সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
মোদিকে নিয়ে তথ্যচিত্র

বিবিসির দিলিস্ন-মুম্বাই কার্যালয়ে অভিযান

ম তলস্নাশি শেষে ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ, দুই কার্যালয় সিলগালা ভারতের আয়কর দপ্তরের ম মোদি সরকার যে সমালোচনাকে ভয় পায়, এই ঘটনা সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে :কংগ্রেসসহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল
যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) দিলিস্ন ও মুম্বাই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছেন ভারতের আয়কর দপ্তরের কর্মকর্তারা। দুই কার্যালয় থেকে ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ করেছেন তারা। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকালের দিকে এই তলস্নাশি অভিযান চালানো হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে সমালোচনামূলক একটি তথ্যচিত্র প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পরেই তলস্নাশির এই ঘটনা ঘটল। সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে সরকারি আয়কর কর্মকর্তাদের তলস্নাশির এই ঘটনায় দেশটির বিরোধী রাজনীতিকরা তীব্র সমালোচনা করেছেন। সংবাদসূত্র : বিবিসি, এনডিটিভি

গত ২৪ জানুয়ারি বিবিসির বিবিসি ভারতের গুজরাট দাঙ্গায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে 'ইনডিয়া : দ্য মোদি কোয়েশ্চেন' নামের একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা ঘিরে ওই তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এই তথ্যচিত্র প্রকাশের পর ভারতে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। চলমান এই বিতর্কের মাঝেই বিবিসির ভারতীয় দুই কার্যালয়ে অভিযান চালালেন আয়কর দপ্তরের কর্মকর্তারা।

তলস্নাশি চালানোর পর উভয় কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছেন আয়কর কর্মকর্তারা। বিবিসি দিলিস্ন ও মুম্বাই শাখার সংবাদকর্মীদের তারা জানিয়েছেন, বিবিসির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কর ও তথ্য স্থানান্তর মূল্যে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার জেরেই মঙ্গলবার এই তলস্নাশি চালিয়েছে আয়কর দপ্তর। দুই অফিসে থাকা সাংবাদিকদের ফোন এবং ল্যাপটপও জব্দ করে নিয়ে গেছেন আয়কর কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের তারা নির্দেশ দিয়েছেন- তারা যেন নিজেদের মধ্যে ফোনে যোগাযোগ না করেন।

কর্মকর্তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের সংবাদমাধ্যম 'এনডিটিভি'কে বলেন, 'কিছু ব্যাপারে অস্পষ্টতা ছিল। সেসব দূরনিরীক্ষার জন্য আমরা এখানে এসেছি। বিবিসির ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আমরা খতিয়ে দেখব। এটা কোনো তলস্নাশি নয়।'

এদিকে, আয়কর দপ্তরের তলস্নাশির পর বিবিসি দিলিস্ন ও মুম্বাই শাখার সাংবাদিকদের উদ্দেশে লিখিত বার্তা দিয়েছে বিবিসি লন্ডনের মূল কার্যালয়। সেই বার্তায় সংবাদকর্মীদের সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় না জড়াতে ও ভীত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বিবিসি হেডকোয়ার্টার। বার্তায় হেডকোয়ার্টার বলেছে, 'আমরা বিবিসি ভারতের দিলিস্ন ও মুম্বাইসহ অন্যান্য শাখার কার্যালয়ের কর্মীদের অনুরোধ করছি, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না এবং সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়াবেন না। পুরো পরিস্থিতি আমরা সামাল দিচ্ছি।' বিবিসি জানিয়েছে, তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে 'পূর্ণ সহযোগিতা' করছে। সংক্ষিপ্ত একটি বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, 'আমরা আশা করছি, যত দ্রম্নত সম্ভব এই পরিস্থিতির সমাধান হয়ে যাবে।'

'ইনডিয়া : দ্য মোদি কোয়েশ্চেন' তথ্যচিত্রটি যদিও শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু ভারতে সেটির অনলাইনে প্রচার বা শেয়ারিং বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটির সরকার। ভারত সরকারের বক্তব্য, তথ্যচিত্রটি 'ঔপনিবেশিক মানসিকতায়' তৈরি 'ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা ও আবর্জনা'। গত মাসে ওই তথ্যচিত্রটি দেখার জন্য জড়ো হওয়া একদল শিক্ষার্থীকে আটক করেছিল দিলিস্নর পুলিশ।

বিবিসির ওই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছিল, মোদি কীভাবে রাজনীতিতে এসেছিলেন এবং ভারতীয় জনতা পার্টিতে কীভাবে ক্রমান্বয়ে ওপরে উঠে পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বিবিসির সংগ্রহ করা একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদন সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল, যেখানে ধর্মীয় দাঙ্গা চলার সময় মোদির কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি রেলে আগুন লাগানোর পর অনেক মানুষ হতাহত হলে ওই দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এরপরের কয়েকদিনের সহিংসতায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন মুসলমান।

এদিকে বিরোধী কংগ্রেস পার্টির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেনুগোপাল বলেছেন, 'মঙ্গলবারের এই তলস্নাশি হতাশা তৈরি করছে এবং মোদি সরকার যে সমালোচনাকে ভয় পায়, সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে।' তিনি টুইট করেছেন, 'আমরা এই ভয় দেখানোর কৌশলকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাই। এই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী মনোভাব আর চলতে পারে না।' কংগ্রেসের প্রচার বিভাগের প্রধান জয়রাম রমেশ কটাক্ষের সুরে বলেন, 'আমরা আদানি ইসু্যতে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি করছি, অথচ সরকার বিবিসির পেছনে পড়ে রয়েছে।' তার মতে, 'এই ঘটনা প্রমাণ করছে, বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ হয়েছে মোদি সরকারের।' তলস্নাশির সমালোচনা করে বিরোধী অন্য দলের নেতারাও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।

ভারতের এডিটরস গিল্ড বলেছে, এই তলস্নাশির ঘটনায় তারা 'গভীরভাবে উদ্বিগ্ন'। এডিটরস গিল্ডের মতে, এসব 'সরকারি নীতি বা সংস্থাগুলোর সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোকে ভয় দেখানো এবং হয়রানি করতে সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার অব্যাহত প্রবণতার অংশ।

তবে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির একজন মুখপাত্র গৌরভ ভাটিয়া বিবিসিকে 'বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, 'ভারত এমন একটি দেশ যা সব সংস্থাকেই সুযোগ দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বিষ ছড়ায়।'

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মোদি সেই সময় 'দায়মুক্তির পরিবেশ' তৈরি করার জন্য 'সরাসরি দায়ী' ছিলেন, যা সহিংসতাকে উসকে দিয়েছিল। তখনকার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র'র নির্দেশে একটি তদন্তের অংশ হিসেবে ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, 'সহিংসতা মাত্রা প্রকাশিত খবরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল' এবং 'দাঙ্গার লক্ষ্য ছিল হিন্দু এলাকাগুলো থেকে মুসলমানদের নির্মূল করা'।

মোদি দীর্ঘদিন ধরেই তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন এবং দাঙ্গার জন্য কখনো ক্ষমা চাননি। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি প্যানেলও বলেছে, তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গত মাসে বিবিসি বলেছে, ভারতের সরকারের কাছে তথ্যচিত্রে তাদের বক্তব্য দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হয়নি। বিবিসি বলেছে, সেখানে 'নিরলস গবেষণা করা হয়েছে' এবং 'অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং বিজেপির লোকজনের প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।'

গত মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে তথ্যচিত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, 'পৃথিবীর কোথাও আমরা নির্যাতনকে সমর্থন করি না।' তবে তিনি আরও যোগ করেছেন, যেভাবে মোদির 'চরিত্রায়ন করা হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি একমত নন'।

ভারতে সরকারের সমালোচনাকারী বিভিন্ন সংস্থাকে লক্ষ্যবস্তু করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০২০ সালে ভারতে কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা অভিযোগ করেছিল, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে 'উইচ-হান্ট' বা প্রতিহিংসামূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে ভারতের সরকার। বেসরকারি আরও কয়েকটি সংস্থার পাশাপাশি গত বছর অক্সফামেও তলস্নাশি চালানো হয়েছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে