মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস একটি ঐতিহাসিক দিন। বিশ্বকে যারা দিনরাত শ্রম দিয়ে সচল রেখেছে, তাদের সম্মানার্থে এই দিবসটি পালন করা হয়। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দিবসের সূচনা হয়।
মহান মে দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে স্পষ্ট কারণ,মূলত কর্মঘণ্টা কমানো, কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি পূরণ করেনি; বরং যখনই শ্রমিকরা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, তখনই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় জুতা কারখানার শ্রমিকরা ২০ ঘণ্টার পরিবর্তে কম কর্মঘণ্টার দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে। ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে বহুবার আন্দোলন হলেও মালিকপক্ষ তাদের দাবি মানেনি। ১৮২৭ সালে দৈনিক ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৮৫০-১৮৬৬ সালের মধ্যে আরও অনেক ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। সবাই মিলে গঠন করে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’, যারা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৮৮৪ সালে ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোতে বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের ডাকে সকল স্তরের শ্রমিক মাঠে নেমে আসে এবং আট ঘণ্টার দাবির আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ৩ মে ম্যাককর্মিক ফসল কাটার কারখানায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়, এতে ৪ জন শ্রমিক নিহত ও অসংখ্য আহত হন। ৪ মে হে মার্কেটে এই হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বোমা বিস্ফোরণে পুলিশ ও শ্রমিক নিহত ও আহত হন।
এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবি মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ৮ শ্রমিককে ‘নৈরাজ্যকারী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অগাস্ট স্পাইস, আলবার্ট পারসন্স, জর্জ এঙ্গেল, এডলফ ফিশারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তারা হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় সেই মহান বীরদের স্মরণ করি।
মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে ২য় আন্তর্জাতিক (Second International) সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ১ মে দিনটিকে শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলায় প্রথম মে দিবস পালন করা হয় ১৯২৭ সালে কলকাতায়। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে মে দিবস পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার মে দিবসকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে।
কিন্তু বাস্তবে যাদের নিয়ে মে দিবস পালিত হয়, তারাই আজও এই দিবস পালন করার সুযোগ পান না। দেখা যায়, মে দিবসেও অসংখ্য শ্রমিক কাজ করতে বাধ্য হন, কারণ একদিন কাজ না করলে তাদের পরিবারের আহার জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে। মে দিবস আসে-যায়, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভাগ্য তেমন পরিবর্তিত হয় না।
শ্রমিক সমাজ আজও অবহেলিত ও নিষ্পেষিত। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে খাতায়-কলমে অধিকার অর্জিত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা হয়, তারা আজও মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আজকের গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতির পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা।
পণ্য উৎপাদনের চারটি উপাদান—ভূমি, শ্রম, মূলধন ও উদ্যোক্তা। এর মধ্যে ‘শ্রম’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে অন্যান্য উপাদানসমূহের সমন্বয়ে পণ্য উৎপাদন করে। শ্রমিক ছাড়া কোনো পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। অথচ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার। BGMEA-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ, যেখানে নারীর সংখ্যা বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন শহরে অসংখ্য পোশাক কারখানা রয়েছে।
এই শ্রমিকরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন—স্বল্প মজুরি, অধিক কর্মঘণ্টা, অনিরাপদ কর্মস্থল, যৌন হয়রানি, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া, বিশ্রামের সুযোগ না থাকা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার দায়ভার অস্বীকার, চাকরির স্থায়িত্বের অভাব ইত্যাদি।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে ১১৪ জন শ্রমিক নিহত ও অসংখ্য আহত হন। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই গার্মেন্টস ভবনে অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, জরুরি বহির্গমণ পথের সংকট এবং অগ্নি-সুরক্ষা আইন না মানা এই দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনার আগে ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছিল, তবুও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। এতে ১১৩৪ জন শ্রমিক নিহত ও অসংখ্য আহত হন। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি, কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে যে নিয়ম আছে, তা যথাযথভাবে মানা হলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। সরকার ও মালিকপক্ষকে অবশ্যই শ্রম আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাজরীন ও রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শান্তি প্রার্থনা করছি—আমিন।
চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্পেও বহু শ্রমিক কাজ করেন। কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রায় সময় দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হন। তাই তাদের অধিক মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।
সরকারি চাকরির কিছু পদ—যেমন পুলিশ, কারারক্ষী, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিম্নশ্রেণির কর্মীরা—শ্রমিক না হলেও তাদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। আইএলও কনভেনশন অনুসারে এটি অবৈধ ও অমানবিক। এতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
১৮৮৬ সালে যেসব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকরা রক্ত দিয়েছিলেন, সেসব সমস্যার অনেকগুলো আজও রয়ে গেছে। দেশের শ্রম আইন কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নেই।
চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থাও করুণ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চা শিল্পে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৬৩ হাজার শ্রমিক রয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা, সেটাও সবার জন্য নয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় এটি অত্যন্ত অপ্রতুল। এছাড়া অতিরিক্ত সময় কাজ করলেও তারা মজুরি পান না। বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, শিক্ষা, যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা, চাকরির স্থায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে তারা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
আমরা যখন শ্রমিক নিয়ে কথা বলি, তখন কেবল অভ্যন্তরীণ শ্রমিকদের কথাই বলি। অথচ প্রবাসী শ্রমিকরাও দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখেন। Bureau of Manpower, Employment and Training-এর তথ্যানুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ৩৩ লাখের বেশি। দেশের অর্থনীতি যখনই চাপে পড়ে, তখন তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে সচল রাখে। তবে প্রবাসী শ্রমিকদেরও নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়—পাসপোর্ট তৈরিতে হয়রানি, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, এয়ারপোর্টে হয়রানি, দূতাবাসের অসহযোগিতা ইত্যাদি। কর্মক্ষেত্রে স্বল্প মজুরি, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অধিক সময় কাজ করা, মৃত্যু হলে মরদেহ দেশে আনার জটিলতা, এসবই বাস্তবতা।
রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রবাসী শ্রমিক সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, মালয়েশিয়া, কাতার ও সিঙ্গাপুরে কর্মরত। এসব দেশে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে কাজ করছেন, ফলে নানাবিধ সমস্যা ও শোষণের শিকার হচ্ছেন। বৈধতা না থাকায় তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বাধ্য হন, ফলে বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমে যায়।
সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দেয়, তাহলে শ্রমিকরা যেমন সুরক্ষা ও ন্যায্যতা পাবে, তেমনি বৈদেশিক আয় বহুগুণে বাড়বে।
বর্তমান সরকার পাসপোর্ট প্রক্রিয়া সহজ করেছে, এজন্য ধন্যবাদ জানাই। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এই মহান মে দিবসে, একজন প্রবাসী শ্রমিকের সন্তান হিসেবে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই—দেশের সকল শ্রমিক যেন তাদের অধিকার নিয়ে নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে কাজ করতে পারে এবং বিশেষভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কার্যকর ও মানবিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
লেখক : শিক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়