সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যায়নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ

যাযাদি রিপোর্ট
  ৩০ মার্চ ২০২৪, ১১:৪৩
প্রতিকী ছবি

আরবি শব্দ ‘আদল’-এর অর্থ হচ্ছে ভারসাম্য রক্ষা করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ব্যক্তি ও মানব জীবনের সব শাখায় শরিয়তসম্মত জীবন বিধানে যার যে হক বা পাওনা- তা আদায়ের সুব্যবস্থা করা সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডকে ‘আদল’ বলা হয়। অত্যাচারের প্রতিবিধান এবং বিচারে ন্যায়ের মানদণ্ড এমনভাবে ধারণ করা, যাতে পক্ষদ্বয়ের কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না হয়, এটাও আদল। বস্তুত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কথাবার্তা, কাজকর্ম আচার-আচরণ, ন্যায়-নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ। যেহেতু ইসলাম ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। তাই আদল-ই হলো ন্যায়বিচারের একমাত্র উপায়। আর ন্যায়নীতি অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদনা করাই হলো ইনসাফ; এর বিপরীত হলো বে-ইনসাফ।

সামাজিক জীবনে আদল বা ন্যায়বিচার তথা ন্যায়নীতি ইসলামের এক অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মহান আল্লাহ যেমন আদিল বা ন্যায়বিচারক, তেমনি মানবজাতিকে তাদের সামগ্রিক জীবনে তিনি আদল প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ দিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সঙ্গে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদণ্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। (সূরা হাদীদ : ২৫) অর্থাৎ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়ের ওপরই কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার ওপর আকাশ ও জমিন আপন স্থানে স্থির রয়েছে।

ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি কারো মনোভূত না-ও হয় তবুও তা হতে বিরত থাকা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ (সূরা নিসা : ১৩৫)

সুতরাং হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে। যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়।

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা মায়েদা :৮)

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে কোনো বিচার-ফয়সালা কর, তখন ইনসাফভিত্তিক ফয়সালা কর। আল্লাহতায়ালা তোমাদের সদুপদেশ দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা শোনেন এবং দেখেন। (সূরা আন নসা :৫৮) অন্য সূরায় মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ন্যায়বিচার, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অপছন্দনীয় কাজ এবং অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। (সূরা আন নহল :৯০) যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারাই কাফের। (সূরা আল-মায়িদাহ :৪৪)

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : নিশ্চয়ই যারা ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করে আল্লাহর কাছে তারা নূরের মিম্বরে আসন গ্রহণ করবে। তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তাদের বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং যেসব দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয়, সেসব বিষয়ে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার করে। (সহিহ মুসলিম)

ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, যে সমাজে মানুষ ইনসাফ ও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়, সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। ক্ষুধাপীড়িত মানুষ বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। ধর্ম-বর্ণ-দল-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষ যখন তার অধিকার বুঝে পায় না, তখন অধিকারের জন্য সে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। প্রাপ্য অধিকার যখন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন সমাজে এর নানা উপসর্গ দেখা দেয়। চূড়ান্ত বিবেচনায় তা কারো জন্য কল্যাণকর হয় না। তাই ইসলাম ইনসাফ ও সাম্যের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

বিদায় হজের ভাষণে ও মদিনা সনদে বিশ্বনবী (সা.) মানবাধিকারের যে বাস্তবোচিত সনদ ঘোষণা করেন, তা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রায়োগিক প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এটি পর্যালোচনা করলে প্রমাণিত হয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অবদান যুগান্তকারী ও অবিসংবাদিত। এর পাশাপাশি মদিনার সমাজে সাম্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, প্রতিদান, অঙ্গীকার রক্ষা, সততা, আমানতদারী, সদ্ব্যবহার, সদাচার, আত্মত্যাগ, পরোপকার, সৌজন্য প্রদর্শন ও সুকুমার চর্চার এক অনুপম আদর্শ স্থাপিত হয়। বিদায় হজের ভাষণে বংশমর্যাদা, বিত্ত-বৈভব আর গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধির প্রচলিত ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি সর্বমানবিক সমতা ও সমঅধিকারের অভূতপূর্ব সনদ ঘোষণা করেন। সেই ভাষণের ছত্রে ছত্রে এর সত্যতা প্রস্ফুটিত হয়।

ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণের পর প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে দুর্বলতম ব্যক্তিও আমার কাছে সবল, যদি সে ন্যায়সংগত অবস্থানে থাকে। আর তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রভাবশালী ও শক্তিমান ব্যক্তিকেও আমি আইনের প্রশ্নে, অন্যের অধিকারের প্রশ্নে ছাড় দেব না।’

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে