শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি শৈশব কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন

কিছু অভিভাবক আছেন যারা তাদের বাচ্চাদের খুব বেশি সময় দেন না। তারা সারাদিন ইন্টারনেট বা বিভিন্ন সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ আছেন যারা শিশুর হাতে ফোন ধরিয়ে দেন। যাতে শিশুটি দুষ্টুমির বদলে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শিশুটিও সেটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলে, এমনকি বিভিন্ন বিপজ্জনক সাইটে ঢুকে নানা রকম অসুস্থ ভিডিও দেখে। ফলে নিজের অজান্তেই শিশুটি অসুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে
সানজিদা ইয়াসমিন লিজা
  ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদে সমাজের সর্ব শ্রেণির ও পেশার মানুষের হাতে মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি। আমরা জানি, প্রত্যেকটা জিনিসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। তবে বর্তমানে শিশুরা যে হারে মোবাইল ব্যবহার করছে এতে দিন দিন তারা মানুষরূপী রোবট হয়ে উঠছে।

শৈশব প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে এমন এক মুহূর্ত যার স্মৃতি বাকি জীবন সবাই বহন করে।

শৈশবে শিশুদের কাজই হচ্ছে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করা, হইচই করা, ঘোরাঘুরি করা, হাসি, আনন্দ, ঝগড়া ইত্যাদি।

এ সময় জীবন থাকে শুধুই হাসি আর আনন্দের কারণ তখন কারও মনে নাগরিকজীবনের ব্যস্ততা থাকে না। আমাদের আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগের সময়ের সবার শৈশব এমনই ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বর্তমানে শিশুরা মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের পর্দায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। যে সময়ে তারা মাঠে গিয়ে খেলবে, সেই সময়ে তারা মোবাইলে বিভিন্ন ধরনের গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আবার ঠিক যখন তারা বন্ধুদের সাথে ঘুরবে, আড্ডা দেবে, একে অন্যের খোঁজ-খবর নেবে তখন তারা মোবাইল, ইন্টারনেট নিয়ে এত ব্যস্ত যে এসবের আর সময় হয়ে ওঠে না। তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে ঠিকই কিন্তু সেটা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেমন- ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটারে। অর্থাৎ সব কিছুতেই এখন কৃত্রিমতা চলে এসেছে।

মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দায় তারা নিজেকে আবদ্ধ রাখার কারণে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা, সামাজিকীকরণ, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার সব কিছুতেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

আবার মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ও কম্পিউটারের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের চোখের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

একটা কথা না বললেই নয়, বাচ্চারা এ মাত্রাতিরিক্ত ফোন ব্যবহার ও এর প্রতি আসক্ত হওয়ার পেছনে অভিভাবকদের যথেষ্ট বড় ভূমিকা রয়েছে। বাবা-মায়েরা খেলাচ্ছলে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন। বাচ্চারা মোবাইল পেয়ে মোবাইলের বিভিন্ন বিষয় খুঁজে বের করে। এতে পিতা-মাতা খুব গর্ববোধ করে এভারেস্ট জয়ের হাসি দেন এটা ভেবে যে তাদের সন্তান পারে, যা সন্তানকে আরও অনেকগুণ বেশি অনুপ্রাণিত করে ফোন ব্যবহার করতে। আবার অনেক বাচ্চাদের ফোন বা কম্পিউটারের সামনে না বসালে খেতে চায় না।

আবার কিছু অভিভাবক আছেন যারা তাদের বাচ্চাদের খুব বেশি সময় দেন না। তারা সারাদিন ইন্টারনেট বা বিভিন্ন সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন যার ফলে বাচ্চাদের কোনো রকম একটা ফোন হাতে ধরিয়ে দেন যাতে বাচ্চা দুষ্টুমি না করে। আর বাচ্চাও সেটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলে, এমনকি বিভিন্ন বিপজ্জনক সাইটে ঢুকে নানা রকম অসুস্থ ভিডিও দেখে অসুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু আফসোস সেই অভিভাবকরা কখনো খোঁজ নেন না যে, তাদের সন্তান ফোন দিয়ে কি করছে না করছে!

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা এক মিনিট মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। ওই গবেষণায় আরও দাবি করা হয়, যেসব বাচ্চারা দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তাদের বুদ্ধির বিকাশ সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে কম হয়। এমনকি ১১ বছর বয়সি প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন মোবাইল ফোন নিয়মিত ব্যবহার করে।

আবার বিভিন্ন শিশুবিশেষজ্ঞদের মতে, ৩ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয় এমনকি বাচ্চারা দেরিতে কথা বলাসহ আরও অনেক জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উই আর সোশ্যাল ও হুট সু্যট নামক প্রতিষ্ঠানের করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয় ভারত ও তার আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক। কারণ যেখানে চীনের মতো প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রে শিশুরা দৈনিক মাত্র ২ ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ব্যয় করে সেখানে ভারত ও তার আশপাশের দেশ মানে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশে শিশুরা দিনে গড়ে ৬ ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ব্যয় করে।

তবে আরেকটা বিষয় অবশ্যই মানতে হবে, নগরজীবন আমাদের সম্পর্কগুলোকে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর করছে।

বিষয়টি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা বাচ্চাদের প্রাকৃতিকভাবে তাদের শৈশবকাল অতিবাহিত করা থেকে বিরত রেখে আধুনিকতার নামে তাদের দিন দিন কৃত্রিম বানিয়ে মানুষ থেকে রোবটে পরিণত করছি।

বাচ্চাদের সময় পার করা ও বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে আমরা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি মোবাইল ফোন। অথচ আমাদের উচিত ছিল তাদের খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া, সামাজিকীকরণের জন্য সমাজের সবার সাথে মেশা ও বিনোদনের জন্য ঘোরাঘুরি করার সুযোগ করে দেয়া। অন্যদিকে তাদের হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে পাঠ্যাভাসে অভ্যস্ত করে তোলাও আমাদের কর্তব্য ছিল। যা তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করত।

তাই যেদিন এসবই সম্ভব হবে সেদিনই কেবল বাচ্চারা তাদের সোনালি অতীতে ফিরে গিয়ে কৃত্রিমতামুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে। আজকের এ সংকটময় মুহূর্তে অভিভাবকদের সচেতনতা খুব বেশি প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে