিন্তাচেতনা লালন করেছেন। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঝুলন্ত জীবনের ঝুঁকিময় ক্ষণ গণনা করেছেন। যৌবনে সাম্যবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত যৌবন কাটিয়েছেন। মধ্যবয়স পর্যন্ত তার চিন্তাচেতনা সুস্পষ্ট কমিউনিস্ট ধারায় সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিল। সাহিত্যের সে চেতনার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। আল মাহমুদ কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নিবন্ধকার এবং সাংবাদিক। সবকিছুকে অতিক্রম করে চির জাগ্রত থাকে তার কবি সত্তা। আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিক, নবচেতনার ভাষাবিন্যাসেও বাক্য সংযোজনে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে যেসক সাহিত্যসেবীরা তাদের লেখনীতে বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়নে জর্জরিত পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবাদমূলক লেখালেখি করেছিলেন আল মাহমুদ। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণ ছিল। অভিনব প্রকাশভঙ্গিতে প্রতিটি স্তরেই তার স্বাক্ষর রয়েছে উপস্থাপনার নতুনত্বের। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বার্তা নিয়ে আসছিল প্রগতির পতাকাবাহী কবিরা। ১৯৮৭ সাল। স্বৈরাচারবিরোধী অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ জাতীয় কবিতা পরিষদ তার উদার নৈতিক বৈশিষ্ট্যে স্নাত জাতীয় কবিতা উৎসব। যার আয়োজক জাতীয় কবিতা পরিষদ। প্রতি বছর বাঙালিত্বেও অসাম্প্রদায়িক এ উৎসবের প্রথম ছয় বছরের আহ্বান ছিল- শৃঙ্খলমুক্তির কবিতা (১৯৮৭), স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা (১৯৮৮), সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা (১৯৮৯), কবিতা রুখবেই সন্ত্রাস (১৯৯০), গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা (১৯৯১), কবিতা রুখবেই মৌলবাদ (১৯৯২)। কবিতার জয়, বাংলার জয় এ ধারণা থেকে প্রকৃতভাবে প্রতীয়মান হয় বাংলা কবিতার উৎকষমতায় চরিত্র। কবিতায় চিত্রিত হয় বাংলা কবিতার আসল মান সমৃদ্ধতা। ইসলামী চেতনায় কিছুটা নিম্নগামিতা এবং বাঙালি চেতনার উন্মেষ এ সময়ের সাহিত্যাঙ্গনকে এক নতুন চেতনায় পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রতিভাত হয়। সাহিত্যের প্রচলিত প্রবাহ চিত্র এবং বিদ্যমান ধ্যান-ধারণার বিপক্ষে যেসব কবি ও সাহিত্যিকদের অবস্থান আল মাহমুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নব চেতনার জাতিসত্ত্বায় শারীরিক সেষ্টব ও আত্মিক নৈকট্যের উপস্থাপনা করেন অত্যন্ত নিখুঁত দক্ষতায়। পঞ্চাশের দশকের কবিকুল তৎকালীন শাসক দলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যৌবন-জোয়ারে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। গ্রামীণ ঐতিহ্যে পান্তা-ইলিশ, গ্রামের মেয়ের আট পৌরে শাড়িতে জড়ানো শরিরের ঢাকা আব্রম্ন-আচ্ছাদন, ফকির-বাউল আর রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গীত সমৃদ্ধতায় কবিতার মাঠ হয়েছে সুজলা-সুফলা। গান-কবিতা-সাহিত্যে সমৃদ্ধ এ জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে ঐতিহ্যগতভাবেই আজ বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত। শিল্প-সংস্কৃতি-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতিতে স্রোতস্বিনী বাঙালি মেয়েরাও কর্মে-যজ্ঞে-চলনে-বলনে স্বাধীন হতে চেয়েছে বলেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর ইতিহাসে দেশ আজ অন্যতম স্থানে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যের অহংবোধে উজ্জীবিত আল মাহমুদের প্রথম গল্প 'তিতাস চরের ছেলে' প্রকাশিত হয় সত্যযুগ পত্রিকায়। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। ১৯৫২ সাল। ভাষা আন্দোলনে মুখর বাংলার আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি। তখন বাংলার সাহিত্য চেতনায় মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কবি সাহিত্যিকদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। সে সময় আল মাহমুদও এ পটভূমিকায় বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠায় লিখেছিলেন কবিতা। ফলে তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ওই সময় আল মাহমুদ দশম শ্রেণির ছাত্র। বাধ্য হয়েই তাকে আত্মগোপন করতে হয়। পেশাগতভাবে আল মাহমুদ সাংবাদিক এবং বই প্রকাশনা সংস্থার কর্মকর্তা। ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক সময়। আল মাহমুদ প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সাল। আল মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেন। বিনা বিচারে একবছর থাকলেন কারান্তরীণ। ১৯৭৫ সাল। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন আল মাহমুদ। অতঃপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ডেকে পাঠালেন। শিল্পকলা একাডেমির প্রকাশনা বিভাগে যোগ দিলেন। এবার তার প্রাপ্তি বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পরবর্তী সময়ে সর্বমোট বারোটি পুরস্কারে ভূষিত হলেন। পেলেন ভানুসিংহ সম্মাননা পদকও। কবি আল মাহমুদ কবিতাকাশে অবাধ বিচরণের পাশাপাশি অত্যন্ত সুনিপুণতায় ছোটগল্প, লেখেন। যা পাঠক মনে বিশেষ রেখাপাত করতে সমর্থ হয়। এছাড়া উপন্যাস, এমন কাহিনী, আত্মকথা, অনুবাদ কবিতাসহ সাহিত্য, শিশু-কিশোর ছড়া কবিতা ও গল্পসহ গদ্যের ভুবনেও তার সার্থক পদচারণা উলেস্নখ যোগ্য। এ সময়ে আল মাহমুদ তার সৃজন শীলতার একটি স্বতন্ত্র যুগাবত প্রবর্তনে সার্থক রূপায়ন করেন। গড়লেন একটি স্বতন্ত্র ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক সার্থকতায় মুগ্ধ এক গদ্য শৈলীর পুরোধা ইমদাদুল হক মিলন। যিনি আল মাহমুদকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তার মূল্যায়নে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় 'সারাক্ষণ কবিতার জগতে বসবাসকরা, কবিতার ভেতরে নিমগ্ন আল মাহমুদ এক সময় গদ্য লিখতে শুরু করেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় লিখলেন গল্প। কালো নৌকা, জল বেশ্যা, পানকৈড়ির রক্ত ইত্যাদি। এ গল্পের সার্থক প্রকাশনায় পাঠক সমালোচকদের চমকে দিয়েছিলেন। তার ছোট গল্পের বিষয়সমূহ কী অসাধারণ, কী অসাধারণ ভাষাশৈলীর উপস্থাপনা, অসাধারণ বর্ণনা। কবিতার মতো বাংলা ছোট গল্পেও তার নিজ আসন স্থায়ী করে ফেললেন। বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ যুক্ত করলেন সম্পূর্ণ একটি নতুন মাত্রা। ছোট গল্পেও নিয়ে এলেন নতুন স্বতন্ত্র একটি মাত্রা। কবিতায় আল মাহমুদ তৈরি করেছিলেন নিজস্ব রীতির আকর্ষণীয় একটি কাব্যভাষা। গদ্য রচনালোকেও নিয়ে এসেছেন স্বতন্ত্র শৈলীর একটি ভাষার ব্যঞ্জনা। যে কারণে আল মাহমুদের রচিত সাহিত্যের বিষয়াবলিতে ফুটে উঠলো শুধুই তার নিজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্য। লেখালেখির পর্যায়ে সপ্তসিন্ধু দশদীগন্ত প্রসারণে আল মাহমুদের তুলনা আল মাহমুদ নিজেই। অন্য কারো সঙ্গেই গদ্য ও কবিতার রচনা শৈলী ও ভাষা বিন্যাস মেলে না। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে এক জীবন্ত কিংবদন্তি এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এক সময় বাংলা জগতের বিশিষ্ট বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব পুর্নেন্দ পত্রী বলেছিলেন- 'আজ পর্যন্ত আমাদের যা কিছু আধুনিকতা, তার জন্মদাতা রবীন্দ্রনাথ।' আল মাহমুদ এ সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য যথাযথ মনে করে যথার্থতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এ সময় তিনি বামপন্থি রাজনীতিকে চেতনার নিজস্ব মননে সাম্যবাদের মন্ত্রে জারিত ও দীক্ষিত হয়েই তার লেখালেখিতেও এ প্রভাব ছায়া পাত করে সুস্পষ্টভাবেই। সোনালী কাবিনের সনেটসমূহের উপস্থাপনায় তার স্বাক্ষর সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। ষাটের দশকের শেষার্ধে শাসুর রাহমানকে এক চিঠিতে আল মাহমুদ লিখেছিলেন 'আমি বিচ্ছিন্ন অস্তিবাদী লেখক নই। আমার পরিষ্কার রাজনৈতিক আদর্শ ও মতামত আছে। সমাজ বিশ্বাস আমার কাছে যেমন বড় কথা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করতে আমি তারও চেয়ে বেশি মূল্য দিয়ে থাকি। এর জন্য নিশান নিয়ে রাস্তায় নামতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। দরকার হলে পার্টি সংগঠনের জন্য কাজ করব- রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার সাঁটাব। কবিতা লেখার মতো এসব কাজও আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত।' বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুবোধ সরকার তার একটি বিশেষ প্রবন্ধে লিখেছিলেন- 'কবি টেরোরিস্ট হতে পারেন, সন্ন্যাসী হতে পারেন, হোমোসেক্সয়াল হতে পারেন, খুনি হতে পারেন, তিনি যদি ভালো কবিতা দিয়ে থাকেন পৃথিবীকে তবে তিনি কবি। তিনি খুনি কিনা সেটা আদালত দেখবে আমি দেখব তার কবিতাকে।' দীর্ঘ দিনের রটনা বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে আল মাহমুদ একজন মৌবাদী। পৃথিবীতে বহু মৌলবাদী আছেন। বিজ্ঞানী, গায়ক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মজীবী মানুষ কিন্তু তার প্রতিভা-কর্ম-সৃজনশীলতাও কি মৌলবাদী? এরা পাউন্ডের ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থনে তার কবিতার কাজ কি মৌলবাদ দুষ্ট হয়েছে? তিনি টি এস এলিয়টের লেখার বত্রিশটি লাইন বাদ দিয়ে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনয়নে উদ্বুদ্ধ করে ছিলেন; সে ইতিহাস কি আজ ভুল প্রমাণিত করেছে? ইতালিতে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর দু'বার মসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন, এ কারণে তার কবি খ্যাতি নষ্ট হয়েছে, এমনটি কি ঘটে? তাহলে আল মাহমুদের দোষ কোথায়? তিনি কৈশর-যৌবনে কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় ভাস্বরিত ছিল কমিউনিজম। বয়সের পরিণতিতে ধর্মীয় দর্শনে আকৃষ্ট হলেন। তদুপরি তিনি বিখ্যাত মুসলিম পরিবারের মোলস্নাবাড়ীর সন্তান। এতদ্‌সত্ত্বেও তাকে মৌলবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। এজন্য তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধসমূহ কি মৌলবাদে দুষ্ট? বেয়াক্কেলদের অভিধা আল মাহমুদ যেহেতু মৌলবাদী, তাই তিনি কবি না। তথাপিও আল মাহমুদ কবি। বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বাংলা জগতের, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবিদের অন্যতম একজন। ২০০২ সাল। শ্রীরামপুর গঙ্গাপাড়ের বাসা। চন্ডী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ অত্যন্ত ক্রোধ ও ঘৃণাভরে বলেছিলেন, একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখন যারা আমাকে মৌলবাদী বলছেন, তাদের ক'জন মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জোর দিয়ে বলছি, আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। রীতিমত প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বন্ধুক হাতে তুলে নিয়েছি। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি। এখন যারা বড় বড় কথা বলছেন, তারা তখন মুক্তিযুদ্ধের সমালোচনা করতেন। অনেকে হয়তো গোপনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ভূমিকায়ও ছিলেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলাদেশ হওয়ার পরই তারা তাদের চরিত্র পালটে ফেলেছিলেন। সরকারের থেকে অনেক ধান্ধা আদায়ের খেলায় মেতে উঠেছিলেন। এখন আমি মৌলবাদী। এটা অত্যন্ত জঘন্য একটা পরিকল্পিত বদনামমূলক অপৃশ্য রটনা। আমাকে হিংসাত্মকভাবে মারাত্মক ক্ষতি করার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। আল মাহমুদের চর্তুদশপদী কবিতা সম্ভাবর 'সোনালী কাবিন'-এর মাধ্যমেই সাহিত্যের স্থায়ী আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন তিনি। চাষ করতে হলে বা লাঙল দিয়ে মাটির উৎকর্ষ সাধিত হয়। সে কর্ষিত মাটিতেই ফলে ফসল। একই পদ্ধতিতে ঊর্বরতা সৃষ্টি ও ফসল ফলাতে ক্ষেত্ররূপী নারীকে কর্ষণ করে লাঙল বা হলরূপী পুরুষ। এ বিশ্বাস আদিম থেকে চলে আসছে। 'আল মাহমুদ লোক পুরাণের এ আদিম বিশ্বাসকে তার কাব্য ও গদ্যের ভাবনায় অত্যন্ত সুচারুরূপে গ্রহণ করেছেন। জীবনের আমি সংস্কারাচ্ছন্ন চেতনায় নারী-পুরুষ রিরং সাশ্রিত বিষয় প্রস্ফুটিত। আমাদের প্রত্যেক পরতে পরতে উৎপাদন পদ্ধতি মৃত্তিকা এবং হলকর্ষণের সমঙ্কয়সাধনে নিয়ন্ত্রিত হয়। সে ভাবেই মৃত্তিকারূপী নারী ও হলকর্ষক পুরুষের রিরং সাজনিত জৈবিক মিলনে ফলনশীল মানব উত্তরাধিকার সৃষ্টি হয়। আল মাহমুদ তার সাহিত্য দর্শনে প্রস্ফুটিত করেছেন- নারীর ক্ষেত্রময় উর্বর ভূমিকে পুরুষ কর্ষণে ফলায় সোনালি ফসল এই আদিম পৌরাণিক চেতনা তার ভাবনায় উদ্ভাসিত। তার চৈতন্য এ ভাষা-মাধুরীতে বিনির্মিত হয় সাহিত্যের মোহিত রূপান্তর। পুরুষকে নারী জৈব চেতনার উৎস বিবেচনায় ব্যক্তিগত জীবনের চরিতার্থতা এবং চরিতার্থতার রিরং সাবোধে হন উন্মত্ত। এ পৌরাণিক চেতনালোকে আল মাহমুদের কাব্য ভাবনায় নারীর রূপান্তর ঘটে কামনার কমনীয় কালিদহে কামুক নারীত্বে। এ কারণে তার 'সোনালী কবিন'সহ কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে প্রচ্ছন্নতার আড়ালে আধুনিকতার উপস্থাপনে দ্বিধাহীনভাবেই লিখতে পারেন। তার সাহিত্য ভাবনা অবগাহিত হয় সেক্সের তিমির তীর্থে।

আল মাহমুদ বয়সি জীবনে ধর্মীয় চেতনায় আক্রান্ত হলেও তা মানবতাকে অস্বীকারের ভেতর দিয়ে নয়। রাজনৈতিক চৈতন্যের পূর্বে অবশ্যই তার মর্মোপলব্ধিতে ইতিহাস চেতনা ও জাতিগত চেতনার সঙ্গে সমন্বয় সাধনে অভিজ্হান-স্নাত হয়ে লোকজ উপাদানকে করে তোলেন কবিতার উপজিব্য। তিনি তার গল্প সম্ভারে এ অবদমন বর্জন চেয়েছেন। বাঙালি জীবনের যৌনতার অমোঘ ভ‚মিকা যৌনানুসঙ্গে প্রস্ফুটিতে বারংবার নগ্নতা। তিনি কি পোশাক উন্মোচনে একটি জাতির অবচেতনকে নগ্ন করে আসলে প্রকৃত রূপ পরিগ্রহ করতে চেয়েছেন? আল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যৌনতার কোনো তৃপ্তি নেই। এ আগুন একবার দেহের ভেতর জ্বলতে দিলে সে সবকিছু পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। আমার একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, যৌন সুখের চেয়ে মহত্তম কোনো সুখ প্রাণীদের মধ্যে আল্লাহ সৃজন করেননি।’ তাই কি আল মাহমুদের সাহিত্যে যৌনতার এমন নান্দনিকতার অবতারণা হয়েছে? নারী যৌন সম্ভোবগের বিষয় শুধু নয়, পাশাপাশি গার্হস্থ্য জীবন ও প্রকৃতি আল মাহমুদের কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। নারী যৌন তৃপ্তির আধার শুধু নয়, আশ্রয়াধার, গৃহিণী, সংসার যাপনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা শিল্প-সংস্কৃতির অপসারক। নদীর যৌবন স্রোতে সর্বাপেক্ষা তার জীবনে উঁকি দিয়ে যায় শৈশবের তিতাসে অভিসার আর প্রচ্ছায়া। তার চেতনার স্মৃতি সব নদী যেমন তিতাস, সব গ্রামই তার মাতৃময় জন্মগ্রাম। লেখালেখির শেষ পর্যায়েও তিনি প্রেমের কবিতা যৌবনদীপ্ততায় উদক্ষাসিত করেই লেখনীতে সমভাবে উপস্থাপন করেছেন। অধিকাংশ কবিই জীবনভর প্রেমের কবিতা লিখে এসেছেন অত্যন্ত সার্থকতায়, কিন্তু জীবন সায়েহ্নে এসে তারা প্রেমের কবিতায় সঠিক প্রেমময়তার উপস্থাপনে ব্যর্থতার পরিচায়ক হয়ে ওঠেন। কিন্তু আল মাহমুদ জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সুস্থ লেখার সামর্থকালে আরও পারদর্শী, আরও হৃদয়গ্রাহী আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন প্রেমের কবিতায়। তার কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে গণজীবনের বিচিত্র শব্দ সম্ভার। তার লোকজনন্দিত কবিতার কন্দরে প্রস্ফুটিত জনজীবনের ভাষাশৈলী প্রথিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্রের নতুত্বের যে উপস্থাপন, সেটা সম্ভবত জরুরি, তবু তার বাস্তবায়ন বাংলা সাহিত্যে একনোধীরলয়ে অবেলায় অবহেলায় জর্জরিত। আল মাহমুদ শুধু শক্তিমান কবি নন, আঞ্চলিকভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা দিতেও তার কাব্য সাধনার একটি বিশেষ তাৎপর্য পরিলক্ষিত হয়। তার উপজীব্যে, বাকপ্রতিমার সংযুক্তিকরণে নাগরিকতা এবং আঞ্চলিকতার দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থানে জামদানি শাড়ির কথা স্মরণের পদার্থ ভেসে ওঠে। কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী, যে জলসিক্ত সুখদলজ্জায় নিজেকে অনাবৃত করে। কবিতা তার রিরংসিত কম্পিতা কুমারীর নিম্নাচলে বদ্বীপ আকারে আচ্ছাদিত। এ পৃথিবীতে কিছুই থাকে না, তার প্রেমিক প্রাতিস্বীকতা দীর্ঘদিন যাবত অনিকেতে আর্তিতে আটকা থাকে। উন্মুলিত গ্রাম ও প্রতিবন্ধকহীন শহরের পরিজ্ঞান তার স্মৃতি ও অনুকাঙ্খা দিয়ে নিষিক্ত। লোক-লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৭), সোনালী কাবিন (১৯৭৩)-এ নামকরণসমূহ আল মাহমুদের পরিচিতি পরিচ্ছন্নতার উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর বহন করে। লোক জীবন-লোকভাবনা চিন্তাচেতনাকে তিনি প্রকরণে পরিচর্যালোকে সর্বাপেক্ষা যতেœ করে তুলেছেন আধুনিকতার উৎকর্ষ সাধন। লোকজ বাংলার প্রতি তার এ আন্তরিকতাময় দৃষ্টিপাত ও গাঢ়তর আত্মীয়তার বন্ধনই তাকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য সাধারণ কবির অভিধায়। বাংলা কবিতার তিরিশি প্রবণতার সঙ্গে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণদৃশ্যপট, নদীকে নিয়ে বাঁচা, প্রান্তজীবন ও কর্ম, প্রাণধর্ম, নর-নারীর চিরন্ত্রণ প্রেম-বিরহ তার কবিতার প্রেক্ষাপট। তার যে লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সেগুলোÑ কাব্য সম্ভার লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৭), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫), আরব্য রজনীর রাজ হাঁস (১৯৮৭), প্রহরান্তের পাশ ফেরা (১৯৮৮), এক চক্ষু হরিণ (১৯৮৯), মিথ্যাবাদী রাখাল (১৯৯৩), উড়ালকাব্য (২০০৩) প্রভৃতি। তার গল্প গ্রন্থ যার সঙ্গে পরিচয় হয়Ñ পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫), সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮৩), গন্ধ বণিক (১৯৮৮), ময়ূরীর মুখ (১৯৯৪), নদীর সতীন (২০০৪) ইত্যাদি। তার উপন্যাসসমূহের মধ্যে ডাহুকী (১৯৯২), কাবিলের বোন (১৯৯৩), নিমিন্দানারী (১৯৯৫), আগুনের মেয়ে (১৯৯৫), উপমহাদেশ (১৯৯৩), কবি ও কোলাহল (১৯৯৩), চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামীণ চিত্রই প্রস্ফুটিত হয় অত্যন্ত আন্তরিকতায়। জসীমউদ্দীন তার প্রিয় কবি। আল মাহমুদের জন্ম এক নিভৃত পল্লী প্রান্তরে। তার দু’চোখে গ্রাম আর গ্রাম। শস্যের মাঠ, নদী, ঘাট, বটতলার গ্রামের হাট। নদীর দু’পাড় নারীর শাড়ির নকশাকৃতি আঁচল হয়ে উঠে। এ মহাত্মন কবি পবিত্র দিন শুক্রবার ছিল সেদিন। ২০১৯ সাল। ১৫ ফেব্রæয়ারি রাত ১১টা ০৫ মিনিটে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার কবিতায় তিনি যে দিন চলে যেতে চেয়েছেন, মহান সৃষ্টিকর্তা তার সেদিনই যাওয়ার সময় নির্ধারণ করেছেন। বসন্ত এসেছিল সেদিন। আনন্দ ঝর্ণায় করেছিল সে বাসন্তি উৎসব। তবুও তো সেদিনই চলে গিয়েছিলেন ভুবনময় অসুখ রচনা করে বসন্তের এ প্রারম্ভকালে। কবিতায় উদ্ভাসিত রক্তের নাচনে ছান্দনিকতা, গল্পের বাস্তবানুগ চিত্রকল্প, উপন্যাসের প্রেম প্রকৃতি প্রবন্ধে-নিবন্ধে স্বশব্দগ্রাহী আল মাহমুদের সাহিত্য ভাবনায় স্নাত হয়ে মনে গেঁথে রাখি তার অমর সৃজনকে। আছে জ্বরা, আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু তবুও আগামী প্রজন্মান্তরের হৃদয়ের গভীরে প্রথিত হোক আল মাহমুদের সাহিত্য চেতনা। তার স্মৃতি চিরভাস্বরিত থাক যুগ-যুগান্তরব্যাপী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে