শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কালের বিবর্তন

বর্তমানে ফরিদগঞ্জে সেই গ্রামের খালগুলো বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমি হ্রাস পেয়ে সেখানে ব্যবসা এবং বসবাসের ঘর তৈরি হয়েছে। কাঁচারাস্তা পাকা হয়েছে। খাল ভরাট হয়ে সড়ক পথ তৈরি হয়েছে। চান্দ্রা স্কুল ঘেঁষা ডাকাতিয়া নদীতে বাঁধ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেখানে মাছচাষ করা হচ্ছে। গ্রামে এখন আর বাইরাকাল (বর্ষাকাল) হয় না। ভেলা, তালের নৌকা, ডিঙি নৌকা, কোষা নৌকা এখন বিলীন। কাঠেরপুল-বাঁশের সাঁকো বক্স কালভার্টে ঢেকে গেছে। যান্ত্রিক বাহনে রাস্তাঘাট সয়লাব।
মোহাম্মদ মাসুদ খান
  ২১ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

সময়টা সত্তর দশকের। তখন বর্ষার সময় ক্ষেত, খামার, বিল এমনকি পথঘাট পর্যন্ত জলরাশিতে ভরে যেত। জনসাধারণ কলার ভেলা, তালের নৌকা, ডিঙি নৌকা, কোষা নৌকা কিংবা ছইঅলা নৌকা যোগে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করতেন। পানিপথ হতো চলাচলের প্রধান মাধ্যম।

শুকনো মৌসুমে গ্রামবাসী পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন। ৪/৫ মাইল এমনকি ১৪/১৫ মাইল পর্যন্ত হেঁটেই পাড়ি দিতেন। চলাচলের জন্য উত্তর বাংলায় গরুগাড়ির চল ছিল। সামর্থ্যবান পরিবারের মেয়েরা পাল্কি যোগে যাতায়াত করতেন। ছেলেরা কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে করতেন চলাচল। গ্রামবাংলায় কোনো যান্ত্রিক যানবাহন ছিল না। এমনকি তিন চাকার রিকশাও দেখা যেত না।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মদনেরগাঁও এমনি একটি অজপাড়া গ্রাম। আমার দাদা এবং নানাবাড়ি এই একই গ্রামে মাত্র আধমাইল দূরত্বে।

১৯৭২ বা ৭৩ সাল হবে। ভরা বর্ষাকাল। আঞ্চলিক ভাষায় 'বাইরাকাল।' চারপাশ পানিতে টইটম্ু্বর। নৌকাই চলাচলের মুখ্য বাহন। আমরা সবাই নানুবাড়িতে (নানা তখন বেঁচে নেই, তাই নানাবাড়িকে আমরা নানুবাড়ি বলতাম)। মেজো খালুজিদের বাড়ি থেকে নানুবাড়ির সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। নানুবাড়ি থেকে মেজো খালুজিদের বাড়ি মানেই উসুফভাইদের বাড়ি দূরত্ব চার-পাঁচ মাইলের মতো। সকাল বেলা নানুবাড়ি সংলগ্ন খালে নৌকা হাজির। ছইঅলা মোটামুটি বড় নৌকা। নানু, বুড়োনানু, বড়খালাম্মা, আম্মা, ছোট খালাম্মা, বড় মামি এবং তাদের ছেলেমেয়ে রহিমা আপা নাজু আপা, নাসিমা আপা, আমার আপা, কামরুন, মহসিন ভাই, ইউসুফ ভাই, মিরন ভাইসহ সবাই নৌকায় চেপে বসলো। ইউসুফ ভাই এবং মহসিন ভাই ছইয়ের বাইরে- বাকিরা ভেতরে। মেঘলা আকাশ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে নানুবাড়ির ঘাট থেকে মেজো খালুজিদের দেবীপুর বাড়ির উদ্দেশে নৌকাযাত্রা শুরু করল। খাল, ডুবন্ত ফসলি জমি আবার কখনো বা ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে মাঝি নৌকা বাইতে লাগলেন। চারদিকে অথৈ পানি। উঁচু ভিটে এবং বাড়িগুলো কেবল জেগে আছে। পাটোয়ারীবাড়ী, বেপারিবাড়ী, শেখবাড়ী, চান্দ্রা স্কুল ঘেঁষে ডাকাতিয়া নদীর পাড় দিয়ে চান্দ্রাবাজারের পূর্ব দিকে এসে নৌকা থামলো। ছোট মামা এবং কলের ঘরের খুশী মামা দুজন মিলে দই আর মিষ্টির হাঁড়ি নৌকায় পৌঁছে দিলেন। মাঝি পুনরায় নৌকা বাইতে শুরু করলেন। গভীর পানিতে বৈঠা এবং কম পানিতে লগির সাহায্যে মাঝিভাই নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরু খাল, চওড়া খাল, বিল, ক্ষেতের উপর দিয়ে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলছে। পথিমধ্যে কাঠের পুল এবং বাঁশের সাঁকোর নিচ দিয়ে যেতে হচ্ছে। শাপলা-শালুক, ডুবন্ত ধানক্ষেত পেরিয়ে কুশলী হাতে আমাদের মাঝি নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ছইঅলা নৌকার পাশ দিয়ে যাতায়াত করা তালের নৌকা এবং কোষা নৌকাগুলোকে বেশ ছোটই মনে হচ্ছিল। আমাদের নৌকার ঢেউয়ে কোষা নৌকার দুলনি অল্পদূর থেকে দারুণ লাগছিল। খাড়খাদিয়া, ওয়াপদা খাল, পূর্ব বালিথুবা হয়ে দেবীপুর গ্রামের সর্বশেষ প্রান্তে মেজো খালুজিদের তপাদারবাড়ীতে নৌকা যখন ভিড়ল তখন দুপুর প্রায়, যদিও মেঘলা আকাশে তা বোঝা যাচ্ছিল না। দেবীপুর তপাদারবাড়ীর পরই রনবইলা গ্রাম শুরু। তপাদারবাড়ীতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল ফুল ও ফলের বৃক্ষরাজি। রক্তলালের মতো ফুটে আছে রক্তজবা ফুলগুলো। মূলবাড়িতে ঢোকার আগেই কাচারি ঘর। কাচারি ঘরের পূর্ব দিকে পুকুর। বাড়িটিতে বেশকটি ঘর। ঘরগুলো উপরে টিন, বেড়াগুলো টিনের, কাঠ, বাঁশের চাটাই দ্বারা তৈরি। অধিকাংশ ঘরের পাটাতন মাটির তৈরি। বাড়িতে দুপুরে খাবারের ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। নানু, বুড়োনানু, আম্মা, খালাম্মা, ভাইবোন সবাই দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে পুরো বাড়ি ঘোরাঘুরি করলেন। ইতোমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকায় তখন সন্ধ্যা মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সবাই ফেরার জন্য নৌকায় উঠে বসলেন। মাঝি নৌকা নিয়ে মদনেরগাঁও খা'গোবাড়ী মানে নানুদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন। যাত্রা শুরু করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সারাদিনের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, সন্ধ্যায় মাঝারি থেকে প্রবল হতে লাগল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের মাঝি দক্ষতার সঙ্গে নৌকা বাইছেন। প্রবল বৃষ্টিতে জলরাশি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফেরার পথে এক পর্যায়ে বাধলো বিপত্তি। দেবীপুর, ওয়াপদা খাল, পূর্ব বালিথুবা পেরোতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। ঝামেলা হলো খাড়খাদিয়ায় এসে। পরে চান্দ্রাবাজারের আরও কিছু দূরে মদনেরগাঁও। অন্ধকার নেমেছে ভালোভাবেই। দেবীপুর যাওয়ার সময়ে সকালে যে বাঁশের সাঁকোর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা পার হয়েছিল তা প্রবল বর্ষণে প্রায় ডুবোডুবো অবস্থা। এই অবস্থায় নৌকা নিচ দিয়ে তো সম্ভবই নয়, উপর দিয়েও পার করা যাচ্ছিল না। বর্ষণ আরো বেড়ে গেল। আমাদের নৌকা সাঁকোর কাছে নোঙর করা হলো। বর্ষণের অবিরাম ধারায় পানি আরো বৃদ্ধি পেল। সাঁকো এবার পানিতে কিছুটা ডুবে গেছে। মাঝি এবার সাঁকোর উপর দিয়ে লগি ও বৈঠার সাহায্যে নৌকা পার করতে সক্ষম হলেন। আর সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। খাড়খাদিয়া পেরিয়ে চান্দ্রাবাজার এসে গেছে নৌকাটি। বৃষ্টির তীব্রতা একটুও কমছে না। চান্দ্রাবাজার কাঠেরপুল পেরিয়ে ডাকাতিয়ার কোল ঘেঁষে স্কুল এবং তিনটি বাড়ি পার হলেই নানুবাড়ি। বৃষ্টির অবিরাম ধারা এবং নিকষকালো অন্ধকারে মাঝিভাই নৌকাটি নিয়ে আর এগুতে সাহস পেলেন না। তিনি চান্দ্রাবাজার পুলের গোড়ায় নৌকাটি নোঙর করলেন। এবার কাঁচারাস্তা দিয়ে নানুবাড়িতে পৌঁছাতে হবে। মাত্র আধমাইল পথ। নৌকা থেকে নেমে রাস্তা ধরে সবাই হাঁটা শুরু করলেন। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সবাই। কাদা পথে হাঁটাও যাচ্ছে না। কাদায় পা আটকে যাচ্ছে। দুই-তিনশ' গজ হাঁটার পর চান্দ্রা স্কুলসংলগ্ন টিনের মসজিদে সবাই আশ্রয় নিলেন। আমার ক্ষুদ্র স্মৃতিতে আর স্মরণ করতে পারছি না। সম্ভবত আমি আম্মা বা ছোট খালাম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নানুদের বাড়ি টিনের মসজিদ থেকে মাত্র চার-পাঁচশ' গজ দূরে ছিল।

আজ থেকে ৪৮/৪৯ বছর পূর্বে আমাদের গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন ছিল? নতুন প্রজন্মের পাঠকরা আশা করি বুঝতে সক্ষম হবেন। ৯/১০ মাইল (১৫/১৬ কি.মি.) পথ পেরোতে সেই সময় ৭/৮ ঘণ্টা লেগে ছিল।

বর্তমানে ফরিদগঞ্জে সেই গ্রামের খালগুলো বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমি হ্রাস পেয়ে সেখানে ব্যবসা এবং বসবাসের ঘর তৈরি হয়েছে। কাঁচারাস্তা পাকা হয়েছে। খাল ভরাট হয়ে সড়ক পথ তৈরি হয়েছে। চান্দ্রা স্কুল ঘেঁষা ডাকাতিয়া নদীতে বাঁধ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেখানে মাছচাষ করা হচ্ছে। গ্রামে এখন আর বাইরাকাল (বর্ষাকাল) হয় না। ভেলা, তালের নৌকা ডিঙি নৌকা, কোষা নৌকা এখন বিলীন। কাঠেরপুল-বাঁশের সাঁকো বক্স কালভার্টে ঢেকে গেছে। যান্ত্রিক বাহনে রাস্তাঘাট সয়লাব।

মোটরসাইকেল, অটো, বেবিট্যাক্সিতে গ্রামবাসী যাতায়াত করেন। ১৫/১৬ কিলোমিটার পাড়ি দিতে এখন আর ৭/৮ ঘণ্টার প্রয়োজন হয় না। অল্প সময়ের মধ্যেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করছেন। কাঠ, বাঁশ বা টিনের ঘর আর চোখে পড়ে না। পুরানো ইটের ব্যবহার বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। গ্রামবাসীর ব্যস্ততা বেড়েছে। যান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে পালস্না দিয়ে তাদের মধ্যে যান্ত্রিকতাও ভর করেছে। দাওয়াত খাওয়া- দাওয়াত দেওয়ার প্রচলন সেভাবে দেখা যায় না। দেখা গেলেও লোক দেখানো। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পোস্ট দেওয়াই যেন লক্ষ্য। কালের এই বিবর্তন কি আমাদের উন্নতি নাকি শত বছরের ঐতিহ্যের বিলোপ?

মোহাম্মদ মাসুদ খান : লেখক ও সংগঠক

সধংড়ড়ফংঁঢ়ঃর@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে