দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্স কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের খসড়া নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। এটি প্রকাশের পর পরই অংশীজনদের পক্ষ থেকে প্রথমে আপত্তি ওঠে। এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে টেলিকম খাতের স্থানীয় উদ্যোগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
অন্যদিকে, সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, গ্রাহকের ভয়েস কল ও ডাটার খরচ কমানোর জন্যই নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। অতীতে বহুস্তরের লাইসেন্স কাঠামোর সুবিধা নিয়ে যারা লাভবান হয়েছেন তারাই মূলত এর বিরোধিতা করছেন।
মূলত সরকার এবং অংশীজনদের পরস্পরবিরোধী বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার কারণে ‘টেলিকম নীতিমালা’ নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে।
সরকারের দাবি, দেশকে একটি আধুনিক, প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই ডিজিটাল টেলিযোগাযোগ খাতে রূপান্তরের লক্ষ্যে নতুন টেলিকম নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রেজিম রিফর্ম পলিসি-২০২৫-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
জটিল ও পুরনো লাইসেন্সিং কাঠামো সরলীকরণ; উদ্ভাবন, বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা; সাশ্রয়ী মূল্যে ও গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত; টেকসই ও নিরাপদ ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলা এর মূল্য উদ্দেশ্য।
খসড়ায় তাই টেলিকম খাতের লাইসেন্স কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে সেলুলার মোবাইল সার্ভিস ও ফিক্সড টেলিকম সার্ভিসের জন্য পৃথক একটি অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার (এএনএসপি) লাইসেন্স দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এএনএসপিগুলো গ্রাহক পর্যায়েও সেবা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে অবকাঠামো ও ট্রান্সমিশন সেবা যেমন ফাইবার, টাওয়ার ও নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন পরিচালনার জন্য ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (এনআইসিএসপি) লাইসেন্স দেয়া হবে।
আন্তর্জাতিক ভয়েস, ইন্টারনেট ও ডাটা সংযোগের জন্য নিতে হবে ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (আইসিএসপি) লাইসেন্স। স্যাটেলাইট, নন-টিরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্কস (এনটিএন) ও হাই-অলটিটিউড প্লাটফর্মস (এইচএপি) ভিত্তিক সেবার জন্য নন-টিরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্কস অ্যান্ড সার্ভিস প্রোভাইডার (এনটিএনএসপি) লাইসেন্স নিতে হবে।
তাছাড়া এসএমএস এগ্রিগেটর, ওটিটি ইত্যাদি সেবার জন্য টেলিকম এনাবলড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে। নতুন এ পলিসি কার্যকর হওয়ার পর আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স, এনআইএক্স, এমএনপি লাইসেন্সগুলো ধীরে ধীরে বাতিল হয়ে যাবে।
এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করতে হলে ২০২৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নতুন কাঠামো অনুসারে লাইসেন্স নিতে হবে।
কিন্তু খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ পলিসি বাস্তবায়ন হলে দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানকারী ২৩টি আইজিডব্লিউ এবং আন্তঃঅপারেটর সেবাদানকারী ২৪টি আইসিএক্স প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অথচ আইসিএক্স অপারেটররা তাদের আয়ের অর্ধেকই সরকারকে দেয়। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকার রাজস্বও পায়। নতুন পলিসি অনুসারে এটি স্থানান্তরিত হয়ে চলে যাবে মোবাইল অপারেটরদের কাছে।
এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাবে স্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাও। কর্মহীন হয়ে পড়বে কয়েক লাখ লোক। তাছাড়া টেলিকম খাতে ঘন ঘন নীতিমালা পরিবর্তন এ খাতের জন্য সহায়ক নয় বলেও মনে করছেন তারা।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, ‘আইএসপিদের জন্য প্রথম নীতিমালা করা হয় ২০২১ সালে, যেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে ২০২২ সালে।
সেই নীতিমালার আলোকে আমরা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও কৌশল গুছিয়ে নিয়েছি। এখন ২০২৫ সালে এসে আবার আরেকটি নীতিমালার কথা বলা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি সামনের বছর একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। তখন যে আরেকটি নীতিমালা করা হবে না, তা কে বলতে পারে?’
টেলিযোগাযোগ খাতের ব্যবসা উৎপাদন খাতের মতো নয় মন্তব্য করে আইএসপিএবি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। ফলে ঘন ঘন নীতিমালার পরিবর্তন আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। আমরা যারা ফিক্সড টেলিকম অপারেটর রয়েছি তারা সবাই স্থানীয় উদ্যোক্তা এবং এর ৯৫ শতাংশই আবার ছোট উদ্যোক্তা।’
তিনি বলেন, ‘লাস্ট মাইলটা কোনো কোনো জায়গায় বলা হচ্ছে যে টেলিকম অপারেটর দেবে না, আবার কোনো জায়গায় বলা হচ্ছে সেলুলার অপারেটর আইটিও স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করবে। আজকে যে আইটিও স্ট্যান্ডার্ড আছে সেটি আগামী বছর নাও থাকতে পারে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘তার মানে আমার বিজনেস ডোমেইন তার হাতে চলে যেতে পারে। এখানে আমরা কোনো উন্মুক্ত নীতিমালা চাইছি না। বরং সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে যে লাস্ট মাইল ফাইবার অপটিকসে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড অপারেটর দেবে এবং লাস্ট মাইল ওয়্যারলেসে টেলিকম অপারেটর দেবে।’
টেলিকম পলিসির খসড়া প্রকাশ হওয়ার পরই এ বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানায় অ্যাসোসিয়েশন অব আইসিএক্স অপারেটরস অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির মতে, এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ খাতের সহস্রাধিক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
সংগঠনটি মনে করে, বিদ্যমান আইএলডিটিএস নীতিমালার আওতায় গড়ে ওঠা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত টিকে থাকতে পারবে না। প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ মূলত বিদেশী বড় কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে। যার ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে বিদেশী কোম্পানিগুলোর নির্ভরতা কমানোর আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
নীতিমালাটি প্রথমে এ বছরের এপ্রিলে প্রকাশ করা হয়। এরপর অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে এতে আরও পরিবর্তন করা হয়েছে। শিগগিরই সরকারের পক্ষ থেকে একটি চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করার কথা রয়েছে। তাছাড়া এটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে আরো পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা।
তবে খসড়া নীতিমালায় বেশকিছু গুরুতর সমস্যা থাকায় এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে একতরফাভাবে এটি বাস্তবায়ন না করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের বিষয়ে মতামত দিচ্ছে এটিকে স্বাগত জানাই। তবে দলগুলোর নীতিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছিল কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মতামত দেননি। সম্ভবত কোনো গোষ্ঠী প্রভাবিত করে বিএনপি মহাসচিবকে দিয়ে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কম।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমরা বিদেশী বিনিয়োগ উন্মুক্ত করার পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরও সুরক্ষা দিতে চাইছি। আইটিও এবং জিএসএমএ ২০১৪-১৫ সালের দিকে স্টাডি করে বলেছিল যে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বহুস্তর লাইসেন্স কাঠামো রয়েছে, সেটি এ খাতের বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ও ভয়েস কলের দাম কমানো যাচ্ছে না, কারণ লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় স্তর রয়েছে। এ স্তরগুলো তেমন কোনো মূল্য সংযোজন না করে বাজার থেকে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে ভয়েস ও ডাটা কলের দাম বেশি হচ্ছে।’
টেলিকম খাতের খসড়া নীতিমালা নিয়ে করা জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘টেলিকম খাতের পলিসি নির্ধারণে সরকার তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গ্রামীণ জনগণের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা টেলিকম খাতের টেকসই উন্নয়নে বাধা হতে পারে।’
খসড়া নীতিমালাটি বিশ্লেষণ করে কিছু গুরুতর সমস্যা পাওয়া গেছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘টেলিকম খাতে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়নে বাধা হতে পারে এ নীতিমালা। এটা ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাই, এ গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা যেন পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হয়।’
খসড়া নীতিমালার সম্ভাব্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের দিক তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একাধিক সেবা খাতে মালিকানা রাখার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বড় মোবাইল অপারেটররা একাধিক খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়বে।’
নীতিতে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড বা নতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে নীতিতে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, যা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এন্টারপ্রাইজ সার্ভিসের সীমা অস্পষ্ট। মোবাইল অপারেটরদের ফাইবারভিত্তিক ব্যবসা সংযোগ সেবার সীমাবদ্ধতা কোথায়, তা নীতিমালায় স্পষ্ট নয়। ফলে বিবাদ ও অসাম্য তৈরি হতে পারে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সবার জন্য উপকার বয়ে আনে এমন নীতিই গ্রহণযোগ্য। ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন এবং জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারেই আমরা কাজ করে যাব।’
এ নীতিমালা প্রণয়নে সরকার কারো মতামত নেয়নি বলেও সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান।