সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

রাজনীতিতে 'খেলা হবে' সংস্কৃতি

সাকিব আহমেদ
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে পরিচিত দুটি শব্দ 'খেলা হবে'। এ যেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আলোড়ন তৈরি করা স্স্নোগান- 'খেলা হবে'। কেউ রাজনৈতিক মাঠে আবার কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খেলে ব্যাংক ভরে খেলা জমিয়ে দিচ্ছেন তথা খেলছেন। সবার মুখে কম-বেশি শোনা যাচ্ছে 'খেলা হবে'। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বলছেন 'আসো খেলব'। কিন্তু এই খেলা আসলে বাংলাদেশকে নিয়ে কোন খেলা খেলতে চাইছেন দেশের নেতাকর্মীরা? রাজনৈতিক বক্তব্যে এই ধরনের বাক্যের ব্যবহার নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও বেশ আলোচনা-সমালোচনা করেছেন সংসদ সদস্যরা।

'খেলা হবে' শব্দ দুটির ব্যবহার শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে বলেছিলেন, 'কারে খেলা শেখান? আমরা তো ছোটবেলার খেলোয়াড়?খেলা হবে!' শেষের এই শব্দ দুটি স্স্নোগান হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মুখে এখন শোনা যায় খেলা হবে। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকেই ব্যবহার করেছেন এই স্স্নোগান।

কথায় কথায় দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মুখে 'খেলা হবে' শোনার জন্যই কি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াই করে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল?

বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বাংলাদেশের জনপ্রিয় শীর্ষ ২ রাজনৈতিক দল 'আওয়ামী লীগ' ও 'বিএনপি' নিজেদের দলের সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য কথায় কথায় দলীয় নেতারা 'খেলা হবে' বলে যাচ্ছেন।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কি ভুলে গেছেন সাধারণ জনগণের কথা, তারা কেমন আছে? সত্যিই কি এই স্বাধীন দেশে সাধারণ জনগণ ভালো আছে? কখনো খোঁজ নেওয়ার সময় পেয়েছেন কি এই শীর্ষ নেতাকর্মীরা নাকি তারা তাদের খেলা নিয়ে ব্যস্ত!

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী ধরা পড়ে। ক্রমান্বয়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকলে মার্চ মাসের শেষ দিক থেকেই সরকার দেশে ছুটি ও লকডাউন ঘোষণা করেন। করোনা মহামারি সারা বিশ্বের জীবনব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্য এ মহামারি অর্থনীতির বড় এক হুমকি! করোনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ও স্ব-উদ্যোগী ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহণ, বিমান পরিবহণ, পর্যটন প্রভৃতি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে চাকরি ও কর্ম হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে। দেশের নিম্নআয়ের মানুষজন সঞ্চয় ভেঙে ব্যাংক কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গবেণায় বলা হয়েছে,

'করোনাকালে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনার প্রকোপ কমায় এ সংখ্যা কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।'

এদিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছেন, 'বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব, চাহিদা-জোগান সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ একাধিক কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে কয়েকগুণ বেশি।' বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর দুর্বলতার কারণেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেপরোয়া মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু দেশে এরকম সিন্ডিকেট হওয়ার দায়ভার কার? এ বিষয়েও নজর নেই কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। তারা খেয়াল রাখছেন কীভাবে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায়। দেশের রাজনৈতিক নেতারা কি তা হলে সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকা নিয়ে খেলছেন?

এক দিকে যেমন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হাহাকার লেগে গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাশীল সরকার-দলীয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকর্মীরা তাদের খেলা নিয়ে ব্যস্ত। অন্যদিকে আবার সরকার দলীয় বিপক্ষ দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সাধারণ জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে তাদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এক শ্রেণির অজ্ঞ-লোকদের বিক্ষোভ-মিছিলে লেলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলীয় নেতাদেরও সাধারণ জনগণের সুবিধার জন্য কাজ করে যাওয়া দরকার। নেতৃত্ব হচ্ছে কোনো একটি স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য কোনো একটি দল বা গোষ্ঠীর একসঙ্গে পথচলার সংগ্রাম। অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের 'খেলা হবে' কথার পেক্ষাপটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্যে বিএনপি সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেছিলেন, ''আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'খেলা হবে'। 'আসেন খেলি।' এরপর কর্মীদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেন, 'আপনারা খেলার জন্য প্রস্তুত তো?' এ সময় সবাই 'হঁ্যা হঁ্যা' করে সমস্বরে উত্তর দিল। তখন রুমিন ফারহানা বলেন, '২০১৪ সালে প্রতিপক্ষকে নিয়ে খেলার সাহস দেখাতে পারেননি। ২০১৮-তে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্ধকারে খেলেছেন। লুকিয়ে কিংবা অন্ধকারে একা একা নয়, আসুন প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রকাশ্যে খেলুন। আমরা দেশের মানুষকে নিয়ে খেলি। মামলা করে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না।'

সংসদের অধিবেশনে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সরকারের 'খেলা বন্ধের' আহ্বান জানালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের 'খেলা চালু' রাখার ঘোষণা দেন। সংসদের অধিবেশনের হারুন তার বক্তব্যে বলেন, 'দেশ এখন জনদুর্ভোগের দেশে পরিণত হয়েছে। এই জনঅসন্তোষকে লাঘব করার সরকারের কোনো পদক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। যানজটের কারণে সরকারকে পথচারীরা গালাগাল করছে। এটা একদিনের সমস্যা নয়। ঢাকা-গাজীপুর সড়ক প্রতিনিয়ত জনদুর্ভোগ হচ্ছে। হারুন, বিমানবন্দরে তলস্নাশির নামে যাত্রীদের হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ করেন। সড়ক পরিবহণ মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে হারুন বলেন, যোগাযোগ মন্ত্রী প্রায়ই বলছেন খেলা হবে। আমরা এমন খেলা দেখতে চাচ্ছি না যে জনদুর্ভোগে মানুষ পড়েন। এ দেশে দ্রব্যমূল্য, বিদু্যৎ এগুলো নিয়ে বিএনপি গত কয়েক-মাস ধরে সভাসমাবেশ করছে।'

হারুনের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'বিরোধী দল হলেই বিরোধিতার খতিয়ে বিরোধিতা করা সংস্কৃতি পরিণত হয়েছে। গাজীপুরের যে প্রকল্প পদ্মা সেতু হয়ে গেছে, মেট্রোরেল সামনে হচ্ছে। এলিভেটেড এগিয়ে গেছে। কর্ণফুলী টানেল রেডি। কী চান আর? একটা সরকার এতগুলো প্রজেক্ট। যেদিকে তাকান ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস ওভার পাস। আপনাদের সময় কী ছিল? জিরো। ওই জিরোর বিরুদ্ধে খেলা হবে। ওই জিরো যে করছেন! ভোগান্তিতে রাখছেন লাখো কোটি মানুষকে। সেটিই খেলা হবে। খেলা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, খেলা হবে। এর বিরুদ্ধেই খেলা হবে। খেলা হবে। আমি বলছি খেলা হবে, খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে। খেলা হবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। খেলা হবে আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। খেলা হবে লুটপাটের বিরুদ্ধে।'

সংসদের ২০তম অধিবেশনে সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বলেছেন, 'দেশের নানা সংকটকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খেলায় নেমেছে। এই দুই দলের খেলায় দেশের মানুষ অতিষ্ঠ।' সত্যিই আমরা সাধারণ জনগণের এই দুই দলের খেলায় অতিষ্ঠ। এ খেলা থেকে আমরা মুক্তি চাই। আবার জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, 'ইদানীং রাজনীতিতে নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। সবাই বলছে- খেলা হবে। কীসের খেলা হবে? কোথায় খেলা হবে? কার সঙ্গে খেলা হবে? জনগণ কোথায় খেলা দেখতে চায়? এটা বুঝি না। এটা নতুন শব্দ। নারী নেত্রীরাও বলছেন, খেলবেন, আসেন। খেলা হবে। এ কেমন কথা? নেতারা বলছেন খেলা হবে, দেখিয়ে দেবো। দ্রব্যমূল্য প্রতিদিন লাগামহীন বাড়ছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, মানুষ বাঁচতে চায়। আপনাদের এই খেলা দেখতে চাই না। এটা তামাশা, বন্ধ করতে হবে। দুটি দলকে অনুরোধ করব এই ধরনের সস্তা কথা না বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না, আতঙ্কিত করবেন না। রাজনীতির ভাষা আছে। ক্ষমতা থাকলে লড়াই করেন।' জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উলেস্নখ করে বলেন, 'এটাকে মোকাবিলা করার জন্য খেলা বাদ দিয়ে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্য হয়ে বিপদ মোকাবিলা করতে হবে। তা না করে একটি দল মাঠে, তারা যে কোনো উপায়ে সমাবেশ করছেন। খেলা করবেন, দেখাচ্ছেন। আবার সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, খেলা হবে।'

দেশে এ রকম রাজনৈতিক নেতাদের খেলা চলতে থাকলে এক সময় দেশের মানুষ খেলা দেখতে দেখতে অভাব-অনটনে মারা যাবে। এ দেশে বর্তমানে বেকারত্ব বেশি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও আয় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের। যার ফলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে। দেশের মানুষ ভালো নেই। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের এদিকে খেয়াল করা দরকার। কিন্তু খেয়াল করবে কে সবাই যার-যার খেলা নিয়ে ব্যস্ত!

নেতৃত্ব কোনো ব্যক্তির বিশেষ পদবি নয়। নেতৃত্ব হচ্ছে- মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়া যা সাধারণ-জনগণের বিশ্বাস, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা, তাদের দেওয়া প্রতিশ্রম্নতি, তাদের প্রতি ভালোবাসা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তৈরি হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ এ দেশে সবার অধিকার আছে। যে কেউ চাইলে রাজনীতি করতে পারবে তাই বলে দেশের সাধারণ জনগণের দিকে না তাকিয়ে শুধু 'খেলা হবে' বলে স্স্নোগান দিলেই মানুষের পেট ভরবে কী? দেশ পরিচালনা করে দেশের সরকার। জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারের দায়বদ্ধতা যেমন আছে ঠিক তেমনভাবে দেশের শীর্ষ নেতারা- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের মতো আরও হাজার তরুণ ও প্রাক্তন নেতাকর্মীদের অবদান থাকা বিশেষ জরুরি।

আমরা সাধারণত জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের মুখে শুধু খেলা হবে শুনতে চাই না। সবাই মিলে স্বাধীন বাংলাদেশকে সুন্দর একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চাই। ৩০ লাখ নিরীহ শহীদ বীর, ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবী, ২ লাখ মা-বোন যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন সে বাংলাদেশ কি আমরা আদৌ গড়তে পেরেছি? তারা শীর্ষ নেতাদের মুখে 'খেলা হবে' শোনার জন্যই কি স্বাধীন করেছিলেন বাংলাদেশ?

সাকিব আহমেদ

সাংবাদিক ও সম্পাদক তরুণ সাহিত্য ম্যাগাজিন

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে