শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতাই পারে আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে

বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখালেও অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকানো যায়নি শত চেষ্টা করেও। পরিণতিতে মহামারির সময় আত্মহত্যার কারণে আগের বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে ১৩ শতাংশ বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আত্মহত্যাপ্রবণতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হতাশা ও বিষণ্নতা। বৈষম্যের দারুণ কষ্ট এবং প্রতারিত হওয়ার অসহ্য যন্ত্রণাও আত্মহননের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।
আর কে চৌধুরী
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ যত ঘটছে মানুষ ততই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপে আটকা পড়ছে। বাড়ছে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। জীবন-জীবিকার পেছনে ছোটা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পেয়ে সন্তানের মনোজগতে হতাশা তৈরি হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় মানুষ মনের ভাব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রায় অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এ স্বাধীনতার অপরিণামদর্শী ব্যবহারে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা শুধু একে অন্যের কাছাকাছি হওয়া নয় সহজেই জৈবিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ছে। এ সম্পর্কের জেরে কোনো কোনো সময় বস্ন্যাকমেলিংয়ের শিকারও হচ্ছে অনেকে। জীবন-জীবিকার সংগ্রামও মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে। বিশেষত করোনাকালে এ সমস্যা মহীরুহ হয়ে দেখা দিয়েছে; যা হতাশাগ্রস্তদের একাংশকে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নিতেও বাধ্য করছে।

করোনা মহামারির কারণে দুনিয়াজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যাও অগুনতি। আর্থিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে দুনিয়াজুড়ে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা।

দেশে চলমান মহামারির মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃতু্য হয়েছে, সেই সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। পরিসংখ্যান বু্যরোর চলমান এক জরিপে চলতি অর্থবছরের দশ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

আমাদের পারসেপশন ছিল যে কোভিডের সময় কোভিডেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, অন্যান্য রোগে কম মারা যাচ্ছে। কিন্তু পরে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মহামারির এই সময়ে দেশে শুধু হার্ট-অ্যাটাক, হার্ট-ফেইলিওর ও হৃদরোগে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃতু্যর তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। তাতে বছরে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ২০০ জনের বেশি।

আর পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এর বাইরে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, লাফিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ঘটনাও থাকে।

গতবছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃতু্য হয়েছে ৮ হাজার ৩২৯ জনের।

বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখালেও অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকানো যায়নি শত চেষ্টা করেও। পরিণতিতে মহামারির সময় আত্মহত্যার কারণে আগের বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে ১৩ শতাংশ বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আত্মহত্যাপ্রবণতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হতাশা ও বিষণ্নতা। বৈষম্যের দারুণ কষ্ট এবং প্রতারিত হওয়ার অসহ্য যন্ত্রণাও আত্মহননের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

হতাশা নামের মানসিক অসুস্থতা আমাদের পারিবারিক ও সমাজজীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষত কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে হতাশার থাবা যেভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। এর মোকাবিলায় থাকতে হবে পারিবারিক উদ্যোগ। বেকারত্ব নিরসনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধেও প্রশাসনকে শক্ত হতে হবে।

আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পালস্না দিয়ে সমাজ নানা জটিলে বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধগুলো ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায়প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে