সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর

ইচ্ছে হলেই বসতি গাড়ে ইসরাইলিরা

পশ্চিম তীরে থাকে প্রায় ২৫ লাখ ফিলিস্তিনি। যে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন ফিলিস্তিনিরা, সেটি হওয়ার কথা পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখন্ড নিয়ে, আর তার রাজধানী হওয়ার কথা পূর্ব জেরুজালেম। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা পশ্চিম তীরে ১৪০টি বসতি তৈরি করেছে ইসরাইল, যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ ইহুদি বসবাস করে। এসব বসতি নির্মাণ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ কিন্তু ইসরাইল তা মানে না। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যে কোনো শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিতর্কিত একটি ইসু্য হচ্ছে পশ্চিম তীরের এসব ইহুদি বসতি...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের একটি আউটপোস্ট

ইহুদিরা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে একের পর এক বসতি নির্মাণ করছে। এসব বসতি আন্তর্জাতিক আইনে, এমনকি ইসরাইলের আইনেও অবৈধ। তারপরও তারা শুধু বসতি নির্মাণ করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না, তারা আরও চায়। এই জায়গাটিতে যা ঘটছে তা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, অন্তত এই একটি বিষয় নিয়ে কেউই দ্বিমত করবেন না। আর তা হলো- বসন্তকালে এখানকার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। অধিকৃত পশ্চিম তীরের মাঝখানেই এই পাথুরে-পাহাড়ি জায়গাটা বসন্তকালে একেবারে সবুজ হয়ে যায়। তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চড়াই-উতরাই হয়ে চলে গেছে রাস্তাগুলো। পরিষ্কার রৌদ্রজ্জ্বল দিনে এখান থেকে পূর্বদিকে তাকালে দিগন্ত বরাবর জর্ডান উপত্যকার পাহাড়গুলোও দেখা যায়।

কিন্তু এই প্রাকৃতিক দৃশ্য এখন বদলে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনি গ্রাম তুরমুস আইয়া থেকে গাড়িতে মাত্র কয়েক মিনিট দূরের পথ আবু খালেদের খামারবাড়ি। আবু খালেদের বয়স ৬৫। তিনি এখানে আছেন ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। তার বাড়ি থেকে চারপাশে তাকালে পরিবর্তনটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার খামারের চারপাশের উঁচু পাহাড়গুলোর ঢালে এখন দেখা যায় অনেকগুলো ইসরাইলি বসতি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এগুলো অবৈধ। আবু খালেদের খামারবাড়ির চারপাশে যে বসতিগুলো আছে- তার মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সবগুলো, এমনকি ইসরাইলি আইনেও অবৈধ। এগুলোকে বলা হয় 'আউটপোস্ট' এবং ইসরাইল সরকারের অনুমোদন ছাড়াই এগুলো তৈরি হয়েছে।

ভয়ে ঘুমাতে পারেন না আবু খালেদ

আবু খালেদ বলছিলেন, এখানকার ইসরাইলি বাসিন্দারা শুধু এখানে বসতি গেড়েই সন্তুষ্ট নয়। তারা আরও চায়। তারা চায়, আবু খালেদ যেন এখান থেকে চলে যান। আবু খালেদ দেখাচ্ছিলেন, সম্প্রতি তার বাড়ির যে আক্রমণ করা হয়েছে, তার কিছু চিহ্ন। জানালার কাচ ভাঙা, পাথর ছুড়ে ভেঙে দেওয়া সোলার প্যানেল, গাড়ির ক্ষতিসাধন। খালেদ বলেন, 'প্রতি রাতে- সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত আমি ঘুমাই না। আমাদের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিরা, তারাও ঘুমায় না। সর্বক্ষণ তারা আছে ভয়ের মধ্যে।'

বর্তমানে পশ্চিম তীরকে মনে করা হয় এমন একটি জায়গা, যা ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু এখানকার বাসিন্দা ফিলিস্তিনিদের যার সঙ্গেই আমাদের কথা হয়েছে, তাদের সবাই মুখেই শোনা গেছে একই কথা- 'ইসরাইলি সেনারা শুধু বসতি স্থাপনকারীদেরই সাহায্য করে, এমনকি যারা এখানে নানারকম সমস্যা সৃষ্টি করছে তাদেরও।

অস্ত্র হাতে তুলে নিতে প্রস্তুত

প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে কারও মুখেই এই কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে একটা ভালো কথা শোনা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে- কিছুদিন আগে রামালস্না-ভিত্তিক জনমত যাচাইকারী 'খালিদ শিকাকি'র এক জরিপে প্রথমবারের মতো দেখা গেছে, সামান্য ব্যবধানে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি মনে করেন যে, আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ না থাকলেই বরং তারা ভালো থাকতেন।

তুরমুস আইয়া অপেক্ষাকৃত ধনী এলাকা এবং একজন কাউন্সিলর নুসেইবা আল-নিসওয়ান বলছিলেন, এখানকার বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশেরই মার্কিন নাগরিকত্ব আছে। কিন্তু এখানেও লোকজনের সঙ্গে কথা বললে দেখা যায়- তারা মনে করেন, একটা তৃতীয় ইন্তিফাদা বা 'গণঅভু্যত্থান' এখন অবধারিত।

মুহানাদের বয়স এখন ৩১। তিনি যখন টিনএজার ছিলেন, তখন পাথর নিক্ষেপের দায়ে আটক হয়ে কয়েক মাস ইসরাইলের কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি ও তার বন্ধুরা সবাই এখন অস্ত্র হাতে তুলে নিতে প্রস্তুত। মুহানাদ বলেন, 'এখানে কেউ আমাদের সুরক্ষা দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের- যাদের বন্দুক আছে তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। আর এখানে প্রায় সবার কাছেই বন্দুক আছে।'

তবে মুহানাদ বলছিলেন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগেকার ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ডে যে ইসরাইলিরা থাকে, তাদের ওপর আক্রমণকে তিনি সমর্থন করবেন না। কিন্তু এই বসতিস্থানকারীরা? আমাদের শত্রম্ন ওরাই।'

তুরমুস আইয়ার কয়েক কিলোমিটার দূরে শিলোহতে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকেন প্রথমদিকের বসতিস্থাপনকারী ইজরেল মেদাদ। এটি মোটামুটি একটা ছোট শহরের মতো বড়, এখানে আছে সুপার মার্কেট ও বাস সার্ভিস। মিশুক ও হাসিখুশি মেদাদ ইংরেজি বলছিলেন, নিউ ইয়র্কের কুইন্স এলাকার টানে। তার বয়স এখন ৭০-এর কোঠায়। মেদাদ বলছিলেন, তিনি অল্প বয়সি ছেলেছোকরাদের সহিংসতা একেবারেই অনুমোদন করেন না। তার ভাষায়, 'এটা অন্যায় এবং এতে আমাদের জন্য ভালো কিছু হচ্ছে না।' তিনি চান, 'তরুণ প্রজন্মের ছেলেরা বয়স্কদের কথা শুনুক। কিন্তু আমাকে এটা বলতেই হবে যে, ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাস সত্ত্বেও যদি ইউরোপ ও বাকি বিশ্ব তাদের পক্ষে থাকে, তাহলে অল্প কিছু ইহুদি তরুণের সহিংস কার্যকলাপের কারণও তারা বুঝতে ও সহ্য করতে পারবে।'

অনুমোদনহীন ইহুদি বসতি- যার নাম 'আউটপোস্ট'

একটা উঁচু জায়গা থেকে ইজরেল মেদাদ দেখাচ্ছিলেন দূরে আউটপোস্টের সারি। এই আউটপোস্টগুলো হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট ইহুদি বসতি। এগুলো সরকারিভাবে অনুমোদিত নয়। এগুলোকে বলা হয় শিলোহ বস্নক, যা পশ্চিম তীরকে দুই ভাগ করে ফেলতে চাইছে। এই আউটপোস্টগুলোতে যারা থাকে- তারা আরও বেশি কট্টরপন্থি বলে পরিচিত। এদের মধ্যে আছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সি বসতিস্থাপনকারী এবং তারা ইহুদি মতবাদে অধিকতর উদ্বুদ্ধ। তারা অনেকে প্রথমদিকে মোবাইল হোম বা অস্থায়ী আবাসন দিয়ে এখানে থাকা শুরু করেছিল, যাতে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না।

আদেই আদ এমন একটি বসতি- যা সরকারিভাবে ইসরাইলি বসতি নয়। কিন্তু তারা গত ২৫ বছর ধরে এখানে থেকে শিকড় গজিয়েছে। এখন এই জায়গাটিতে থাকে ৫০টি পরিবার। এই এলাকাটি বাইবেলের যুগের নানা পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ। এখানে পর্যটকদের জন্য গাইডের কাজ করেন রাহেল। তিনি পাঁচ ছেলেমেয়ের মা। রাহেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার ছোট গেস্ট হাউসটির বারান্দায় বসে। তিনি এটিকে পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকেন। ইসরাইলের নানা প্রান্ত থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও লোকে এখানে বেড়াতে আসে বলে তিনি জানালেন।

রাহেল বলছিলেন, ১৮ বছর আগে যখন তিনি এসেছিলেন, তার চেয়ে এখন জীবনযাপন অনেক সুন্দর ও সহজ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যে জোট সরকার, এখন ক্ষমতাসীন-তাতে অত্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় দলগুলো আছে। কিন্তু তারা ক্ষমতাসীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই এ জায়গাটা বৈধতা পেতে শুরু করেছে, উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। তার কথায়, এমনকি যারা এসব বসতিস্থাপনকারীদের চায় না, সেই ফিলিস্তিনিরাও এখন এসব উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে।

হিব্রম্ন ভাষায় 'আদেই আদ' কথাটির মানে হচ্ছে 'চিরকালের জন্য'। এখান থেকে গাড়ি চালিয়ে গেলে অল্প দূরেই আরেকটি আউটপোস্ট আছে। সেটিরও একটি আধ্যাত্মিক নাম দেয়া হয়েছে- কিন্তু এর অর্থ আরেকটু কঠোর। 'এশ কোদেশ'- মানে হচ্ছে 'পবিত্র আগুন'।

শান্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা এসব বসতি

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসায় ইসরাইলি পুলিশের অভিযানের পর উত্তেজনা, সহিংসতা ও প্রাণহানি আরও বেড়ে গেছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অতীতে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি পশ্চিম তীরকেও ইসরাইলের মানচিত্রে ঢোকাতে চান। তবে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা হয়তো নেতানিয়াহুকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। ট্রাম্প প্রশাসন জেরুসালেমকেও ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পশ্চিম তীরে থাকে প্রায় ২৫ লাখ ফিলিস্তিনি। যে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন ফিলিস্তিনিরা, সেটি হওয়ার কথা পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখন্ড নিয়ে, আর তার রাজধানী হওয়ার কথা পূর্ব জেরুজালেম। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা পশ্চিম তীরে ১৪০টি বসতি তৈরি করেছে ইসরাইল, যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ ইহুদি বসবাস করে। এসব বসতি নির্মাণ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ কিন্তু ইসরাইল তা মানে না। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যে কোনো শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিতর্কিত একটি ইসু্য হচ্ছে পশ্চিম তীরের এসব ইহুদি বসতি।

ফিলিস্তিনিরা মনে করে, এই ইহুদি বসতিগুলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম বাধা এবং এগুলোকে অপসারণ করতে হবে। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে পশ্চিম তীরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ চলছেই। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে