সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের বিড়ম্বনা বিয়ে বিচ্ছেদ

আরিফা সুলতানা
  ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিবাহ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যাকে কেন্দ্র করে সমাজের সুষ্ঠু পরিবেশ যেমন নিশ্চিত করা হয় তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেওয়া হয় একটি সুন্দর জীবন, তৈরি হয় পরিবার। কিন্তু এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই মহামারির মতো যে সামাজিক ব্যাধি তৈরি হচ্ছে তার নাম বিয়েবিচ্ছেদ- যা বর্তমানে উদ্বেগের কারণ। স্কট কলেট্রন ও মিশেল এডামস নামের দুজন সমাজবিজ্ঞানী এই অবস্থাকে কালেক্টিভ অ্যাংজাইটি বা সামষ্টিক দুর্ভাবনা বলতেন। বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষের সম অধিকার নিশ্চিত করা হলেও পারিবারিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি নারীদের স্বাধীনতা। একই পরিবারে কর্মজীবী পুরুষকে যেভাবে সম্মান ও বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয়, নারীকে তা দেওয়া হয় না। একজন কর্মজীবী নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সাংসারিক চাপ। শ্বশুরবাড়ি থেকেও বেশির ভাগ সময় সহযোগিতা না করে উলটো আরও বেশি কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং নিখুঁতভাবে পালন করা না হলে শুনতে হয় বিভিন্ন নেতিবাচক কথা অথবা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ। আগের যুগে নারীরা পারিবারিক কলহ বা চাপের মুখেও অনেক কিছু সহ্য করে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষিত নারীরা বিচ্ছেদপরবর্তী জীবন নির্বাহে সমস্যা না থাকার কারণে বা কর্মস্থলের সুযোগ থাকার কারণে পারিবারিক কলহ বা অত্যাচার সহ্য না করে বিয়েবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। শহরে ডিভোর্সের মধ্যে নারীরা এগিয়ে থাকলেও সেটা সারাদেশের চিত্র এক নয়। বাস্তবে বিয়েবিচ্ছেদের হার আরও বেশি। কারণ অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার রয়েছে যাদের বিচ্ছেদ পারিবারিক সালিশের মাধ্যমে ঘটে থাকে- যার হিসাব সিটি করপোরেশনে কিংবা কোথাও দালিলিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকে না। প্রান্তিক পর্যায়ে আগে নারীরা জানতেনই না যে তারা তালাক দিতে পারেন। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করতেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারীরা বর্তমানে ঝুঁকিতে আছেন। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি হাজারে ১০.৮ শতাংশ নারী বিয়েবিচ্ছেদ করেছেন। এর বিপরীতে প্রতি হাজারে ১.৫ শতাংশ পুরুষ বিচ্ছেদ করেছেন। মাসে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ৮৪৩টিরও বেশি পরিবার। এর মধ্যে বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। হিসাব অনুযায়ী, তালাক নোটিশ প্রেরণকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যার মধ্যে অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারীর সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশে বিয়েবিচ্ছেদের কারণ জানার পদ্ধতিটিও ত্রম্নটিপূর্ণ। বিস্তারিত কারণ উলেস্নখের সুযোগ থাকলেও নথিবদ্ধকারীরা আবেদনকারীদের নিরুসাহিত করেন। হারিয়ে যায় অসংখ্য আসল রহস্য ও গভীর কারণ। অশিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখন প্রস্তুত নন অধিকাংশ ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে চান, কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরিজীবন, তার ব্যক্তিস্বাধীনতা, তাকে কিছু বিষয়ে সহযোগিতা করা এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়ে গেছে। পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদও করছে। স্বামী অথবা পরিবার কর্তৃক শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। নারীর ক্ষমতায়নের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়েও উপার্জনক্ষম নারী বাড়ছে। অর্থনৈতিক মুক্তি শুধু কারণ নয়, আদর্শিক চিন্তার পরিবর্তনও একটা বড় কারণ। এজন্য নারীরা সাহস করে তালাক দিতে পারছে।

অন্যদিকে, ছেলেদের শিক্ষার হার বেশি হলেও তাদের সঠিক সামাজিকীকরণ না হওয়ার কারণে তারা গতানুগতিক পুরনো সংসারের ধ্যানধারণা লালন করেন। তাদের পরিবারের নারী সদস্যরা যেভাবে শ্বশুরবাড়ির এবং স্বামীর সব সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে সংসারে টিকে থাকতেন, ঠিক তেমনিভাবে এ প্রজন্মের মেয়েটির কাছেও সেটি প্রত্যাশা করেন পুরুষরা। পরিবারের সাবেক সদস্যরাও নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতা মেনে নিতে চান না। শুরু হয় পারিবারিক কলহ এবং অশান্তি। আবার অনেক সময় শিক্ষিত মেয়েরাও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কারণে অহংকার প্রকাশ করে ত্যাগ বা আপস করতে চান না। এজন্য অশিক্ষিত নারীদের থেকে শিক্ষিত নারীদের বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি। ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি শীর্ষক সাময়িকীতে প্রকাশিত এক পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় ১ হাজার ৯০০ জন তালাকপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে জরিপ চালানো হয়। সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায়, তালাক বা বিচ্ছেদের ঠিক পরপরই এই মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকটা নিচে নেমে যায়। বাবা-মার বিচ্ছেদের পর শিশুদের মানসিক অবস্থারও অবনতি দেখা যায় ব্যাপকভাবে। কোনো কাগজপত্রের ওপর বিবেচনা করে বিয়েবিচ্ছেদের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারে যেমন পরিবর্তন এসেছে আমাদের চিন্তাধারাও সেভাবে পরিবর্তন করতে হবে। প্রত্যেকের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে, একে অপরের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হবে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মতামতের গুরুত্ব প্রদান ও প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে পরিবারের শান্তি নিশ্চিত করতে পরিবারের সব সদস্যকে সচেতন হতে হবে। ফ্যামিলি কাউন্সেলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু সমস্যা সমাধান না করে ভালোবাসাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও গভীরতাহীন সম্পর্ককে নানা রকম টোটকা প্রয়োগের মাধ্যমে জোরজবরদস্তি টিকিয়ে রাখাও মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে