সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ডও কমাতে পারেনি নারী নির্যাতন

মিজানুর রহমান মিজান
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বর্তমানে খবরের কাগজে নিত্যদিনের খবরে পরিণত হয়েছে নারী হত্যা ও ধর্ষণ। নারীর অবমাননা বা নির্যাতন সমাজে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এমনকি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ধর্ষণের ভয়াবহ বার্তা ভেসে আসে। সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে প্রায়ই নারীদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন? ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ- যা ভয়াবহ বলে উলেস্নখ করেছে সংস্থাটি ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী?

২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে? আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী? বাংলাদেশে গণধর্ষণের ঘটনাও অহরহ ঘটে থাকে। বাংলাদেশে এক লাখ নারীর মধ্যে ১০ জনের মতো গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাস্তব সংখ্যাটা হয়ত এর থেকে কয়েক গুণ বেশি। কারণ, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানিতে ভুক্তভোগী অনেক পরিবার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিংবা অপরাধী কর্তৃক নির্যাতনের ভয়ে ঘটনা চেপে রাখে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০২০ সালের মোট ৩৪৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭৪ জন ধর্ষণ, ২৩৬ জন গণধর্ষণ এবং ৩৩ জন ধর্ষণের পর হত্যা ও তিনজন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যাসহ মোট ১৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এ ছাড়া ২০০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ৪৩ জন। ৭৪ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসিড দগ্ধের শিকার হয়েছে ২৫ জন, এর মধ্যে এসিড দগ্ধের কারণে মৃতু্য চারজন। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে ২৯ জন, এর মধ্যে ১৩ জনের মৃতু্য হয়েছে। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৫৯ জন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১২৫ জন। পাচারের শিকার হয়েছে ১০১ জন তন্মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি চারজন। বিভিন্ন কারণে ৪৬৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ৩৫ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতন হয়েছে ১১৭ জন, তন্মধ্যে ৫২ জন যৌতুকের কারণে হত্যা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫৯ জন।

বিভিন্ন নির্যাতনে শিকার হয়েছেন ১৬৪ জন। ২৫২ জন নারী ও কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃতু্য হয়েছে। বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১১৭টি। পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম অপরাধের শিকার হয়েছেন ৪৩ জন নারী। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০২১ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর মোট তিন হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ২৩৫ জন, তন্মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন সাতজন।

বর্তমান সমাজে এক অন্যতম সমস্যা হলো- পর্নোগ্রাফির বিস্তার ঘটছে। প্রতিদিন কী পরিমাণ ধর্ষণ হচ্ছে বাংলাদেশে, সেটা আমরা জানি? সব থাকতেও সিস্টেমের অভাবে কিছুই মনিটর করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জঘন্য ঘটনা প্রবাহ বয়ে চলেছে যেমন সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, স্যাটেলাইটের নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রসার ইত্যাদি। ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটে কোন সাইটে কী দেখছে, বাবা-মায়েরা কী সেদিকে নজর রাখছেন? কারণ পুরো বিষয়টিই সবার কাছে নতুন। সমাজে যা করতে নিষেধ করা হয়, সেটার প্রতি আগ্রহ বেশি, বিশেষ করে শিশুদের। সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন-দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। এর সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। এসব কারণে আমাদের দেশে নারী শিশু ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ছাড়াও ৯৩ জন কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৪ জন কন্যাশিশুসহ ৩৩ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে। ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ৯৫ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। পাঁচজন কন্যাশিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে ২২ জন, তন্মধ্যে এসিডদগ্ধের কারণে চারজনের মৃতু্য হয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০ পাস হয়েছে। পাস হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে 'ধর্ষিতা' শব্দটি পরিবর্তন করে 'ধর্ষণের শিকার' শব্দ বসানো হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন প্রতিমন্ত্রী। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি বিলটি চূড়ান্ত করে ২০২০ সালে ১৬ নভেম্বর সংসদে উত্থাপন করে। তবে ধর্ষণের শাস্তি মৃতু্যদন্ড করেও কমানো যাচ্ছে না ধর্ষণের হার।

নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে যাচ্ছে। নারীদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ যেন নারীদের প্রতি নির্যাতন করার সাহস না করে। সর্বোপরি প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের সবাইকে এই সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে