শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁচা-মরা এক পদ্মা নদীর গল্পগাথা

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদনদী যদি ভালো না থাকে, নদীগুলো যদি ধুঁকতে থাকে তাহলে তা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত বয়ে আনে।
সাধন সরকার
  ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার সেই অপরূপ সৌন্দর্য ও যৌবন এখন নেই বললেই চলে! পদ্মার অনেক স্থানে এখন ধু-ধু বালুচর। উপমহাদেশে এমন বৈচিত্র্যময় নদীর সংখ্যা খুবই কম! বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে বন্যা, শুষ্ক তথা শীত মৌসুমে আবার সেই পদ্মা পানির অভাবে ধু-ধু বালুচর। বহুকাল ধরে পদ্মার বুকে ভাঙা-গড়ার খেলা চলে আসছে। পদ্মা নদীর একদিকে ভাঙন অপরদিকে পলি পড়ে চরের পরিধি বেড়েই চলেছে। নাব্য সংকটে অনেক সময় মাওয়া ও আরিচা পয়েন্টে ফেরি চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়। পদ্মাপাড়ের বালুমহাল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, পদ্মাপাড়ের বিনোদন স্পটে পস্নাস্টিক-পলিথিনের দূষণ, প্রভাবশালীদের পদ্মারপাড় দখল, সবমিলিয়ে পদ্মা নদী যেন ধুঁকছে। পদ্মার বুকে চর পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হেতু হলো- পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের অভাব, খরা, অনাবৃষ্টি, ফারাক্কার পানি কম পাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, জলবায়ুর প্রভাব ইত্যাদি। শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে চরগুলো যেন দ্বীপের মতো জেগে ওঠে। তবে বড় কারণটা যদি উলেস্নখ করতে হয় তাহলে বলতে হবে মূল সমস্যা হলো ফারাক্কার বাঁধ।

পদ্মার পানির প্রবাহ ধরে রাখতে চুক্তি অনুযায়ী কখনো ন্যায্য পানি পায়নি বাংলাদেশ। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা (পদ্মা) নদীর পানি ভাগাভাগির লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি পানিচুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়কে শুষ্ক মৌসুম হিসেবে ধরে প্রতিটি মাসকে বিভিন্ন চক্রে ভাগ করে- কোন চক্রে কী পরিমাণ পানি পাবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। অতঃপর প্রায় আড়াই দশক হতে চলল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ পানি প্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যা কখনোই পায়নি! ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদনদী প্রায় ৫৪টি। এসব নদীর বেশির ভাগই উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের বিভিন্ন উৎস থেকে। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা। গঙ্গা বাংলাদেশের রাজশাহীতে এসে পদ্মা নাম ধারণ করে দেশের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে। বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পশ্চিমাংশের নদনদীগুলোর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দেয়; অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে নদনদীগুলো শুকিয়ে যায়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীকেন্দ্রিক সেচ ব্যবস্থা, কৃষি কাজসহ নদীমাতৃক বাংলাদেশে নানা বিপর্যয় নেমে আসে। নদনদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় নাব্য সংকটে যাতায়াত ব্যবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদনদী যদি ভালো না থাকে, নদীগুলো যদি ধুঁকতে থাকে তাহলে তা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত বয়ে আনে।

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তাসহ শাখানদী-উপনদী মিলে অসংখ্য নদনদী এ দেশে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বড় নদনদীতে যদি পানি না থাকে তাহলে ছোট নদনদীগুলোও পানির অভাবে শুকিয়ে যেতে থাকে। যুগের পর যুগ এ অবস্থা চলতে থাকায় পানির অভাবে ও নাব্য সংকটে বহু নদনদী শুকিয়ে গেছে, অনেক নদী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করার ফলে বাংলাদেশের নদনদীগুলোর ওপর মহাবিপদ নেমে এসেছে। প্রতি বছর প্রায় ৬০ ভাগেরও বেশি পানি ভারত ফারাক্কা দিয়ে সরিয়ে নেয়। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় তা বন্যা ও নদীভাঙনের কারণ হচ্ছে। ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা লংমার্চ ছিল ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। কিন্তু তাতেও খুব বেশি সুফল মেলেনি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ৭০০-এর বেশি নদনদী ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে পানি প্রবাহ সচল রয়েছে এমন নদনদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০-এর কাছাকাছি। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা দিয়ে পানি কম পাওয়ার কারণে সুন্দরবনসংলগ্ন নদনদীর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, পদ্মা শুধু যেন বর্ষাকালের নদী! বর্ষাকালে পদ্মা তার ভরা যৌবন ফিরে পায়। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে কোনো কোনো স্থানে পদ্মা যেন মরা খাল। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার কারণে বাংলাদেশের নদী বিধ্বংসী কর্মকান্ড ত্বরান্বিত হতে পারে না। কেননা, নদী জাতীয় সম্পদ। এক দেশের নদী ব্যবস্থাপনা অন্য দেশের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। মনে রাখতে হবে, নদনদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। তাই দেশের নদনদী রক্ষার্থে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ন্যায্য পানি প্রাপ্তির দিকে যেমন নজর দিতে হবে তেমনি নিজেদেরও নদনদী রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদী তীরের দখল-দূষণ থেকে পদ্মা নদীকে রক্ষা করতে হবে। নাব্য সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় দীর্ঘকাল ধরে পদ্মা নদীর চর পড়ে যাওয়া স্থানে বনায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার ন্যায্য পানি প্রাপ্তির জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত-চীন-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

সাধন সরকার: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে