মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের বাংলাদেশ

আবেগ দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি এবং আদর্শবাদী নেতাকর্মী ছাড়া রাজনীতি করতে গেলে বিপদ আসবেই। সুযোগ-সন্ধানীরা এখনো সুযোগ পেলে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। চোখ, কান খোলা রেখে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে, বিদেশি এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, কিন্তু তিনি বাংলাদেশ গড়ে যেতে পারেননি। শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করছেন। উন্নত বাংলাদেশ তার হাত দিয়েই নির্মিত হবে- এমনটাই আশা করে বাংলাদেশের মানুষ।
মোনায়েম সরকার
  ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ-বিরোধী একদল ঘাতকের নৃশংস আক্রমণে সপরিবার নিহত হন। ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত রাতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে থাকার কারণে বেঁচে যান। শেখ হাসিনার স্বামী, বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া উচ্চতর বৃত্তি নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে পড়তে গিয়েছিলেন। তখন ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে পশ্চিম জার্মানিতে আসেন শেখ হাসিনা, শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, শিশুকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা।

১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাত ধরে দুই শিশুসন্তান ও আঠারো বছরের ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান। জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করার মুহূর্তে বিদায় ক্ষণটি কেমন বেদনাদায়ক ছিল তা শেখ রেহানার একটি লেখা থেকে উপলব্ধি করা যায়। শেখ রেহানা লিখেছেন- '১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে যখন কামাল ভাই আর জামাল ভাইয়ের বিয়ে হয়, আমরা প্রচুর আনন্দ করেছিলাম। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। আগস্টে প্রথম দিকে হাসু আপা, তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানি যাবে। বাবা আর মা আমাকেও তাদের সঙ্গে পাঠালেন। আমি মোটেও যেতে আগ্রহী ছিলাম না। দুটো সন্তান নিয়ে বোন হাসুর অনেক কষ্ট হবে। তাই মা আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বললেন। যখন বিদায় নিতে যাব, মা কাঁদছিলেন। আমি পেস্ননে চড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত রাসেল আমার হাতটা ধরে ছিল। সেদিন সবাই এসেছিল। আমি অনেক বিমর্ষ ছিলাম।'

সম্ভবত এই কারণেই কার্লসরুয়ে শহরে পৌঁছেই তারা আশপাশের কয়েকটি দেশ ও শহর ঘুরে দেখার জন্য মনস্থির করেন। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট তারা কার্লসরুয়ে থেকে পশ্চিম জার্মানির বন শহরে চলে যান। সেখান থেকে সড়ক পথে যান বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। এক রাতের জন্য নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরেও তারা বেড়াতে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার সময় ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, বিখ্যাত কবি সানাউল হকের বাসায় অবস্থান করেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া, জয় ও পুতুল।

বঙ্গবন্ধু-হত্যার খবর জার্মানির বনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে অবহিত করেন। তিনি টেলিফোনের মাধ্যমে ওয়াজেদ মিয়াকেও এ খবর পৌঁছে দেন এবং তিনি ওয়াজেদ মিয়াকে অনুরোধ করেন তৎক্ষণাৎ শেখ হাসিনাকে কিছু না জানাতে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ঘটনা শোনার পর পরিস্থিতি দ্রম্নত পাল্টে যেতে থাকে। শেখ হাসিনাদের মাথার উপর থেকে একটা বিরাট ছায়া সরে গিয়ে পুরো জীবন দুঃসহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়। এমনকি তাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। কাছের চেনা মানুষ অচেনা হয়ে ওঠে, দূরের অচেনা মানুষ হাত বাড়িয়ে দেয় আশ্রয়ের জন্য। জীবন বোধহয় এমনই। এক মুহূর্তে সাজানো বাগান ভস্ম হয়ে যেতে পারে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পর শেখ হাসিনাদের জীবন কেমন স্বজনহীন, অভিভাবকহীন হয়ে উঠেছিল তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার থেকে। সাক্ষাৎকারটি বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায় (১৫ আগস্ট, ২০১৭) প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে মাহজাবিন চৌধুরী বলেন- '১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার দায়িত্ব নিতে অনেকেই ভয় পেয়েছিল বা দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। বেলজিয়ামের বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রধান সানাউল হক আর মামুন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা ১৫ আগস্ট সকালে ব্রাসেলসে ছিলেন। এই দুজন তখন ফোন করে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানান, 'হুমায়ুন তুমি আমার বাসায় যে মেহমানদের পাঠিয়েছ, তাদের ফেরত নিয়ে যাও।' রাষ্ট্রপতির দুই কন্যা হঠাৎ করেই যেন অনাহূত হয়ে গিয়েছিলেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোনে বেলজিয়ামের বাংলাদেশ হাইকমিশনে অনুরোধ করেছিলেন, দুই বোনকে জার্মানিতে আসার জন্য যাতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তার সেই অনুরোধটাও রাখা হয়নি।' বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে অনেক ঘনিষ্ঠ মানুষই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কাছে অপরিচিতি, দূরবর্তী মানুষের মতো হয়ে উঠেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেনের প্রসঙ্গও উলেস্নখ করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় তিনি জার্মানিতেই অবস্থান করছিলেন। একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সেদিন বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করে সংবাদ-সম্মেলন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। ১৬ আগস্ট, জার্মানির স্টাইনবের্গ হোটেলে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পরামর্শে অনিল দাশগুপ্তের আয়োজনে অনেক কষ্ট করে একটি সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও ড. কামাল হোসেন সেদিন সংবাদ সম্মেলনে কোনো বিবৃতি না-দিয়ে লন্ডন চলে যান। কেন বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেননি, তার কোনো কারণ আজও জানা যায়নি। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'জার্মানিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আব্বার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন (জার্মানি)। তার কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। একটা বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলেও রাজি হননি। (প্রথম আলো, ১৮ মে, ২০১৪)।

সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তার জীবিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপদে বেঁচে থাকার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়। তৎকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের জন্য মোটেই অনুকূল ছিল না। ইউরোপ কিংবা আমেরিকাও তাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। মার্কিন ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। তাই পৃথিবীর যেসব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল, সেসব দেশে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। এসব কথা চিন্তা-ভাবনা করে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিলিস্নতে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে দিলিস্ন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জার্মানি থেকে দিলিস্ন যাওয়ার ব্যাপারে পি.এন. হাকসার এবং ডি.পি. ধর বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এ সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে মাতৃস্নেহে যেভাবে বুকে টেনে নেন, তার কোনো তুলনা হয় না।

১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সতর্কতার সঙ্গে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ভারতের দিলিস্নর উদ্দেশ্য শেখ হাসিনারা রওনা হন। ২৫ আগস্ট ভোরে তারা দিলিস্নর পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। এই সেই ঐতিহাসিক পালাম বিমানবন্দর। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের শুভ মুহূর্তে লন্ডন থেকে দিলিস্ন হয়ে ঢাকায় ফিরেছিলেন। দিলিস্নর পালাম বিমানবন্দরে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে রাজকীয় সম্মান জানিয়েছিল ভারত সরকার। জীবনের চরমতম দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার আঠারো বছরের ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে শুধু নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য পালাম বিমানবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। শেখ হাসিনারা বিমানবন্দরে পৌঁছালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একজন যুগ্ম সচিব তাদের স্বাগত জানান।

এরপর তাদের ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি 'সেফ হাউস'-এ নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের ঠাঁই হয় পান্ডারা রোডের ডিফেন্স কলোনির একটি ছোট বাসায়। ডিফেন্স কলোনিতে থাকা অবস্থায় তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সজাগ দৃষ্টি রাখেন। বাড়ির বাইরে না-যাওয়া, কাউকে পরিচয় না-বলা এবং দিলিস্নর কারও সঙ্গে যোগাযোগ না-করার জন্য তাদের সতর্ক করা হয়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহের ছায়ায় ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন শেখ হাসিনারা। এর মধ্যে শেখ রেহানার লেখাপাড়ার কথা উঠলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে নেহরু ইউনিভার্সিটি, সিমলা বা শান্তিনিকেতনে ভর্তির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। একপর্যায়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেখ রেহানার নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে শেখ রেহানার শান্তিনিকেতনে পড়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। এরপর লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ রেহানা। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দিলিস্ন থেকে লন্ডনে আসেন। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে লন্ডন প্রবাসী বাঙালি শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানা প্রবল অর্থ-সংকটে পড়েন। ওদিকে ভারতের রাজনীতিও কিছুটা ওলোট-পালোট হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হলে মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হন। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনাদের প্রতি সহযোগিতা বৃদ্ধি না-করে বরং কিছু কিছু সুবিধা খর্ব করেন। শেখ হাসিনাদের ফ্ল্যাটের বিদু্যৎ বিল যেটা সরকার দিত, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের চলাচলের জন্য যে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা তুলে নেওয়া হয়। এমনকি আর্থিক কষ্টে থাকা ওয়াজেদ মিয়ার ফেলোশিপের সময় ফুরিয়ে গেলে দেশাই সরকার এক বছর সময় বাড়ানোর জন্য প্রায় তিন মাস কালক্ষেপণ করেন।

এমন পরিস্থিতিতে শেখ রেহানার বিয়ে হলে একটি টিকিটের টাকা জোগাড় করতে না পারার কারণে শেখ হাসিনা তার একমাত্র প্রিয় ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লন্ডন যেতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা যখন বাংলাদেশ থেকে জার্মানি যান, তখন তিনি দুই মেয়ের হাতে ২৫ ডলার করে মোট ৫০ ডলার দিয়েছিলেন। জার্মানি থেকে দিলিস্ন যাওয়ার সময় রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিয়েছিলেন এক হাজার জার্মান মার্ক। সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া সংগ্রাম করেছেন দিলিস্নতে, আর শেখ রেহানা ও তার স্বামী শফিক সিদ্দিক বেঁচে থাকার সংগ্রাম করেছেন লন্ডনে। তাদের সেদিনের সেই দুর্বিষহ জীবন অনেকের মতো আমিও খুব কাছে থেকে দেখেছি।

শেখ হাসিনাদের পান্ডারা রোডের বাসায় সীমিত সংখ্যক মানুষের যাতায়াত ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করে আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে ভারত যাই। প্রায় চার বছর ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থেকে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার চেষ্টা করি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে ঘাতকদের মুখোশ উন্মোচন করা দুর্বার লড়াই করি। তখনই দিলিস্নর পান্ডারা রোডের বাসায় আমাকে নিয়ে যান 'হু কিলড মুজিব' গ্রন্থের লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক এ এল খতিব। সেদিন পান্ডারা রোডের বাসায় তাদের যে-দুর্দিন আমি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি, সে কথা মনে হলে আজও আমার চোখ অশ্রম্নসিক্ত হয়ে ওঠে।

প্রবাদ আছে, 'সুসময়ে অনেকে বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়।' বঙ্গবন্ধুর যখন সুসময় ছিল, তখন শেখ হাসিনাদের বন্ধু-শুভার্থীর কোনো অভাব হয়নি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে শেখ হাসিনারা অনেকের কাছেই বোঝা বা ঝামেলা হয়ে উঠেছিলেন। শেখ হাসিনা একজন পোড়খাওয়া মানুষ। অনেক সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও অনেক বাধা-বিপত্তি, দুঃসময় অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেন এবং বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেন। মৃতু্য বহুবার তাকে ছুঁয়ে গেছে কিন্তু শেষ করতে পারেনি। জেল-জুলুম-জীবনবিনাশী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। অতীত মনে রেখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এখন এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন পঁচাত্তর-ট্র্যাজেডির মতো আর কোনো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা বাংলাদেশে না ঘটে।

আবেগ দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি এবং আদর্শবাদী নেতাকর্মী ছাড়া রাজনীতি করতে গেলে বিপদ আসবেই। সুযোগ-সন্ধানীরা এখনো সুযোগ পেলে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। চোখ, কান খোলা রেখে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে, বিদেশি এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, কিন্তু তিনি বাংলাদেশ গড়ে যেতে পারেননি। শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করছেন। উন্নত বাংলাদেশ তার হাত দিয়েই নির্মিত হবে- এমনটাই আশা করে বাংলাদেশের মানুষ।

\হ

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে