শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ফারিহা হোসেন বায়োকেমেস্ট্রি-বায়োলজি ও পরিবেশ বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত
  ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে 'জলবায়ু পরিবর্তন ও নিম্নমানের খাবারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে শিশুদের রক্ষায় ব্যর্থ বিশ্ব' বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, বিশ্বের প্রতিটি শিশু 'তাৎক্ষণিক হুমকির' মুখে রয়েছে। এমনিতে করোনার অতিমারিতেও বিশ্বের দেশে দেশে শিশুরা প্রচন্ড ঝুঁকির পাশাপাশি তাদের শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তন্মধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বের শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক ৪০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞের মতে, কার্বন নির্গমন, প্রকৃতির ক্ষতিসাধন, উচ্চমাত্রার ক্যালরি এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য থেকে যে ক্ষতি হচ্ছে তা থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না বিশ্বের কোনো দেশ। অতিমাত্রায় কার্বন নির্গমন শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে ফেলছে। এতে তাদের ওপর অতিরিক্ত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দাবদাহ থেকে শুরু করে মৌসুমি বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটছে। আর ওই কার্বন নির্গমনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী দেশগুলো। এএফপি বলছে, ওই রিপোর্ট অনুমোদন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ।

রিপোর্টে ১৮০টি দেশের শিশুদের বেঁচে থাকা, শিক্ষা ও পুষ্টির বিষয় আমলে নিয়ের্ যাংকিং করা হয়েছে। তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, শাদ, সোমালিয়া, নাইজার ও মালি। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩, পাকিস্তান ১৪০ ও ভারত ১৩১তম অবস্থানে রয়েছে। উচ্চ মাত্রার চর্বি, চিনিসমৃদ্ধ খাবার, অ্যালকোহল ও তামাকজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ থেকে শিশুরা যে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। কলেজ অব লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর গেস্নাবাল হেলথের পরিচালক ও ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড হেলথের প্রফেসর অ্যান্থনি কস্টেলো বলেন, সবচেয়ে বড় বার্তাটি হলো বিশ্বের একটি দেশও বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করছে না। 'যখন আপনি দেখবেন যে বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয় তখন খুব কম সময়ই থাকে এর সমাধান করার। কিন্তু এ জন্য নেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা এই সমাধানটা করবেন।' বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস বলেন, 'বিশ্বের সিদ্ধান্তদাতারা শিশু ও তরুণদের সুরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে, ব্যর্থ হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে। তাদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। শিশুদের এই গ্রহকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।' রিপোর্টে বলা হয়, ৫ বছর বয়সের নিচে এমন প্রায় ২৫ কোটি শিশু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঝুঁকিতে আছে। তারা বসবাস করছে অপুষ্টি, দারিদ্র্যের মধ্যে। একই সঙ্গে বিশ্বে মোটা হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৯৭৫ সাল থেকে ১১ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৪০ লাখ।

এমনি অবস্থায় কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে মহানুভবতার অনন্য নজির গড়লেন বহুল আলোচিত সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থানবার্গ। ডেনিশ এক ফাউন্ডেশন থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ১ লাখ ডলার ওই শিশুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ১৭ বছর বয়সি গ্রেটার অনুদানের এ খবর এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। গ্রেটা বক্তব্য নিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জলবায়ু সংকটের মতো করোনাভাইরাসও শিশুদের অধিকার সংকটে ফেলবে। এটা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে সমগ্র শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলবে। শিশুদের সহায়তায় সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান গ্রেটা। শিশুদের জীবন রক্ষা, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার মতো ইউনিসেফের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে সহায়তায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান প্রতিবাদী এই কিশোরী।

আমাদের মনে রাখা উচিত শিশুরা সবদিক দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল। এতে শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে প্রভাবিত করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বছরজুড়েই লেগে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত অবক্ষয় শিশুদের অধিকার খর্ব করে, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সর্বজনীন সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, শিশু বিবাহ ও শিশু শ্রম বন্ধ এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে জলবায়ুর পরিবর্তন। বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের উন্নয়নে দেশগুলোর অনেক অর্জন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ম্স্নান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে এক কোটি নব্বই লাখেরও বেশি শিশুর জীবন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরাসরি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানাচ্ছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারগুলো যখন ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, তখন সেই পরিবারের শিশুরা অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুদের নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে, দায়িত্ব নিতে না পেরে মেয়েশিশুদের অনেক পরিবার দ্রম্নত বিয়ে দিচ্ছে। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত অনেক পরিবার নিজের এলাকায় সর্বস্ব হারিয়ে একপর্যায়ে কাজের খোঁজে শহরে চলে আসছে। যাদের বসবাস বাংলাদেশে নদীপথগুলোর পাশে, তাদের ক্ষেত্রে নদীভাঙন একটি নিয়মিত ব্যাপার। যারা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। শিশুদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করে যে সারাবিশ্বে বিদ্যমান রোগের বোঝার ৮৮% পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের সমতল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ঘনবসতি ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দেশটি শক্তিশালী ও অননুমেয় শক্তিগুলোর কাছে বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে জলবায়ু পরিবর্তন। দেশের উত্তরের বন্যা ও খরাপ্রবণ নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ঝড় ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল পর্যন্ত এই হুমকি অনুভূত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অনেকে ঢাকা ও অন্য বড় শহরগুলোতে যাচ্ছে, যেখানে শিশুদের বিপজ্জনক শ্রম বা শিশু বিয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। পাশাপাশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য, সশস্ত্র সংঘাত এবং স্বাস্থ্য মহামারির কারণে আরও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবগুলোর মধ্যে আছে : প্রাণহানি এবং আঘাত, তাপজনিত রোগ, পরিবেশের ক্ষতিকারক উপাদানের সংস্পর্শে আসা; সংক্রামক ও উষ্ণ তাপমাত্রায় অন্যান্য বিদ্যমান রোগ।

শুধু তাই নয়- জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য বিপর্যয় কৃষক, জেলে, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী ও ছোট ব্যবসার মালিকের সম্পত্তি ও পুঁজি হারানো এবং পারিবারিক আয়ও বাধাগ্রস্ত হয়। একই কারণে যখন গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন এবং শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে। প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্য অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পরিবেশগত অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। শোষণমূলক বিপণনের চর্চায় ফাস্টফুড, মিষ্টি পানীয়, অ্যালকোহল আর তামাকের অভ্যাস গড়ে উঠছে শিশুদের মধ্যে, যা সংকটে ফেলছে তাদের স্বাস্থ্যকে। জলবায়ু পরিবর্তন আর বাণিজ্য চাপের কারণে বিশ্বজুড়েই শিশুরা টিকে থাকার হুমকিতে রয়েছে। ঢাকার ৭০ শতাংশ বস্তিবাসী পরিবেশগত অভিবাসী যারা গৃহহারা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সার্বজনীন সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, শিশু বিবাহ ও শিশু শ্রম বন্ধ এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যখন শিশুরা একবার তাদের চারপাশে পরিবেশগত সমস্যাগুলোর অস্তিত্ব ও জরুরি দাবি সম্পর্কে জানতে পারে, তারা আরও সচেতন হবে, পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষায় কৌশলী হতে পারবে এবং বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় তারাও ভূমিকা নিতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সবাই মিলে যদি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করি, তবে আমাদের মিলিত কার্যক্রম দুর্যোগের প্রভাব থেকে বাঁচতে সহায়তা করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। সংবাদমাধ্যমগুলো বছরব্যাপী প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে আরও বেশি উদ্যোগী হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষতিপূরণ দাবি ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারকে দরকষাকষির দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণে জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা নিলে হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবো। (পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম বিষয়ক ফিচার)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে