সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রম ও আমাদের বাবা-মা

নতুনধারা
  ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মানবসমাজে সভ্যতার গতি যত বেগবান হচ্ছে তত কমে যাচ্ছে আবেগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মানবিকতা, কৃতজ্ঞতার মতো মানব হৃদয়ের কোমল স্বত্বাগুলো। ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা হৃদয়হীন পশুতে পরিণত হচ্ছি। সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টিশালায় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন একমাত্র জীব হচ্ছে মানুষ। তারাই সৃষ্টির সেরা সম্পদ বলে গর্ব এবং অহংকার করে থাকেন। সংবেদনশীল ও হৃদয়সম্পদে ধনী বলে দাবি করা মানুষ কি আসলেই তাই? আমার কাছে এই বিষয়টা সবচেয়ে বড় অদ্ভুত লাগে। এই হৃদয়সম্পদে ধনী মানুষই আজ হৃদয়হীন, অমানবিক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।

একটি শিশুর জীবনের প্রথম প্রভাতে যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তিনি হচ্ছেন মা। জীবনের পরম আদরগুলো মায়ের কাছেই পেয়ে থাকেন। সেইসঙ্গে বাবার খাটুনি করা শেষে ঘাম ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরা, চুমু দেওয়ার মতো ঐশ্বরিক সুখ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বাবা-মার মায়া-মমতা স্নেহ-ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি শিশু। সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহ অকৃত্রিম এবং অতুলনীয়। বাবা-মার মিলিত আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও স্নেহে লালিত-পালিত শিশু ক্রমে পা বাড়ায় আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং একদিন এই বাবা-মার কাঁধে ভর করে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়ও।

বড় দুঃখের বিষয়, পরিতাপের বিষয় এই শিশু যখন বড় হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ায় এবং নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তখন সে ভুলে যায় তার বৃদ্ধ বাবা-মার সেই আত্মত্যাগ, কষ্ট, পরিশ্রমের চিরন্তনি লড়াইকে। এই সন্তানের কাছেই তখন তার বৃদ্ধ বাবা-মা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় নতুন একটি দরজা। যেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মাসে মাসে, সেই বৃদ্ধাশ্রমে কিছু টাকা পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতার পবিত্র দায় পালন করে এই হৃদয়হীন আধুনিক প্রজন্ম। কখনো খোঁজও নেয় না, বাবা-মা কেমন আছেন! স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা এই সবকিছুর বিনিময় তখন শুধু অবহেলা। এই কৃতজ্ঞতাহীন হৃদয়হত্যার কাহিনি আমাদের জন্য সত্যিই বড় লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের।

যে বাবা-মা নিজেদের রক্তকে পানি করে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে নিজে না খেয়ে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করলেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবজ্ঞা, অবহেলা-ই কি তাদের পাওনা ছিল? এটাই কি তাদের উপযুক্ত প্রতিদান? একটু ভালোবাসা, যত্ন, সুখ চাওয়া কি তাদের অন্যায়?

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে প্রবীণ নাগরিক সংখ্যা। বর্তমান সময়ে পরিবর্ধিত সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাড়িতে ছেলের বউ কিংবা ছেলের সঙ্গে বনিবনার অভাবে তারা একই বাড়িতে থাকতে পারছেন না। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে পরিচালন সমিতির অত্যাচারও চরম। এই অমানবিক অবস্থায় বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মাদের অবস্থা করুণ। তাদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হচ্ছে নরকযন্ত্রণা। আর্থিক, শারীরিক ও সামাজিক দিক দিয়ে দুর্বল ও শক্তিহীন এই মানুষের অসহনীয় দুর্দশা দেখে কেন নিশ্চুপ নিরুত্তর এই বর্তমান প্রজন্ম সেটাও আমার বোধগম্য নয়।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃদ্ধ বাবা-মার প্রত্যাশা খুব বেশি কিছু নয়। দু'বেলা দু'মুঠো খাবার, একটু আশ্রয়, চিকিৎসা যত্ন আর বেশি করে ভালোবাসা। এই সহমর্মিতা, সহৃদয়তা কি দেখানো যায় না? ভুলে গেলে চলবে না, তারা আমাদের একান্ত আপনজন, আমাদের জন্মদাতা-জন্মদাত্রী, আমাদের বাবা-মা। তারা আমাদের লালন-পালন করে মানুষের মতো মানুষ না করলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? একবার কি ভেবে দেখেছেন? আধুনিক জীবনভাবনার আত্মঘাতী আগুন কিন্তু একদিন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেবে আমাদের হৃদয়হীন এই অমানবিকতাকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বোঝা নয়, বরং সম্মান-সম্ভ্রমের অফুরন্ত উৎস। তাদের অভিজ্ঞতার ওপর যদি আমরা আরও বেশি করে আস্থা রাখতে পারি, তাহলে অনেক উপকৃত হবো, লাভবান হবো। যে মানুষজন জীবনের সোনালি সময়টা সন্তানদের সফল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আত্মবলিদান দেন তাদের আমরা যেন একটু ভালোবাসা, যত্ন, শান্তি দিতে পারি, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। পোশাকে আধুনিকতা আসে না, আসে ভাবনা মন ও মননে। আমাদের মন ও মনন সেই অঙ্গীকারের শুদ্ধতায় উজ্জ্বল হোক এটাই কামনা করি।

আজহার মাহমুদ

চট্টগ্রাম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে